জনসচেতনতাই পারে জরায়ু মুখে ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করতে

জাহিদ হাসান নাইম।।
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

‘জরায়ু মুখে ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার, জনসতচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে করণীয়’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (২৮ অক্টোবর) রাতে কুমিল্লা আল নূর হসপিটালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে ১৪৯ তম পর্বের এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশো তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গাইনী বিষয়ক জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ আয়েশা সিদ্দিকা, লেকভিউ ম্যাটস’র রাদিয়াতাম মারদিয়া, উইমেন ক্যান্সার কন্ট্রোল ফোরাম, নারী উদ্যোগ কেন্দ্র(নউক), কুমিল্লার কো-অর্ডিনেটর রাশেদা আখতার, জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম (এন.এন.পি)’র সাবেক উপজেলা ম্যানাজার বিউটি আক্তার।

এসময়, টকশোতে জরায়ু মুখে ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে এসেছে। এছাড়াও, আলোচকরা হিউম্যান পেপিলেমো ভাইরাসরোধে সরকারের ৫ম শ্রেণী থেকে ৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ফ্রী ভ্যাক্সিন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে সবাইকে আহবান জানিয়েছেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে ডাঃ আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, জরায়ু মুখের ক্যান্সার বহুল প্রচলিত একটি রোগ। এটা সারভাইক্যাল ক্যান্সার নামে পরিচিত। জরায়ুমুখে সাধারণ যে কোষ থাকে, সেটা যখন বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন তা ক্যান্সারে রূপ নেয়। হিউম্যান পেপিলেমো ভাইরাস থেকে এটা হয়। প্রায় ১০০ টি প্রজাতি রয়েছে এর মধ্যে। এর মধ্যে ১৬ ও ১৮ মূলত ক্যান্সারের জন্য দায়ী। আর এই ভাইরাসটি ক্যান্সারে পরিণত হতে ১৫-২০ বছর সময় নেন। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। ‘ভায়া টেস্ট’ করতে দিলে এই ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিছু লক্ষণও রয়েছে। যেমন, মাসিক ছাড়া কিংবা সহবাসের সময় রক্তপাত হলে, কারো ধাতু নির্গত হলে ও তলপেটে ব্যাথা হলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জরায়ু মুখের ক্যান্সারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর জন্য আমরা কয়েকটি ধাপ ভাগ করেছি। প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে ভ্যাক্সিনেশন। যৌন রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে৷ আর, ২য় ধাপে আমরা ‘ভায়া’ টেস্টের মাধ্যমে আমরা ক্যান্সার কোষকে শনাক্ত করতে পারি। এছাড়াও, বাল্যবিয়ে হলে মেয়েদের যৌনজীবন দীর্ঘ হয়, এরক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে। সেইজন্য বাল্য বিয়ে করা যাবে না।

এছাড়াও, একাধিক যৌনসঙ্গী থাকলেও এটা প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়াও, নারীরা ধূমপান করলেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সরকার এর জন্য ইতিমধ্যে বিনামূল্যে ভ্যাক্সিনেশন কার্যক্রম শুরু করেছে। ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে চলবে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী থেকে নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে এই টিকা দেওয়া হবে। আর জরায়ু মুখের ক্যান্সার অবশ্যই প্রতিরোধ করা যাবে যদি সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়৷ আর, সারভারিক্স ভ্যাক্সিন নিলে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। নির্ভয়ে সবাই এই ভ্যাক্সিন দিতে পারে৷ আর ভ্যাক্সিনটি যৌনজীবন শুরু হওয়ার পূর্বে দিলে বেশী কার্যকরী হবে। আর, যাদের বয়স ১৪ বছরের উর্ধ্বে তারাও এই ভ্যাক্সিন দিতে পারবে। তারা, প্রাইভেট সেক্টরে গিয়ে এই ভ্যাক্সিন দিতে পারবে।

এছাড়াও, নিয়মিত স্ক্রিনিং এর মাধ্যমে তারা সচেতন থাকতে হবে৷ আর, স্তন ক্যান্সারে মহিলারা বেশী আক্রান্ত হয়। আর স্তন ক্যান্সারের কোনো নির্দিষ্ট ভাইরাস নেই। তবে জীবনধারণের পদ্ধতির কারণে স্তন ক্যান্সার হতে পারে। যাদের মাসিক প্রক্রিয়া শুরু আগে ও ম্যানোফেজ পরে হয় তখন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও, দেরীতে বিয়ে হলেও স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷ এছাড়াও, জ্যানেটিক্যালিও এই স্তন ক্যান্সার ছড়াতে পারে। আর, ব্রেষ্টের কোনো সমস্যা হলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলাদা ব্রেষ্ট ক্লিনিক রয়েছে, সেখানে যেতে পারবে। সেখানে ফ্রী স্ক্রিনিং করা হয়। এছাড়াও, উপজেলা পর্যায়েও স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতেও ফ্রী স্তন পরীক্ষা করা হয়। আর, এই মাসে জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে যে ফ্রী ভ্যাক্সিন কার্যক্রম শুরু হয়েছে মেয়েদেরকে সেই আওতায় এনে সরকারের এই কার্যক্রমকে সফল করার অনুরোধ করছি।

রাদিয়াতাম মারদিয়া বলেন, জরায়ুমুখে সাধারণত কম বয়সে হয় না। জরায়ুমুখে ক্যান্সার আক্রান্ত হলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য সারভারিক্স ভ্যাক্সিন গ্রহণ করতে হবে। ক্যান্সার আমাদের জীবনে সারপ্রাইজের জন্য আসে। আর ক্যান্সার যদি প্রথম ধাপে শনাক্ত হয়, তখন সেটা প্রতিরোধ করা সম্ভব৷ কিন্তু, ৩য় কিংবা ৪র্থ ধাপে শনাক্ত হলে সেটা তখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়৷ এইজন্য, আমাদের মেয়েদেরকে জরায়ুমুখের ক্যান্সারের ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে জানাতে হবে। প্রথম ধাপেই যাতে শনাক্ত হয়, সেইজন্য সচেতন করতে হবে সেটাকে৷ আমাদের কাজ হচ্ছে নিজে সচেতন হওয়া ও অন্যকে সচেতন করা। আর ভ্যাক্সিন নিকে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। আর স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে মেয়েরা নিজেদেরকে নিজেরাই পরীক্ষা করবে। যেমন, স্তন থেকে দীর্ঘদিন সাদা তরল বের হওয়া, স্তন চাকা চাকা হয়ে যাওয়া কিংবা স্তনের মধ্যে বিচি-পাঁচড়া দেখা দেওয়া৷ এসব হলে, অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের গোমতি হাসপাতালে এই মাসে স্ক্রিনিং ফ্রী করা হয়েছে এই কারণে। আর, ব্রেষ্ট ক্যান্সারে নারীদের পাশাপাশি পুরুষও আক্রান্ত হচ্ছে। আর লজ্জা কিংবা ভয়ের কারণে মেয়েদের রোগগুলো ৩য় কিংবা ৪র্থ ধাপে চলে যায়৷ এই লজ্জা যেন নারীর মৃত্যুর কারণ হয়৷ জরায়ু ও স্তন নারীদের অন্যান্য অঙ্গের মতোই। তাই এই দুই অঙ্গে অস্বস্তি হলে আপনাকে লজ্জাবোধ না করে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

রাশেদা আখতার বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে আমরা নারী উন্নয়ন কেন্দ্র কাজ করে যাচ্ছি৷ আমরা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা নারীদের নিরাপদ স্বাস্থ্য সুরক্ষার খাতিরে আমরা কুমিল্লায় ক্যাম্পেইন চালু করেছি৷ নবম দশম শ্রেণীতে থাকাকালীন মেয়েদের দূর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব যায়, যা তারা কাউকে বলতে পারে না। মেয়েদের না বলা কথাগুলো এখন সবার সামনে চলে এসেছে। এইকারণে, আমরা যে টিকা টা চালু করেছে, সেটা সবাইকে জানাতে হবে। এর জন্য, ক্যাম্পেইন ও প্রচারণা ও দিকনির্দেশনামূলক কাজ করে যাবো। এছাড়াও, আমাদের মেয়েদেরকে বাল্যবিয়ে দেওয়া থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্যও মেয়েদের অনেক সমস্যা হতে পারে। এছাড়াও, ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা দিলেই যে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে এমন নয়। আগে ক্যান্সার শনাক্ত হতে হবে, তারপর চিকিৎসা। এছাড়াও, আমাদের মেয়েদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এছাড়াও, আমাদেরকে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্যও কাজ করে যেতে হবে৷ আর মায়েদেরকে বলবো, জন্মের পর থেকে ২ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদেরকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এতে স্তন ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। আর, প্রান্তিক নারীরা যেন নিজেদেরকে রোগমুক্ত রাখতে পারে সেজন্য আমরা সবাই সচেতন থাকবো।

বিউটি আকতার বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মূল সমস্যা হচ্ছে দারিদ্রতা৷ জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের প্রজেক্টে আমরা কাজ করতে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি, তাদের কথা শুনেছি। সেখানে নারীরা অনেক সমস্যায় রয়েছে। বিশেষ করে, জরায়ু নিয়েও তারা অনেক সমস্যায় ভুগছে। সন্তান জন্মদানের পর ৪০ দিন পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য আমরা তাদেরকে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়েছি। পুষ্টি যদি ঠিকভাবে না থাকে তাহলে আমাদের কোনো কাজই ঠিকভাবে হবে না। উন্নত বিশ্বের তুলনায় আমাদের দেশের নারীরা সচেতন নয়। তাই আমাদেরকে নারীদেরকে সচেতনতা করতে হবে৷ আর সরকার যে জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে ফ্রী ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা নিয়েছে সেজন্য সাধুবাদ জানাই। তাই আমরা এই ভ্যাক্সিন গ্রহণে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। আর আজকের কিশোরীরাই আগামীতে মা হবে৷ তাই আমাদেরকে কিশোরীদের বেশী বেশী সচেতন করতে হবে৷

কিশোরীদেরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে৷ স্তন ক্যান্সার একটি ভয়ংকর রোগ৷ তবে প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা গেলে এটি নিরাময়যোগ্য। ২০ বছরের পর থেকে নারীদের স্তন পরীক্ষা করা উচিৎ। আর ৩০ বছরের পর থেকে নারীদেরকে অবশ্যই স্ক্রিনিং করতে হবে হাসপাতালে গিয়ে। আর বিবাহিত নারীদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ সেক্ষেত্রে আমাদেরকে সচেতন করতে হবে নারীদেরকে। আর, মায়েদেরকে ওজন কম রাখতে হবে, স্তনে ব্যাথা কিংবা চাকা অনুভূত হলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।