যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু : বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.মনিরুজ্জামান বিডিআর বলেন, সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হয় ২৬ মার্চ থেকে। আর আমরা যারা চট্রগ্রাম ছিলাম আমাদের যুদ্ধ শুরু হয় ২৩ মার্চ থেকে। আমি যেখানে ছিলাম সেখানে আমরা যুদ্ধ শুরু করি ২৫ মার্চ রাতেই । কারণ,মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই চট্রগ্রামে উত্তেজনা শুরু হয়। সমুদ্র বন্দর দিয়ে যাতে কোন অস্ত্র এবং সেনা খালাস হতে না পারে এ নিয়ে চট্রগ্রামের সাধারণ নাগরিকরাও ছিল সোচ্চার। আর আমরা যারা ডিফেন্সে চাকুরী করতাম আমরা তো মার্চের শুরুতেই অনুভব করতেছিলাম যে, এই বুঝি যুদ্ধ লেগে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ রাতে হানাদার বাহিনী হালিশহরে আমাদের বাংকারে গুলিবর্ষন করলে আমরা ১১ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার সুবেদার মজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তাদের উপর পাল্টা আক্রমন করি। এভাবেই ২৫ মার্চ থেকেই আমাদের যুদ্ধ যাত্রা শুরু হয়।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু : বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.মনিরুজ্জামান বিডিআর বলেন , চট্রগ্রামের হালিশহরে হানাদার বাহিনীর সাথে ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া যুদ্ধে যখন দেখছি, আমরা তাদের সাথে পেরে উঠব না, তখন পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতের মেলাঘরের দিকে চলে যাই। মেলাঘরে যাওয়ার পর আমাকে ৪ বেঙ্গলে প্রেরণ করা হয়। এ সময় আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) জিয়াউর রহমান।
যুদ্ধের অণুগল্প :
একটি স্মরনীয় যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে বললে বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.মনিরুজ্জামান বিডিআর,বেলুনিয়া নামক এলাকাটি অনেক বড় একটি সীমান্তবর্তী এলাকা। এক পাশে পড়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য অপর পাশে পড়েছে বাংলাদেশের ফেনী জেলার পশুরাম উপজেলা। আমরা ছিলাম ভারতের অংশে আর পাঞ্জাবীরা ছিল ফেনীর অংশে। শুরু হলো সম্মুখ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমি ব্যবহার করি এলএমজি। আমাদের যুদ্ধ কমান্ডার ছিলেন চট্রগ্রামের ছেলে মফিজুর রহমান। দুই পক্ষের মধ্যে বিরতীহীন ভাবে যুদ্ধ চলছে। বিকাল ৫টার দিকে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী বোমা বিস্ফোরণ শুরু করে। তাদের নিক্ষেপ করা একটি বোমা আমার পিঠে এসে পড়ে। আমি সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি,জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে ভারতের বিশ্রামনগর হাসপাতালে নেওয়া হয়। এই হাসপাতালে এক নাগারে আমার তিন মাস চিকিৎসা চলে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই দেশ স্বাধীন হয়। আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি শুনে পাঞ্জাবীরা আমার বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। পরে আমার স্ত্রী ২মেয়ে ও ১ ছেলেকে নিয়ে শরানার্থী হয়ে মেলাঘরে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
আহত হওয়ার আগে আরেকটি যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বীরমুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান বিডিআর বলেন,কুমিল¬ার ব্রাক্ষনপাড়া উপজেলার শশিদল ইউনিয়নের আশা বাড়ি নামক স্থানে হানাদার বাহিনীর সাথে আমাদের তীব্র এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৯ জন মারা যায়।
সালদা নদীর যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে এই বীরমুক্তিযোদ্ধা বলেন,সালদানদী সংলগ্ন সীমান্ত এলাকার পাহারে ছিল আমাদের বাংকার আর ব্রিজের নিচে একটি গুদাম ঘরে ছিল পাঞ্জাবীদের বাংকার। সারাদিন যুদ্ধ চালিয়েও তাদের সাথে যখন আমরা পারছিলাম না তখন আমাদের কমান্ডারের অনুরোধে মিত্রবাহিনী এসে সরাসরি বাংকারে বোম্বিং করা শুরু করে। মিত্র বাহিনীর বোম্বিংয়ের কিছুক্ষন পরেই দেখা গেল হানাদার বাহিনীর দিক থেকে আর কোন গুলির শদ্ধ শোনা যাচ্ছে ন্ া। তখন আমরা তাদের পরাজয় বুঝতে পেরে ¯ে¬াগান দিয়ে নিচে নেমে আসি। এসে দেখি ৮০জন হানাদার বাহিনীর সদস্য আমাদের এই যুদ্ধে প্রান হারিয়েছে।
পরিচয় : মো. মনিরুজ্জামান বিডিআর। এ নামেই বর্তমানে এলাকার মানুষ চিনে। পিতা ফখরুজ্জামান এবং মাতা জেবুন নেছা। পিতা মাতার এক মেয়ে ও তিন ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। ১৯৩২ সালে তিনি কুমিল¬া জেলার আদর্শ সদর উপজেলার ৪নং আমড়াতলী ইউনিয়নের শিমড়া গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পাকিস্তান ইপিআরে যোগ দেন। যুদ্ধের শুরুতে তার পোষ্টিং গিয়ে পড়ে চট্রাগ্রামের হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে।