তাজুলের ‘তেলেসমাতি’ ভোট ছাড়াই জনপ্রতিনিধি

স্টাফ রিপোর্টার।।
প্রকাশ: ৬ মাস আগে

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সাড়ে ১৫ বছরে দেশে গড়ে তুলেছিল ভোটারহীন এক নির্বাচনের ধারা। তাদের শাসনামলে তিনটি জাতীয় নির্বাচনের প্রথমটি ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন’, দ্বিতীয়টি ‘রাতের ভোট’ আর তৃতীয়টি ‘ডামি প্রার্থীর ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে এর সবকিছুই ছাপিয়ে যান হাসিনা সরকারের শেষ দু’বারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। তিনিই ‘আবিষ্কার’ করেন ভোট ছাড়া জনপ্রতিনিধি হওয়ার নতুন কায়দা।

মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাঁর কুমিল্লা-৯ আসনের লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে স্থানীয় সরকারের মেয়র, চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে ইউপি সদস্যের বেশির ভাগই নির্বাচিত হন বিনা ভোটে। এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার জোরে জনপ্রতিনিধি বানান শ্যালক মহব্বত আলী, ভাতিজা আমিরুল ইসলামসহ অনেক স্বজনকে। বিনিময়ে তাদের সবার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিতে ভুল করেননি তাজুল। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিরোধীদের দমাতে তাজুলের ছিল ক্যাডার বাহিনী। এ ছাড়া বিপক্ষ মত ঘায়েলে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল মিথ্যা মামলা। সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীর নামে দুই শতাধিক মিথ্যা মামলা করেছে তাজুল বাহিনী। তাঁর ক্যাডার বাহিনীর হামলা-মামলায় বিরোধী নেতাকর্মীর বেশির ভাগ ছিলেন এলাকাছাড়া। অভিযোগ আছে, লুটপাটের সুযোগ বেশি থাকায় ‘টাকার খনি’ হিসেবে দুর্নাম আছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। শেষ দু’বার সেই ‘টাকার খনি’র মন্ত্রী থাকায় পুরো সুবিধা কাজে লাগিয়েছেন তাজুল। দু’হাত ভরে কামিয়েছেন টাকা।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, দেশে-বিদেশে তাজুলের আছে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কুমিল্লার নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিলাসী, অপ্রয়োজনীয় ও ভুয়া প্রকল্পের নহর বইয়ে দিয়েছিলেন। এসব বরাদ্দের বড় অংশই গেছে তাজুল ও তাঁর স্বজনের পকেটে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আওয়ামী লীগের অন্য নেতার মতো তাজুলও নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। সরকার পতনের দিন তাঁর মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও গ্রামের বাড়ি এবং লাকসামের পাইকপাড়ার বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায় জনতা। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় এরই মধ্যে তাজুল ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত ২৯ আগস্টের ওই নির্দেশে তাঁর পরিবারের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব ও অন্যান্য তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।

শূন্য থেকে রাজনীতিতে উত্থান
স্থানীয় কিংবা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে কোনো অবদানই ছিল না। তার পরও ১৯৯৬ সালে লাকসামের রাজনীতিতে হঠাৎ আবির্ভাব তাজুলের। নেতাকর্মীর দাবি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার সবুজ সংকেতে তাজুল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ‘অপরিহার্য খেলোয়াড়’ বনে যান। নৌকায় সওয়ার হয়ে ১৯৯৬, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পাঁচবার সংসদ সদস্য হন। এর মধ্যে ২০১৯ সাল থেকে আওয়ামী সরকার পতনের আগপর্যন্ত ছিলেন মন্ত্রী। ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রগুলো দিনভর ভোটারশূন্য দেখা গেলেও তাজুল পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ১৯৫ ভোট। অথচ তাঁর নিকটতম প্রার্থী জাপার গোলাম মোস্তফা ভোট পান মাত্র ১২ হাজার ১৯২। এরপর ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক এমপি আনোয়ার উল আজিমকে প্রচারণায় নামতেই দেয়নি তাজুলের ক্যাডার বাহিনী। সপ্তাহখানেক বাড়িতে ‘অবরুদ্ধ’ থেকে আজিম ঢাকা পাড়ি জমান। এরপরও কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ ওঠে তাজুল বাহিনীর বিরুদ্ধে। ওই নির্বাচনে তাজুল পান ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী আবু বকর ছিদ্দিক মাত্র ৮ হাজার ২৬০ এবং জাতীয় পার্টির গোলাম মোস্তফা কামাল পান ৬ হাজার ১৫৯ ভোট। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে ফেরার পথে গত ২৪ নভেম্বর কুমিল্লা নির্বাচন অফিসের সামনেই হামলার শিকার হন গোলাম সারোয়ার নামে এক প্রার্থী। মনোহরগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ নেতা লক্ষ্মণপুর ইউনিয়নের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, তাজুলের নির্দেশে তাঁর পিএস কামাল লোকজন নিয়ে এ হামলা চালায়। এরপর দীর্ঘদিন এলাকায় যেতে পারিনি।

বিনা ভোটের রেকর্ড
শেষ চার বছরে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনে ভোট ছাড়া জনপ্রতিনিধি বানানোর এক অদ্ভুত সংস্কৃতি চালু করেন তাজুল। একচ্ছত্র প্রভাবে একের পর এক উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পর্যন্ত সবাইকে বিনা ভোটে জিতিয়ে নেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে লাকসাম পৌর নির্বাচনে মেয়রসহ ৯টি ওয়ার্ড ও তিনটি সংরক্ষিত আসনের সব কাউন্সিলর প্রার্থী ভোট ছাড়া নির্বাচিত হন। একই বছর লাকসামের আজগরা, উত্তরদা, লাকসাম পূর্ব, গোবিন্দপুর, কান্দিরপাড়, মুদাফফরগঞ্জ উত্তর, মুদাফফরগঞ্জ দক্ষিণ ও বাকই ইউনিয়নের সব চেয়ারম্যান ও সদস্য জয় পান ভোট ছাড়া। আর ২০২২ সালে মনোহরগঞ্জের ১১ ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সাধারণ সদস্য (মেম্বার) ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের ১৪৩ পদের মধ্যে ১২৯টিতেই বিনা ভোটে জয় পান তাজুলের প্রার্থীরা। জেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোট ছাড়া নিজের লোককে জয়ী করে আনেন তাজুল। এ ছাড়া শ্যালক মহব্বত আলীকে দু’বার বিনা ভোটে ও একবার ডামি প্রার্থী দিয়ে বানান লাকসাম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান। আর ভাতিজা আমিরুল ইসলামকে মনোহরগঞ্জে একবার বিনা ভোটে এবং এ বছর ডামি ভোটে ভাইস চেয়ারম্যান করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত কয়েক বছরে তাজুলের বানানো এসব জনপ্রতিনিধি সবাই আছেন আত্মগোপনে।

স্থানীয়রা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাসখানেক আগেই বিনা ভোটে জয়ী হতে ইচ্ছুক মেয়র, চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যের তালিকা তাজুলের দপ্তরে পাঠানো হতো। লাকসামে তাজুলের শ্যালক মহব্বত আলী এবং মনোহরগঞ্জে ভাতিজা আমিরুল ইসলাম ও ব্যক্তিগত সহকারী কামাল হোসেন বিষয়টি তদারকি করতেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, বিনা ভোটে চেয়ারম্যান হতে জনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ এবং ইউপি সদস্যদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দিতে হতো। এ ছাড়া একই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যে কোনো উন্নয়ন বরাদ্দ এবং টিআর কাবিখা থেকে ২০ শতাংশ টাকা তাজুলের ফান্ডে দিতে হতো।

প্রতিদ্বন্দ্বী দমন কৌশল
গত সাড়ে ১৫ বছরে তাজুলের নির্দেশনায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীর নামে অন্তত ২০০ মিথ্যা মামলা হয়েছে বলে অভিযোগ। এ ছাড়া লাকসাম পৌরসভার উত্তর বাজারে থানার পাশে ছিল তাজুলের শ্যালক মহব্বত আলীর টর্চার সেল। ভগ্নিপতির নির্দেশে সেখানে বসেই দুই উপজেলার দরপত্র ভাগবাটোয়ারা, চাঁদা আদায় এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতা ধরে এনে নির্যাতন চালাতেন তিনি। সরকার পতনের পর ভুক্তভোগীরা ওই ভবনের সামনে ‘আয়নাঘর’ ব্যানার টানিয়ে দেন। এ ব্যাপারে লাকসাম পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনির আহম্মেদ বলেন, ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লাকসামের বিপুলাসারে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলুর ওপর হামলা করে তাজুল বাহিনী। ওই ঘটনায় আমি মামলা করলে বাড়ি থেকে তাজুলের লোকজন তুলে নিয়ে ওই আয়নাঘরে নির্যাতন চালায়। এরপর এলাকাছাড়া করার পাশাপাশি দেওয়া হয় তিনটি মিথ্যা মামলা। কেন্দ্রীয় বিএনপির শিল্পবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, কারা এলাকায় চেয়ারম্যান-মেম্বার হবেন, তাও শ্যালক মহব্বত আলী ওই আয়নাঘরে বসে নির্ধারণ করে দিতেন। তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়ার সুযোগই ছিল না। এ ছাড়া আয়নাঘরে নিয়ে নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলার কারণে হাজার হাজার নেতাকর্মী এলাকায় যেতে পারেননি। ২০১৩ সালে লাকসাম থেকে বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হিরু ও পারভেজ র‌্যাবের অভিযানে আটকের পর নিখোঁজ হন। এ নিয়ে মামলার বাদী গোলাম ফারুক বলেন, এজাহারে তৎকালীন এমপি তাজুলের সঙ্গে হিরুর রাজনৈতিক বিরোধের কথা বলা ছিল। ওই গুমের সঙ্গে তাজুলের সম্পৃক্ততা না থাকলে র‌্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জ থেকে লাকসামে অভিযান চালানোর কথা না। লাকসামের বাসিন্দা বদিউল আলম সুজন বলেন, আমি আইনজীবী হয়েও তাজুল বাহিনীর ২৭টি মিথ্যা মামলার আসামি হয়েছি।
তাজুলের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নিজ দলেন নেতাকর্মীও। জাতীয় নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দেওয়া শেখ হাসিনার একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী আবদুল মান্নান এলাকায় যাওয়ার পর হামলার শিকার হন। মান্নান জানান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিনের আলোচনা সভাতেই তাঁর ওপর তাজুলের শ্যালকের নেতৃত্বে হামলাটি হয়।

১০ বছরে শতকোটি
২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে তাজুলের জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর সম্পদের অস্বাভাবিক উত্থান দেখা গেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় তাজুল সম্পদ দেখান ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। তবে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় দেওয়া হলফনামায় নিজের সম্পদ দেখান ১১৮ কোটি টাকার বেশি, অর্থাৎ ১০ বছরে হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক। এর মধ্যে ২০১৮ সালে সম্পদ দেখান ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সেই হিসাবে মন্ত্রী হওয়ার পর সাড়ে পাঁচ বছরে সম্পদ বেড়েছে ৭০ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে তিনটি বাড়ি ছাড়াও রাজধানীর গুলশান ও চট্টগ্রামে কয়েকটি বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে তাজুলের। হলফনামায় এসব বাড়ি ও ফ্ল্যাট থেকে তিনি বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। ফেবিয়ান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজসহ ২০টি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীও তাজুল। যমুনা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের অন্যতম তিনি। ক্ষমতার দাপটে অধিকাংশ শেয়ার বাগিয়ে নিয়ে ছেলে সাইদুল ইসলামকে বানিয়েছেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান।

তাজুলের স্বজনরাও সম্পদে ফুলে-ফেঁপেছেন। শ্যালক মহব্বত আলীসহ অন্য স্বজনের নামে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ থাকার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের আন্দারীর ফুইট্টারঝিরি এলাকায় ৫০০ একরের বেশি পাহাড়ি জমি তাজুলের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও তাঁর স্বজন দখল করে রেখেছেন। স্থানীয়রা ২ সেপ্টেম্বর ওই জমিতে গেলে তাজুলের ম্যানেজার সাহাবুদ্দিনসহ তাঁর বাহিনী দেশি অস্ত্র ও লাঠি নিয়ে তাদের ধাওয়া করে। স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল হক ও পাইসা প্রু জানান, দলিল জালিয়াতি করে কয়েকশ কোটি টাকার পাহাড়ি ওই জমি দখলে রেখেছেন তাজুলের স্ত্রী, শাহ আলম মুকুলসহ স্বজনরা। অথচ পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জমি লিজ বা কেনার অধিকার কারও নেই।
তাজুলের একাধিক ঘনিষ্ঠজন জানিয়েছেন, দেশে-বিদেশে তাজুলের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। কানাডা ও দুবাইয়ে আছে একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট। স্থানীয় সরকারের মন্ত্রী হিসেবে বিলাসী ও গায়েবি প্রকল্পের অর্থ লোপাটে তাঁর সহযোগী ছিল কাজ পাওয়া তাজুলের পছন্দের ঠিকাদাররা।
কুমিল্লা এলজিইডি দপ্তর থেকে জানা যায়, মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত পাঁচ বছরে কুমিল্লার ১৭ উপজেলার উন্নয়ন বরাদ্দ এসেছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়ম করে নিজ নির্বাচনী এলাকার জন্যই ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন তাজুল। অভিযোগ আছে, ঠিকাদারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব প্রকল্পের বেশির ভাগ পেয়েছেন মন্ত্রীর অন্যতম সহযোগী ও উন্নয়ন সমন্বয়কারী কামাল হোসেনের মাস্টার এন্টারপ্রাইজ, শ্যালক মহব্বতের প্রতিষ্ঠান এম আলী এন্টারপ্রাইজ, ইউপি চেয়ারম্যান ফারুকের মা এন্টারপ্রাইজ এবং ইউপি চেয়ারম্যান শামীমের নিশাত এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে কামাল ও মহব্বতই করেছেন ২৫০ কোটি টাকার বেশি কাজের ঠিকাদারি।
তাজুল-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, মন্ত্রী হিসেবে দুই মেয়াদের সময় তাজুল কুমিল্লা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, পৌরসভা, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পল্লী উন্নয়ন একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরপত্র, নিয়োগ, পদোন্নতি দিতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টাকা লোপাট করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে বরাদ্দ থেকে মন্ত্রীর দপ্তরে সরাসরি কমিশন যেত। এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন তাজুলের পিএস কামাল, ভাতিজা শাহাদৎ হোসেনসহ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা।

‘ফাও’ প্রকল্প
কুমিল্লা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সায়েদুজ্জামান সাদেক জানান, মনোহরগঞ্জের তুগরিয়া-হাসনাবাদ সড়কের নদনা খালের ওপর ৯ কোটি ৪৩ লাখ ৭১ হাজার টাকা ব্যয়ে ৫০ মিটার দীর্ঘ ও ৭.৮ মিটার প্রস্থের একটি আর্চ গার্ডার সেতু গত বছরের ৩১ আগস্ট চালু হয়।
এলজিইডির একাধিক সূত্র বলছে, প্রত্যন্ত এলাকায় এমন সেতুর দরকার ছিল না। তাজুলের পছন্দের আরটা ১ পিসি জেবি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা এ অর্থে গ্রামীণ এলাকায় অন্তত আরও দুটি সেতু নির্মাণ করা যেত। এ ছাড়া লাকসাম ও মনোহরগঞ্জে একই ধরনের আরও ছয়টি সেতু নির্মাণাধীন। এলজিইডির ভাষায়, এসব সেতু ‘ফাও’ প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত।
বিলাসী প্রকল্প এখানেই শেষ নয়। তাজুলের গ্রামের বাড়ি মনোহরগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকা পোমগাঁও এলাকায় ১৬ কোটি ১২ লাখ ৫৮ হাজার টাকায় তৈরি হচ্ছে দ্বিতল সেতু। স্থানীয়রা বলছেন, যে রাস্তায় সিএনজি, অটোরিকশা ও পায়েচালিত রিকশা চলে, সেখানে দ্বিতল সেতু মন্ত্রীর বিলাসিতা ছাড়া কিছুই নয়।

কামালও বিপুল সম্পদের মালিক
তাজুলের কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতির অন্যতম সহযোগী ছিলেন উন্নয়ন সমন্বয়কারী কামাল হোসেন। মাস্টার এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাকসাম-মনোহরগঞ্জের পাশাপাশি কুমিল্লার এলজিইডি এবং ঢাকার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলের বিভিন্ন জেলার কাজ ভাগিয়ে নিতেন কামাল। তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় ৯ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা জেলা কার্যালয়ে দুদক মামলাও করেছে।
সংস্থাটির অনুসন্ধানে কামালের নামে স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ১৭ কোটি ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ২৬ টাকার নিট সম্পদ পাওয়া যায়, যার মধ্যে ৮ কোটি ৯৩ লাখ ৭৭ হাজার ৯৪৬ টাকার সম্পদের কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, কামাল কৃষকের ছেলে। পাসপোর্ট অফিসে দালালি করত। সে-ই এখন কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। দুদকের অনুসন্ধানে তাঁর সম্পদের সিকিভাগও বের হয়নি।