বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী’। এই কথাটির আরেকটি রূপ যেন দুর্লভ লাল সোনাইল বা ক্যাসিয়া জাভানিকা । প্রথম দেখাতেই যে কেউ প্রেমে পড়বে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ফুটে থাকা গোলাপি ও গাঢ় লাল রঙের এই ফুলের। শুধু সৌন্দর্য নয়, ফুলটির রয়েছে নানাবিধ ঔষধি গুনাগুনও।
লালমাই পাহাড়ের উঁচু নিচু টিলা আর পাহাড়ের কোলে অবস্থিত লালমাটির ক্যাম্পাসে প্রচণ্ড খরতাপে স্বস্তির সুবাতাস দিচ্ছে লাল সোনাইলের মুগ্ধতা। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখ পড়বে ফুলটির দিকে। দেখলেই মনে হবে যেন ছড়ানো-ছিটানো পাতার মাঝে কেউ ছাতা ধরে গোলাপি-সাদা বর্ণের ফুল নিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। অদৃশ্য এক প্রশান্তি নিয়ে একমুহূর্তের জন্য হলেও থমকে দাঁড়াবে যে কেউ।
২০২২ সালে কুবি বিএনসিসি প্লাটুনের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নার্সারি থেকে গাছগুলো সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন রাস্তার দু’পাশে বিরল প্রজাতির লাল সোনাইল গাছের ২০টি চারা রোপণ করা হয়। দুই বছরের মধ্যে গাছগুলোতে ফুল ফোটে।
ফুলটির বাংলা নাম লাল সোনাইল। ফুলটির বৈজ্ঞানিক নাম ক্যাসিয়া জাভানিকা ( Cassia Javanica )। এটি ফবাসেই ( Fabaceae ) পরিবারের একটি উদ্ভিদ। আদি ভূমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হলেও বেশি জন্মায় বিশ্বের উষ্ণ অঞ্চলগুলোয়। গোলাপি ও গাঢ় লাল রঙের জন্য ফুলটি জনপ্রিয়। এটির ফুল, পাতা ও গাছের গড়ন বেশ নান্দনিক। অল্পবয়সি গাছগুলো দেখতে ছাতার মতো। লাল সোনাইলের পোষাকী নাম পিংক ক্যাশিয়া বা পিংক শাওয়ার। এ ফুল গ্রীষ্মে ফোটে। গাছ দ্রুত বর্ধনশীল, মাঝারি আকৃতির, ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মাথা ছড়ান, পত্রমোচী, যৌগপত্র ১-পক্ষল, ১৫ থেকে ৩০ সেমি লম্বা, পত্রিকা ১৬ থেকে ২৮টি, মসৃণ ও ৩ থেকে ৫ সেমি লম্বা।
ক্যাসিয়া জাভানিকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জোবায়ের বলেন, ক্লাসে যাওয়ার পথে যখন ক্যাসিয়া জাভানিকার গাছগুলোর নিচ দিয়ে হাঁটি, মনটা অনেক হালকা হয়ে যায়। গাছভরা লাল-গোলাপি ফুল দেখে মনে হয়, যেন কেউ রঙতুলি দিয়ে পুরো ক্যাম্পাসটাকে সাজিয়ে দিয়েছে। এমন শান্ত আর রঙিন পরিবেশ আমাদের প্রতিদিনের ব্যস্ত রুটিনেও একটু প্রশান্তি এনে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা অনেক সময় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দর ছবিগুলো দেখি, কিন্তু এখন মনে হয় আমাদের ক্যাম্পাসও কোনো অংশে কম না। ক্যাসিয়া জাভানিকার সৌন্দর্য শুধু চোখে ভালো লাগে না, বরং ভেতর থেকে এক ধরনের ভালোলাগার অনুভব তৈরি করে। বন্ধুরা সবাই মিলে প্রায়ই ছবি তুলি, সেলফি তুলি, স্মৃতির মতো ধরে রাখার জন্য। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন সবসময় টিকে থাকে, এটাই চাওয়া।”
শিক্ষার্থী ফাহমিদা সুলতানা বলেন, “ক্যাম্পাসের ক্যাসিয়া জাভানিকার ফুলগুলো দেখলে সত্যি মন জুড়িয়ে যায়। গরমের এই সময়ে যখন চারপাশ ধুলো আর রুক্ষতায় ভরা থাকে, তখন এই ফুলগুলোর লালচে গোলাপি আভা এক অন্যরকম সজীবতা এনে দেয়। ক্যাম্পাসের পথে হাঁটতে গিয়ে যখন গাছগুলোর দিকে তাকাই, মনে হয় যেন প্রকৃতির এক অসাধারণ চিত্রকর্ম দেখছি। প্রতিটি ফুল যেন আলাদাভাবে সেজে আছে। এই দৃশ্য আমাদের পড়াশোনার চাপ আর ক্লান্তি অনেকটা কমিয়ে দেয়। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের ক্যাম্পাস জীবনকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। ”
সৌন্দর্যের পাশাপাশি নানা ভেষজ উপকারিতা রয়েছে ক্যাসিয়া জাভানিকার। কোষ্ঠকাঠিন্য, কোলিক, ক্লোরোসিসের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হতো প্রাচীনকাল থেকেই। উদ্ভিদটির পাতা হারপিস সিমপ্লেক্সের (হারপিস সিমপ্লেক্স হলো একধরনের ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট ভাইরাল সংক্রমণ) বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখে এবং এর ছাল বা বাকল আয়ুর্বেদিক ও অন্যান্য ঐতিহ্যগত ওষুধের অ্যান্টিডায়াবেটিক ফরমুলেশনের অন্যতম উপাদান। পাশাপাশি এর ছাল ব্যবহার করা হয় ট্যানারি শিল্পে।