ছাত্র রাজনীতি : ঢাবি শিক্ষার্থীর কান্না ও চবি শিক্ষার্থীর হতাশা – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও কুমিল্লা বিতর্ক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বন্ধু মোহাম্মদ মজিবুর রহমান লাভলু গত ২২ সেপ্টেম্বর তার ফেসবুকে চলমান ছাত্র রাজনীতি নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন । পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে স্ট্যাটাসটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো।

অধ্যাপক মজিবুর রহমান লিখেছেন,

‘একেই কি বলে ছাত্র রাজনীতি ?

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাসেই অংশগ্রহণ করতে পারেনি আমার এক শিক্ষার্থী! আজ সকালে আমার ((Introduction to Education) কোর্সে মোট ৬৩ জনের মধ্যে ৬২ জনই উপস্থিত ছিল, ১ জন অনুপস্থিত। ক্লাস শেষ হওয়ার ১ ঘণ্টা পর সেই শিক্ষার্থী আমার অফিস কক্ষে আসলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ক্লাসে ছিলে না কেন?” সে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, “স্যার, হলে রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ছিল। সিনিয়রদের অনেক কাকুতিমিনতি করেছি কিন্তু তবুও আসতে দেয়নি! এসব মোটেই ছাত্র রাজনীতি নয়; ছাত্র রাজনীতির নামে চলমান অসভ্যতা ও বর্বরতা।’

২.গত ২১ সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুরে আমার অনুজপ্রতীম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। রাজনীতি পছন্দ না করলেও দেশের রাজনীতি ও সমাজ নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময় তার সাথে আমার সেল ফোনে কথা হয়। ওইদিন দুপুরে ফোন করে জানাল, বড় ভাই, আব্বা আমার পরীক্ষার রুটিন দেখে ছোট বোনের বিয়ের দিন ঠিক করেছে। কিন্তু ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের আন্দোলনের কারণে দুই দিন ধরে পরীক্ষা বন্ধ। পরবর্তী পরীক্ষার তারিখ কবে দেয় আল্লাহই জানেন। না-কি বিয়ের দিনই পরীক্ষা পড়ে যায় জানি না। প্রচন্ড হতাশা নিয়ে (নিরাপত্তার স্বার্থে ছাত্রের নাম প্রকাশ করলাম না) সে জানাল, আমরাতো সাধারণ ছাত্র। কিন্তু ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা আমাদেরও তাদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে বাধ্য করেছে। সে আমাকে প্রশ্ন করে জানতে চান, ভাই, ছাত্র নেতাদের কাজ কি ক্লাস- পরীক্ষা বন্ধ করা , না-কি ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার পরিবেশ তৈরী করে দেওয়া ?

ছোটকালে পড়েছি, আজকের শিশুরাই সুন্দর আগামীর ভবিষ্যত । একটু বড় হয়ে পড়েছি,আজকের ছাত্ররাই আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিবে । জাতির স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করবে। প্রথম শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত বিভিন্ন বইয়ে দেশের ছাত্র রাজনীতির গৌরবজনক অধ্যায় পড়ে শুনেই আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসেছি।

৫২’র ভাষা আন্দোলন,৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন,৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন, ৭১ এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ৯০ ’র স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানসহ এদেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র সমাজের রয়েছে গৌরববোজ্জ্বল ভূমিকা। এমনকি স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আমলেও ছাত্ররা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরব ছিলেন। শিক্ষার্থীদের স্বার্থের পরিপন্থী যে কোনো বিষয়ে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ছাত্র সংগঠনগুলো বেশ সোচ্চার ছিল। ঢাকসু, চাকসু , রাকসুসহ নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্রসংসদের নির্বাচন হতো। নেতৃত্বে আসার জন্য গঠনমূলক প্রতিযোগিতা হতো। ছাত্রদের ভোট পাওয়ার জন্য ছাত্রদের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত ছিল ছাত্রসংগঠনগুলো। কিন্তু নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যেতে বসেছে ছাত্র রাজনীতির সেই সোনালি দিনগুলো। বর্তমানে যা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে।

এক সময় অভিভাবকগণ প্রতিযোগিতা করে সন্তানকে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতেন। কারণ মেধাবী ছাত্রদের কারখানা ছিল তখনকার ছাত্রসংগঠনগুলো। অভিভাবকগণ মনে করতেন আজকের ছাত্রনেতা ই আগামী দিনের জাতীয় নেতা। কিন্তু এখন আর অভিভাবকগণ চান না তার সন্তান ছাত্ররাজনীতি করুক কিংবা মেধাবী ছাত্ররাও চান না ঘুণে ধরা লেজুড়বৃত্তিকারী, ব্যক্তি তোষামদকারী, নেতার চামচামি করা, আদর্শ ও উদ্দেশ্যহীন ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে। একসময় ছাত্ররাজনীতির মূলমন্ত্র ছিল শিক্ষা ও প্রগতি নিয়ে। আর এখন ছাত্র রাজনীতির মূল দর্শন হয়ে উঠছে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, হল দখল করে সিট বাণিজ্য করা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রলীগ নেতাতো ধর্ষণের সেঞ্চুরি করে পুতঃপবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উদযাপনও করেছিল।

বিশিষ্ট দার্শনিক আলবার্ট আইনস্টাইন যথার্থই রাজনীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ক্ষুধার্ত পেট কখনই ভাল রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হতে পারে না’ আমাদের দেশের সার্বিক ছাত্ররাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনস্টাইনের সেই বক্তব্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। কারণ, আমাদের আজকের ছাত্রনেতারা ছাত্ররাজনীতি শুরুই করে ক্ষুধা নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্য একটাই ,রাজনীতিতে নাম লিখেই দ্রুত কালো টাকা কামিয়ে নিজের আখের ঘুচানো। সুতরাং তারা কীভাবে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হয়ে উঠবেন!

ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ওই ছাত্রীর কিংবা চবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ওই ছাত্রের কি অপরাধ ছিল যার কারণে একজন ভার্সিটির জীবনে প্রথম ক্লাস করতে পারল না, আর অপরজন পরীক্ষা দিতে না পেরে নতুন করে সেশনজটের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন বন্ধ করার কারণে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই বিভিন্ন বিভাগের পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ ছিল।

ছাত্রলীগের কাছে আমার প্রশ্ন , চবির কমিটিতে আপনাদের রাখা না রাখা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আপনারা দায় চাপালেন কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী আপনাদের কাছে কি অপরাধ করেছিল যার কারণে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে আপনারা ছিনিমিনি খেললেন? ক্লাস ,পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া কি ছাত্ররাজনীতির বৈশিষ্ট্য? এই অপছাত্ররাজনীতির জন্য যে শুধু ছাত্রলীগ দায়ী তা নয়,দেশের অপরাপর ছাত্রসংগঠনগুলোও দায়ী।

গত প্রায় দেড় দশক ধরে দেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের হলসহ ক্যাম্পাসের ক্ষমতায় একচছত্রভাবে আছে ছাত্রলীগ। হলের ‘সহঅবস্থান’ নামক কথাটি আজ ডিকশনারি থেকে বিলুপ্ত প্রায় ! তারপরেও ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যেই হানাহানি , নানা কোন্দল , দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত রয়েছে। এটা প্রত্যাশিত না।

আমি সব সময়ই ছাত্র রাজনীতির পক্ষে। তবে কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র রাজনীতি আমি চাই না। আমি চাই দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র সংসদগুলোতে নির্বাচন দেওয়া হোক। কারণ, কলেজ ছাত্র সংসদের নেতারাই তো এক সময় জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে জাতিকে নেতৃত্ব দিবে।

লেখাটি শেষ করতে চাই, আর্নেস্ট বেনের একটি উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, রাজনীতি হল সমস্যা অনুসন্ধান করা, এটি বিদ্যমান কিনা তা খুঁজে দেখা,এটি ভুলভাবে নির্ণয় করা এবং ভুল সমাধান করার শিল্প হিসেবে কাজ করা।

আমরাও চাই , আমাদের ছাত্র রাজনীতি আর্নেস্ট বেনের কথার যথার্থতা প্রমাণ দিক। আমাদের ক্যাম্পাসগুলো হয়ে উঠুক, সকল দল ও মতের সহ অবস্থান হিসেবে, জেগে উঠুক আমাদের ছাত্র সংসদগুলো।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক , দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি কুমিল্লা জেলা শাখা। ০১৭১১-৩৮৮৩০৮ ,sahajadaamran@yahoo.com.