খাদ্যে নিরাপত্তাহীনতা উন্নয়নের অন্তরায়

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাড়তি দামের লাগাম টেনে ধরতে তিনটি পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিছুদিন পূর্বে পেঁয়াজ, আলু ও ডিম এ তিনটি পণ্যের মূল্য ঠিক করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়। বেশ কিছুদিন ধরে এ তিনটি পণ্যের মূল্য উঠানামা করছে। এখন থেকে প্রতিটি ডিমের খুচরা মূল্য সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রনালয়, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই এ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০১৮ এর কৃষি বিপণন আইনবলে এ মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। এতদিন কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়নি তবে এবারই প্রথম এ মূল্য নির্ধারিত হয়েছে। মনে হয় এটা বাস্তবায়িত হবে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিশ^ খাদ্য কর্মসূচীর একটি সমীক্ষায় দেখা যায় Ñ এ বছরের আগষ্টে মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ বা ৪ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। এ সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় মাঝারি আয়ের পরিবার ভুগছিল ৯ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের পরিবার ভুগছিল ৪৭ শতাংশ, ৩০ শতাংশ পরিবার গ্রহণ করছে অপর্যাপ্ত খাদ্য এবং ৭৪ শতাংশ পরিবার বাজার থেকে অল্প পরিমাণে ও কম মূল্যের খাবার কেনার কথা জানিয়েছে। খাদ্যের উচ্চমূল্য, আয়ের বৈষম্য ও প্রাকৃতিক দূর্যোগের প্রভাব খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাদ্যের উচ্চমূল্য ক্রমেই বাড়ছে। ৭১ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে এ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিভিন্নভাবে তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করছে। আরেকটি সানেমের জরীপ পরিচালনায় দেখা যায়, ৭০ শতাংশ দরিদ্র পরিবার তাদের খাদ্যের খরচ কমিয়েছে বিশেষ করে ডিম, মাছ, মাংস না কিনে নিম্নমানের খাবার বেছে নিয়েছে যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তার পরিস্থিতি আগের তুলনায় আরও খারাপ করেছে।
হঠাৎ করে বাংলাদেশ একটি মূল্যস্ফীতির সম্মুখে হাজির। মূল্যস্ফীতি মানুষের আয় হ্রাস করে যাতে দরিদ্রদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দরিদ্রের পক্ষে অসম্ভব। দরিদ্র পরিবারগুলো এ চ্যালেঞ্জ সামলাতে যে কৌশল অবলম্বন করেছে তা ছিল ঋণ গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পোশাকের ব্যয় হ্রাসকরণ এবং সঞ্চয় হ্রাস করা। উচ্চসুদে বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ এবং অনানুষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নিয়ে অনেক দরিদ্ররা ঋণের ফাঁদে পড়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের মাসিক মূল্যস্ফীতি ৬.২ থেকে বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি প্রায় ১২ শতাংশের উপরে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়।

খাদ্যশস্যের উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি, গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য আমদানিতে জাতীয় সিদ্ধান্ত এবং বিকল্প আমদানির উৎস খুজে বের করার মাধ্যমে বাজার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের মধ্যে বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে পুষ্টি সচেনতার উন্নতি করে সুষম খাদ্যের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে। ভর্তূকিযুক্ত খাদ্যসামগ্রী বন্টনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা জাতীয় জরুরী ব্যাপার। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে ও টেকসই কৃষি পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটাতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণেও মনযোগী হতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা বড়ই দুর্বল তাই সেক্ষেত্রে নজরদারি উন্নত করা দরকার। যৌক্তিক কারণ ছাড়া খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি করা যাবে না। সরকারি পরিসেবাগুলোয় দরিদ্রদের অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। দরিদ্র জনগণের আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি করার কর্মসূচী হাতে নিতে হবে।
আমাদের দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের জন্য “সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়নের ব্যর্থতা” বা অধিকার ব্যর্থতারই পরিস্থিতি বুঝায়। এ পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটে যখন বৈধ উপায়ে মানুষ উৎপাদন, বানিজ্য ও হস্তান্তরের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অধিকার ব্যর্থতা তখনো ঘটতে পারে, যখন বাজারে কোন খাদ্য ঘাটতি থাকে না কিন্তু খাদ্যের বন্টন বা বিনিময় অবস্থার পরিবর্তন হয়। মূল্যস্ফীতি, বাজারের কারসাজি, মজুতকরণে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, যা অনেক গরিব মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনা অনেক কঠিন করে তুলতে পারে। অধিকার ব্যর্থতা রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণেও হতে পারে। তাই খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ন্যায়বিচারের গুরুত্ব অপরিসীম। উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা সামলাতে বিভিন্ন অংশীজনের সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা দরকার।