তবে কেন্দ্র থেকে আসা ফলের তালিকা বড় হওয়ার সঙ্গে বাড়ছিল উত্তেজনার পারদ। দুই প্রধান প্রার্থী আওয়ামী লীগের রিফাত ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান খুব একটা ছিল না। সমানতালে এগোচ্ছিল ফল। শুরুতে দ্রুত গতিতে ফল আসায় হিসাব মেলানোও সহজ ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে থেমে যায় ফল প্রকাশের গতি। ৯২ কেন্দ্রের ফল প্রকাশের পর দেখা যায় সাক্কু আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিফাতের চেয়ে এগিয়ে। তখন অনেক সময় ফল ঘোষণা থেমে থাকে।
এক পর্যায়ে ১০১ কেন্দ্রের ফল আসে রিটার্নিং কর্মকর্তার হাতে এতেও সাক্কু এগিয়ে। বাকি চার কেন্দ্রের ফলের জন্য অপেক্ষায় দুই প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা। সঙ্গে গণমাধ্যমের চোখ শিল্পকলার ফল ঘোষণার কেন্দ্রে। কিন্তু চার কেন্দ্রের ফল আসছিল না। দীর্ঘ প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষা। এর মধ্যে ফল ঘোষণা, কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কর্মী- সমর্থকরা এসে হট্টগোল করেন। ঘিরে ধরেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাক্কুকে। তাদের হটাতে ব্যবস্থা নেয় উপস্থিত পুলিশ। অনেককে বের করে দেয়া হয় কেন্দ্র থেকে। হট্টগোলের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা সরে যান তার আসন থেকে। টেলিফোনে কথা বলেন দীর্ঘ সময়। এরপর নাটকীয়ভাবে ফল ঘোষণা করেন তিনি। কুসিক নির্বাচনের ফল ঘোষণার সর্বশেষ মুহূর্ত নিয়ে জোর আলোচনা। কী হয়েছিল এই সময়ে। রিটার্নিং কর্মকর্তা কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কেন এই সময়ে ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছিল। ইভিএম-এ ভোট হওয়ার পরও কেন এতো দেরিতে ফল এসেছিল তার হাতে। ভোটের পর এই আলোচনা এখন কুমিল্লা ছাড়িয়ে দেশজুড়ে। ঘটনার সময় মানবজমিন-এর একজন আলোকচিত্রী সাংবাদিকসহ দুইজন রিপোর্টার দায়িত্বরত ছিলেন ওই ফল প্রকাশ কেন্দ্রে। তাদের বর্ণনায় পাওয়া গেছে সেই ৪৫ মিনিটের একটি চিত্র। তখন রাত সাড়ে আটটটা।
নেতাকর্মীদের নিয়ে ফলাফল ঘোষণার কেন্দ্র নগরীর শিল্পকলা একাডেমিতে যান মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। ওই সময় ভোটের ফল ঘোষণা চলছিল। তখন পর্যন্ত ৯০টি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা হয়। ওই সময় সাক্কু অল্প ভোটে এগিয়ে ছিলেন। হলরুমে গিয়ে সাক্কুর সমর্থকরা তাড়াতাড়ি ফল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানান। এরপর রাত সোয়া নয়টার দিকে নৌকার সমর্থকরা শিল্পকলা একাডেমিতে যান। হলরুমে ঢুকেই তারা নৌকার স্ল্লোগান দিতে থাকেন। এ অবস্থায় রিটার্নিং কর্মকর্তা সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় তিনি ফল ঘোষণার জন্য ৫ মিনিট সময় চান। তিনি বলেন, এখনও ৪ কেন্দ্রের ফল বাকি। এসব কেন্দ্রের ফল হাতে এসে পৌঁছায়নি। আমি আপাতত কাউন্সিলর প্রার্থীদের ফল ঘোষণা করছি। এ কথা শুনে হলরুমে ফের দাবি ওঠে মেয়র প্রার্থীর ফল আগে ঘোষণা করার জন্য। কিছুক্ষণ পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার মোবাইলে একটি কল এলে কথা বলতে বলতে হলরুম ত্যাগ করেন তিনি। প্রায় আট মিনিট পর আবার হলরুমে আসেন। তখন মিলনায়তনের পরিস্থিতি থমথমে হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের সঙ্গে টেবিলঘড়ি প্রতীকের সমর্থকদের ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হলে সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরা সবাইকে হলরুম ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। এক পর্যায়ে পুলিশ লাঠি চার্জ করে সবাইকে বের করে দেয়।
এ উত্তেজনা আশপাশের রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ফলাফল ঘোষণার আগ পর্যন্ত ফলাফল কেন্দ্রের সামনে নৌকার হাজারো সমর্থক রাস্তা দখল করে স্ল্লোগান দিতে থাকেন। আর প্রেস ক্লাবসহ এর আশে পাশের এলাকায় অবস্থান নেন সাক্কুর সমর্থকরা। যদিও বাইরে তার কোনো সমর্থককে স্লোগান দিতে দেখা যায়নি। হলরুমে থাকা অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থী সাক্কু তেমন কোনো কথা বলেননি। কিন্তু তার ছোট ভাই কাইমুল হক রিঙ্কু বারবার ফল ঘোষণার আহ্বান জানান। এর কিছুক্ষণ পর বাকি থাকা চারটি কেন্দ্রের ফল আলাদা করে ঘোষণা না করে সাড়ে নয়টার দিকে মোট ১০৫টি কেন্দ্রের ফলাফল একসঙ্গে ঘোষণা করা হয়। ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থাকা নৌকার সমর্থকরা আনন্দে বিজয় উল্লাস শুরু করেন। কিন্তু শিল্পকলার সামনে নৌকার সমর্থকদের বেশিক্ষণ বিজয় মিছিল করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তাদের দ্রুত ওই এলাকা ছাড়ার অনুরোধ করলে সেখান থেকে মিছিল নিয়ে কান্দিরপাড় হয়ে নৌকা প্রতীকের কেন্দ্রীয় অফিস নানুয়া দিঘির পাড়ে চলে যান তারা।
নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা আলোচনা হলেও ভোটের পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন ভোটাররা। দিনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও ভোটের পরিবেশ নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন তোলেননি। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ভোটের পরিবেশ ঠিক রাখতে অন্তত ১২টি কৌশল আগে থেকেই নির্ধারণ করা হয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনের এই বিশেষ কৌশলের কারণে ভোটের পরিবেশ এবং ভোটগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়নি। তবে ফল ঘোষণার সময় কেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি এটি একটি বড় প্রশ্ন? কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন রিটার্নিং কর্মকর্তা: ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে নানা আলোচনার মধ্যে গতকাল দুপুরে জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের রিটার্নিং অফিসার শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, দু’পক্ষের গোলযোগ, বৃষ্টি ও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে ফল ঘোষণায় কিছুটা দেরি হয়েছে। আধা ঘণ্টার বেশি কেন ভোটের ফল ঘোষণা স্থগিত ছিল? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটির পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে ছিল না বিধায় সময় লেগেছে। দু’পক্ষই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ওই সময় বার বার কার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি ফোনে কথা বলছিলাম সিইসি, ডিসি ও এসপি’র সঙ্গে।
অন্য কারোর ফোন আসেনি। স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে ফোন দিয়ে আনা হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে রিটার্নিং অফিসার বলেন, সাক্কুকে আমি ফোন দিয়ে আনিনি, উনি এটা বললে অসত্য বলেছেন। ভোটের ফল বদলে ফেলার সুযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তার নেই: ওদিকে ফল ঘোষণা নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকাল ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ভোটের ফল বদলে ফেলার সুযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তার নেই। তিনি বলেন, আপনাদের চোখ দিয়ে আমরা (ভোট) দেখেছি। সবাই বলেছে অত্যন্ত সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে নির্বাচন হয়েছে। প্রার্থীরাও সেটা বলেছে। এখন ফলাফলে রিটার্নিং অফিসারের তো পরিবর্তন, পরিবর্ধন করার সুযোগ নেই। কেন্দ্র থেকে প্রিজাইডিং অফিসার ডেটা দিয়েছেন, সেটা উনি ঘোষণা করেছেন। এখানে ভোট ম্যানিপুলেট করার কোনো সুযোগ নেই। এ ফলাফল প্রার্থী, তাদের এজেন্ট, ও অন্যদের কাছেও আছে। ইসির ভূমিকা নিয়ে আলমগীর বলেন, নির্বাচন কমিশন তো সরাসরি পরিচালনা করে না, পরিচালনা করে রিটার্নিং অফিসার। তিনি কেন্দ্র ঠিক করেন, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। কেন্দ্রে ফলাফল ঘোষণা করেন প্রিজাইডিং অফিসার, এ ফলাফলটাই চূড়ান্ত। কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসার যে ফলাফলটা পড়েছেন, সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে সবার সামনে পড়ে শোনান (রিটার্নিং কর্মকর্তা)।
বেসরকারি ঘোষণার পর আরও প্রক্রিয়া শেষ করে সরকারিভাবে ঘোষণা করেন, এটাই চূড়ান্ত। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, চূড়ান্ত ফলাফল কমিশনে পাঠিয়ে দেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এরপর গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপরও কেউ যদি মনে করেন যে এখানে ভুল কিছু আছে, আস্থার অভাব আছে, তাহলে ইসির ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে। এরপর সেটা পছন্দ না হলে আপিল ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে। এরপর মহামান্য আদালত আছে, উচ্চ আদালত আছে। ইভিএমে বাতিল ৩১৯ ভোট: ঘোষিত ফল অনুযায়ী ৩১৯টি ভোট বাতিল হয়েছে। তবে ইভিএমে ভোট বাতিলের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী দাবি করেছেন, ব্যালটের মতো ইভিএমেও ভোট বাতিল হতে পারে। তিনি বলেন, পুরো নির্বাচনে ৩১৯টি ভোট বাতিল হয়েছে। কোনো ভোটার সাদা বোতাম না চেপে পর পর দুইবার লাল বোতাম চাপলে ভোট বাতিল হয়। তখন স্ক্রিনে লেখা আসে ভোটার কোনো প্রার্থী নির্বাচন করেননি। অর্থাৎ ভোটটি বাতিল হয়েছে। কাগজের ব্যালটে সিল না মেরে বক্সে ফেললে যেমনটা হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, নির্বাচনে মোট দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০ ভোটার ছিলেন। এরমধ্যে এক লাখ ৩৫ হাজার ৬৪টি ভোট পড়ে। বাতিল হয় ৩১৯ ভোট। ভোট পড়েছে ৫৮.৭৪ শতাংশ।