বিশ্বকাপ ফুটবলের উম্মাদনা ও মহিউদ্দিনদের যাপিত জীবন – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

সমালোচকদের চোখে মুখে কালি মেখে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে রোববার (২০ নভেম্বর) শুরু হয়েছে বিশে^র সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কাতার বিশ^কাপ ফুটবল ২০২২। মুসলিম বিশে^র ইতিহাসে এবারই প্রথম বিশ^কাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা বিশে^র কোন মুসলিম দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আর ৩২ দল নিয়ে খেলা এটিই সর্বশেষ বিশ^কাপ ফুটবল। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বিশ^কাপ থেকে ৪৮টি দল খেলায় অংশ নিবে।
এই কাতার বিশ^কাপের আয়োজন নিয়ে পশ্চিমা বিশ^ শুরু থেকেই নেতিবাচক কথা বার্তা বলে আসছিল।রোববার বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে দিয়ে কাতার পশ্চিমা বিশ^কে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে। অবশ্য এর একদিন আগেই শনিবার(১৯ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো পশ্চিমা বিশে^র কড়া সমালোচনা করে তাদের ভন্ড বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি ফিফা বস খুবই কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে বলেছেন, ইউরোপ আর পশ্চিমা বিশ্ব এখন অনেক কিছু শেখায়। গত ৩ হাজার বছর ইউরোপিয়ানরা বিশ্বজুড়ে যা করেছে, তাতে মানুষকে নীতিকথা শোনানোর আগে আগামী ৩ হাজার বছর তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।’
আমি মনে করি একজন অভিভাবকের যে সময় ভূমিকা রাখার প্রয়োজন ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো ঠিক সেই ভূমিকায় রেখেছেন। তিনি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়ে কাতারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন । তাঁর এই দৃঢ় অথচ সাবলীল সত্য উচ্চারণ এবারের বিশ^কাপ সফল সমাপ্তিতে ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মন্তব্য করেছেন।

ফুটবল পাগল জাতি হিসেবে আমাদের একটি সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে নব্বই দশকের ঊষালগ্ন পর্যন্ত আমাদের দেশে ফুটবলের যে উম্মদনা ছিল তা আর এখন নেই। আমাদের দেশ যেমন আওয়ামীলীগ – বিএনপিতে দুই ভাগে বিভক্ত, বর্তমানে ফুটবল বিশ^কাপ যেমন আর্জেন্টিনা – ব্রাজিলে বিভক্ত ঠিক তেমনি আবাহনী মোহামেডানে বিভক্ত ছিল আমাদের এই প্রিয় ফুটবল পাগল বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের পৃথক দুটি গ্যালারী ছিল আবাহনী ও মোহামেডানের সমর্থকদের জন্য। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে দেখেছি, যে দিন আবাহনী মোহামেডানের খেলা ছিল সেদিন টিফিনের পর স্কুল কলেজ খালি হয়ে যেত। এখনকার মত তখন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার তেমন প্রচার ছিল না। সবেধন নীলমনি ছিল বিটিভি। তাও সাদা কালো। রঙিন টিভি ছিল খুবই কম। একটি গ্রামে বড় জোড় ২টি বা ৩টি সাদা কালো টিভি থাকত। যাদের বাড়িতে টিভি ছিল তারা খেলার দিন উঠানে টিভি ছেড়ে দিত। আর আশে পাশের পাড়া প্রতিবেশী এমন কি ভিন্ন গ্রামের লোকজন এসেও টিভিতে খেলা দেখত। যেহেতু তখন ডিশ ছিল না তাই এন্টিনা ঠিক করার যে কি যন্ত্রণা ছিল এই প্রজম্মের তরুণরা তা বুঝবে না।

আমি ছোট বেলা থেকেই আবাহনীর সমর্থক ছিলাম। আবাহনী – মোহামেডান করতে গিয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে কত যে মারামারি করেছি আর এর রেশ ধরে ঘরে এসে মাইর খেয়েছি তার কোন হিসেব নেই।
ঢাকার মাঠের পর পর চার বার সেরা গোলদাতা হয়েছিল আবাহনী তথা জাতীয় দলের স্টাইকার শেখ মোহাম্মদ আসলাম। সম্ভবত এই রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেনি। তিনি হেডে চমৎকার সব গোল করতেন। আমি ছিলাম আসলামের খুব ভক্ত। একদিন মোহামেডানের সাথে কর্ণার কিকের একটি হেড আসলামের লক্ষভ্রষ্ট হয়। এর দুই মিনিট পর খেলার শেষ বাঁশি বেজে উঠে। আর আবাহনী হেরে যায়। সেদিন যে কত কেঁদেছিলাম আহা! সে কথা ভাবতেই আজ অবাক লাগে। ফুটবলের কত পাগল ছিলাম আমরা। অথচ আজ ফুটবল আমাদের হারানো সোনালী অতীত। এখানে সংযুক্ত হয়েছে ক্রিকেট। যাক এসব প্রসঙ্গে অন্য এক পর্বে আলোচনা করব।
বিশ^কাপ ফুটবল জ¦রে ভাসছে গোটা বাংলাদেশ। আবাহনী, মোহামেডান কিংবা আওয়ামীলীগ, বিএনপির মতই এখন আমাদের দেশে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের উম্মদনা চলছে। বিভিন্ন ডিজাইনের ও প্রকারভেদে তৈরী পতাকা, জার্সির ব্যাপক ব্যবহারের সাথে চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাক্যুদ্ধ। আমি মনে করি যেহেতু ফুটবল আমাদের প্রিয় খেলা তাই স্বাভাবিক ভাবেই এটি আমাদের সেরা বিনোদনের একটি অংশও। তাই আমরা আমাদের নিজ নিজ দলকে সাপোর্ট করব, আনন্দ নিব, দিব । অন্য দলকে খোঁচা দিয়ে মজা নেব সব ঠিক আছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, খোঁচাটা যেন অতিরঞ্জিত না হয়ে উঠে। শালিনতা, সভ্যতা ভব্যতার সীমা যেন আমরা অতিক্রম না করি। ভিন্ন দেশের একটি দলকে আমি বিনোদন নেয়ার জন্য সমর্থন করতে পারি মানসিক প্রশান্তির জন্য, কিন্তু কোন ভাবেই যেন ভিন্ন দেশের সমর্থনের কারণে নিজ দেশে আমরা হানাহানির শিকার না হই।
২০ নভেম্বর শুরু হয়েছে সব কিছু ঠিক থাকলে তা আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালের মধ্যে দিয়ে শেষ হবে। দীর্ঘ এক মাস ফুটবল আমাদের আনন্দ দিবে, আনন্দ নিব। কিন্তু সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত কোন অবস্থাতেই আমরা যেন সীমা অতিক্রম না করি এই বিষয়ে সকলের আবারো সতর্ক দৃষ্টি কামনা করছি।

গত ১৮ নভেম্বর শুক্রবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পৌরসভার রামরায় যাই ভায়রা ভাইয়ের প্রবাসী ছেলে কামাল হোসেন নিকনের বরযাত্রী হিসেবে। বয়সটা বেশী না হলেও সম্পর্কে যেহেতু আমি মুরুব্বী তাই এই ধরনের অনুষ্ঠান গুলোতে এটা মেইনটেইন করতে হয়। তাই বরযাত্রার অন্য মেহমানদের খাওয়ার পর আমরা কয়েকজন খেতে বসলাম। আমাদের টেবিলের যিনি ওয়েটার ছিলেন তার নাম হলো মহিউদ্দিন মজুমদার। বুঝতে পারছি হালকা বকশিশের আসায় সে খুব খাতির যত্ম করে খাওয়াতে লাগল। যেহেতু আমাদের পড়ে আর খুব একটা মেহমান নেই তাই খোস মেজাজেই খাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে আমি তাকে বললাম, আচ্ছা মহিউদ্দিন বিশ^কাপ ফুটবলে তুমি কোন দলকে সাপোর্ট কর। আমাকে বোকা বানিয়ে এবং টেবিলের সবাইকে অপ্রস্তুত করে সে বলে উঠল আচ্ছা স্যার, বলেন তো , এই আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল করলে কি আমাদের ভাত দিব নি। হঠাৎ করে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল তার পুরো মুখায়ব। মাহফুজ মিয়া নামের আরেকজন ওয়েটারকে সাক্ষী রেখে বলল, স্যার, আমি রিক্সা চালাই। এক্সিডেন্ট করে পায়ে খুব ব্যাথা পাইছি। তাই কয়েক দিন ধরে রিক্সা চালাই না। ঘরে চাল নেই। মাহফুজ মিয়া ডেকোরেটারে কাজ করে। তাকে অনুরোধ করে আজকের হাজিরা পাইবার আশায় এখানে আইছি। হাজিরা পাইলে বাচ্চার জন্য কাশের সিরাপ আর সবার জন্য চাল ডাল কিনব। মহিউদ্দিন দু:খ করে বললেন, স্যার জানেন, আমাদের এলাকার এক নেতা তার কর্মীদের জন্য কয়েক হাজার টাকা খরচ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের দুইশ’র উপর জার্সি কিনেছে। অথচ এই নেতাকে বললাম, ভাই, ঘরে চাউল নাই, এক্সিডেন্ট করে রিক্সা চালাতে পারি না। কিন্তু তিনি আমাকে একটি টাকা তো দিলেন না উল্টো মুখ ভেংচি করে বললেন, তুই তো আর আমার এলাকার ভোটার না। তোকে দিয়ে আমার কি লাভ । সরকারী হাসপাতালে যা। পা ঠিক করে রিক্সা চালিয়ে চাল কিন।

থামছে না মহিউদ্দিনের কথা। সে আরো বলতে চায়। থামাতে চেষ্টা করেও পারলাম না। সে বলে চলল, আচ্ছা স্যার, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশে দুর্ভিক্ষ আসবে। আমরা সবাই হিসাব করে চলতাম। বিশ^কাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে এই যে জার্সি কিনার উৎসব করছে মানুষ এটা কি আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল হবে। জানতে চাইলাম তুমি কি অর্থনীতি বুঝ। সে জানাল, দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। আপনাদের মত না বুঝলেও বুঝতে পারি দেশের অর্থনীতি ভালো না। মানুষের ঘরে খাবার নেই। বাজারে গেলে কয়েক দোকান খুঁজে খোলা আটা কিনতে হয়।আগের থেকে রিক্সা ভাড়া বেশি নিয়েও তিন বেলার খাবার যোগাতে পারি না। আর আমাদের দেশের এক শ্রেণীর মানুষ আর্জেন্টিনার আর ব্রাজিলের জার্সি কিনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করছে। এটা কি অপচয় না। সরকার কি বলতে পারে না ভিন্ন দেশের জার্সি আর পতাকা না কিনে এই টাকা গরিবদের দাও। বুঝজেন স্যার, এই পৃথিবীতে গরিবদের জন্য কেউ নেই।

ইতিমধ্যে আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন বিয়ে পড়াবে। তাই নিচে বরের কাছে যাওয়ার তাড়া আসছে। সামান্য একটু বকশিশ দিয়ে যেই না চেয়ার থেকে উঠব ঠিক এমন সময় মহিউদ্দিনের শেষ আর্তি, স্যার সত্য করে বলেন তো দেশের অবস্থা কেমন। আমরা যে আর চলতে পারছি না। গত দুই মাস ধরে ছেলে মেয়েদের তিন বেলা খেতে দিলেও আমরা জামাই বউ কিন্তু দুই বেলা খাই। কারণ, আয় নাই।কিনব কিভাবে। আর পারছি না। বর্তমান অবস্থা চললে না খেয়ে মারা যাব স্যার ।

আল্লাহ আল্লাহ কর, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে, এই কথা বলেই ছাদে তৈরী প্যান্ডেল থেকে নিচে নেমে এলাম। আর মনে মনে বেশ কিছু প্রশ্ন আসতে লাগল। সত্যিই কি মহিউদ্দিনরা না খেয়ে মারা যাবে। বর্তমান অর্থনৈতিক অচলাবস্থা আর কত দিন থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি কবে কমবে। এই প্রশ্নের সকল উত্তর দেয়ার একমাত্র মালিক সরকার। শেষ বিচারে সরকারের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া মহিউদ্দিন মজুমদারদের আর্তি শোনার আপাতত আর যে কেউ নেই।

লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক,দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও সাধারণ সম্পাদক,বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি,কুমিল্লা জেলা,০১৭১১-৩৮৮৩০৮।