বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করছেন হত্যা, ধর্ষণ মামলার আসামি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা

মহিউদ্দিন মাহি ।।
প্রকাশ: ১১ মাস আগে

দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার অনৈতিক ও সংঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও প্রতারণাসহ বিভিন্ন মামলা রয়েছে। তিনি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহি। শাখা ছাত্রলীগের আগামী কমিটিতে তিনি নিশ্চিতভাবেই সভাপতি হচ্ছেন এমনটি দাবি করে ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার করার অভিযোগ উঠেছে। তার সহিংস কর্মকাণ্ডে হেনস্তার শিকারও হয়েছেন সাংবাদিকরা। তাঁদেরকে জীবননাশের হুমকিও দিয়েছেন তিনি। তাঁর হুমকি ধামকির পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে মধ্যরাতে ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। সহিংস বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা।
জানা যায়, ২০১৫ সালে রেজা-ই-এলাহিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৭ সালে বিলুপ্ত হয় তাঁর কমিটি। এরপর তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও পালা বদল হয়েছে অন্তত চার বার। ইতোমধ্যে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক বয়সও শেষ হয়েছে রেজার। শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স বর্তমানে ৩১। আর ছাত্রলীগের সংগঠনে অন্তর্ভূক্ত থাকার বয়সসীমা সর্বোচ্চ ২৯।
রেজা-ই-এলাহি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বাড়তে থাকে অপকর্ম। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে দেশীয় মরণাস্ত্র ও আগ্নোয়াস্ত্র জড়ো করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৬ সালের ১ আগস্টে ওই হলে ছাত্রলীগের বিবাদমান দুই পক্ষের অন্তঃকোন্দলে নিহত হন কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ সাইফুল্লাহ। এ হত্যা মামলায় চার্জশীটভূক্ত আসামি রেজা-ই-এলাহি। হত্যাকাণ্ডের পর তার হল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। আর মামলার এজাহারে তাকে পলাতক দেখায় পুলিশ।
২০২০ সালের ৮ মার্চ রেজার এলাকা বরুড়ার তালুকপাড়া গ্রামে এক নারীকে ধর্ষণ চেষ্টা, ভাংচুর, জালিয়াতি ও লুটতরাজের অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় কুমিল্লার নারী ও শিশু দমন বিশেষ ট্রাইবুনাল-২ এ রেজাকে এক নম্বর আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ বিষয়ে মামলার বাদী ফাতেমা বেগমের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার সাথে যা কিছু হয়েছে আল্লাহই তার বিচার করবে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রেজা-ই-এলাহির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা শাহ আলম তাঁর কাছে পাওনা ছয় লাখ টাকা না পেয়ে থানায় অভিযোগ করেন। এ বিষয়ে গত বছরের ১৫ মার্চ কুমিল্লার বরুড়া থানায় অভিযোগ দায়েরকারী শাহ আলম বলেন, ‘আমি টাকা না পেয়ে নিরুপায় হয়ে থানায় অভিযোগ করেছি। রেজা এখনো আমার সব টাকা দেয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, এতসব অভিযোগ ও মামলার আসামি হয়েও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রেজা-ই-এলাহি। বয়সোত্তীর্ণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র না হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ের রাজনীতি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করছেন তিনি। গত বছরের ১ অক্টোবর শতাধিক বহিরাগত নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ফাঁকাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ করেন রেজা-ই-এলাহি। সর্বশেষ গত ২৯ মে ইংরেজি বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর মধ্যকার মারামারির ঘটনার খবর সংগ্রহ করতে গেলে একটি জাতীয় দৈনিকের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রুদ্র ইকবালকে হেনস্তা করেন তিনি। এরপর ‘গুন্ডামির কী দেখছে’, ‘সাংবাদিকরা এখনো আমাকে চেনে না’, ইত্যাদি বলে সংবাদকর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি দেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা। এরপর ওই দিন ক্যাম্পাসে সংবাদকর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তার নেতৃত্বে মিছিল হয়। গত ৩১ মে ক্যাম্পাসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ব্যানারে মানববন্ধন ও মিছিল করেন রেজা ও তার অনুসারীরা। এতে ভূক্তভোগী সাংবাদিকের ছবি ব্যবহার করা হয়, হুমকি দেওয়া হয় জীবননাশের হুমকি।
তবে হত্যা মামলার বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে রেজা-ই-এলাহি বলেন, ‘ধর্ষণ মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। আমি বিশ^বিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি কিংবা কোনো সাংবাদিক হেনস্তা করিনি।’
বয়সোত্তীর্ণ হওয়ার পরও ছাত্রলীগের সভাপতি পদপ্রার্থীর হওয়ার বিষয়ে রেজা বলেন, ‘করোনার কারণে বয়স শিথিল করা হয়েছে।’
এসব বিষয়ে কথা বলতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল ও খুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন ও ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীও প্রতিবেদকের ফোনকলের সাড়া দেননি।