ঢাকায় বায়ুদুষণ

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

আন্তর্জাতিক সূত্রানুযায়ী একিউআই ইনডেক্স বা বায়ুমানের সূচক শূন্য থেকে ৫০ পর্যন্ত থাকলে ভাল বা স্বাস্থ্যপ্রদ বলা হয়। ৫১ থেকে ১০০ পর্যন্ত বলা হয় সহনীয়। ১০১ থেকে ১৫০ পর্যন্ত সংবেদশীল মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর। ২০১ থেকে ৩০০ হলে তা খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ এর উপরে হলে বিপদজনক বলা হয়ে থাকে। জানুয়ারী ২০২৩ মাসের প্রথম ২৪ দিনের ২৩দিনই ঢাকা শহরের বাতাস বিপদজনক অবস্থায় ছিল। ঢাকার পাশের সাভার, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জের বাতাস ঢাকার চেয়েও দূষিত ছিল বা থাকছে। এয়ার ভিজুয়েলের তথ্যানুযায়ী ২৮ শে জানুয়ারী ২০২৩ সন্ধ্যায় ঢাকা শহরের একিউআই ছিল ১৮৩, অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর। এমন পরিস্থিতি পর্যালোচনায় উন্নয়ন গবেষণা ও নীতি বিশ্লেষনী প্রতিষ্ঠান “ইনিষ্টিটিউট ফর প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) একটি সভার আয়োজন করে ভার্চুয়াল এ সভায় জানানো হয়, ২১ শে জানুয়ারী ২০২৩ থেকে ২৬ শে জানুয়ারী পর্যন্ত ৬ দিনই বিশে^ দূষিত বায়ুর শীর্ষে ছিল ঢাকা মহানগর।
মারাত্মক দূষিত বায়ু নিয়মিতভাবে রাজধানীসহ তার আশেপাশের নগরী সমূহের অধিবাসীদের শরীরে প্রবেশ করছে। এতে তাঁদের আয়ু সাত থেকে আট বছর কমে যাচ্ছে। দেশে এইডস ও যক্ষ্মার চাইতে বায়ুদূষণ জনিত রোগে মৃত্যুবরন করছে বেশি। ফলে এটি এই শহরের অধিবাসীদের জন্য নীরব ঘাতক হয়ে দাড়িয়েছে। বাতাস দূষনমুক্ত করার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর অবহেলার কারনে এ মারাত্মক অবস্থায় উদ্ভব হয়েছে। বিশে^র প্রধান নগরীসমূহের বায়ুর মান পর্যবেক্ষনকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজুয়েলের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনই মতামত দিচ্ছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নগর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, জানুয়ারি ’২৩ এ ঢাকার বায়ুর মান যেটুকু খারাপ হয়েছে তা বিশে^র যে কোন উন্নত দেশে হলে সেখানে বিশেষ সতর্ক অবস্থা জারি করা হত।
গত ডিসেম্বর’২২ এ প্রকাশিত বিশ^ব্যাংকের প্রকাশনা “ব্রিদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ারপলিউশন এন্ড হেলথ ইন্ বাংলাদেশ” শীর্ষক গবেষনার তথ্যমতে বাংলাদেশে প্রতি বছরে প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ বায়ুদূষণে মারা যায়। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা বলেন, দূষিত বায়ুর কারনে প্রধানত: ফুসফুসে সংক্রমন ঘটে। এছাড়া সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, যক্ষ্মা ও অ্যাজমা রোগের সংক্রমন বাড়তে পারে। চোখ ও কিডনীর সমস্যাও বাড়তে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে মৃত শিশু ও গর্ভপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে কিন্তু বায়ুদূষণের কারনে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। আইপিডি বলেছে বায়ুমানের সূচক ২০১ পার হলেই বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসতর্কতাসহ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। এ অবস্থায় প্রবীন, শিশু ও অসুস্থ মানুষকে বাড়ীর ভিতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমিত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। চলতি জানুয়ারী’২৩ এর প্রথম ২৪ দিনের মধ্যে ২৩দিনই ঢাকার বায়ুমান ছিল ৩০০ এর উপরে অর্থাৎ বিপদজনক। বায়ুমানের এ বিপর্যয়ের কারন হিসেবে আইপিডি বলেছে ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন গাড়ীর চলাচল, নিয়ন্ত্রণহীন ধূলাবালি, অনিয়ন্ত্রিত সড়কের খোড়াখোড়ি, নির্মান প্রকল্পের নির্মানযজ্ঞ, বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা শিল্পকারখানার ধূয়া ইত্যাদি মিলে ঢাকা নগরীর বাতাস বিপদজনক করে তুলছে।
একজন মানুষ দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি খাবার খান, আর বায়ু গ্রহণ করে ১২ থেকে ১৬ কেজি। দূষিত বায়ু গ্রহণ করার ফলে গড় আয়ু প্রায় সাত থেকে আট বৎসর কমে যাচ্ছে। ভার্চুয়াল আলোচনায় বলা হয় বায়ু দূষণ রোধে সরকারি উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। দূষণরোধে বিধিমালার অভাব নাই কিন্তু বাস্তবায়নে তার কোন প্রয়োগ নাই । আলোচনায় বায়ুদোষনরোধে জড়িত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনতে প্রস্তাব করা হয়। নগরায়নে ঢাকার বায়ুমান বিপদজনক। জানুয়ারী’২৩ থেকে শুরু করে ২৪ তারিখ পর্যন্ত সেখানকার বায়ুমান সূচক গড়ে ৪০০ বা তার অধিক ছিল। ক্লিন এয়ার অর্জনে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম, কারা এ আইন করতে দেয়নি তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।
ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো নির্মান, সবুজায়ন ও সবুজ এলাকার কমতি, ভবন নির্মাণ, উদ্যান, পার্ক ও খেলার মাঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধংস করে কংক্রীটের প্রকল্প গ্রহণের কারনে বায়ুদূষণ বাড়ছে। বায়ুদূষনরোধে আইপিডির সুপারিশগুলো হচ্ছে- (১) সবধনের অবকাঠামো নির্মাণে ধূলাবালি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারী করা, যাতে নির্মানকাজের ধূলা বাতাসে না ছড়ায়। (২) অবকাঠামো নির্মানের সাথে যুক্ত ঠিকাদারদের নিয়মিত বায়ুমানের প্রতিবেদন জমা দেওয়া (৩) ফিটনেসবিহীন গাড়ী চলাচল বন্ধ করা ও গাড়ীর গতি নিয়ন্ত্রনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা (৪) শীততাপ নিয়ন্ত্রন যন্তের ব্যবহার সীমিত করা (৫) ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ করে ব্লক ব্যবহারের সরকার ঘোষিত নীতির বাস্তবায়ন করা (৬) ঢাকার চারপাশে সবুজ এলাকা ও সবুজ বেষ্টনী তৈরি করা।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ