ব্রাহ্মনবাড়িয়া -২ : উপ নির্বাচনে আওয়ামী মডেল

সময়ের কড়চা :
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

১ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনসহ দেশের ৭টি সংসদীয় আসনে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের ইতিহাসে এই উপ নির্বাচন হবে এক নতুন মডেল। সমালোচকরা অবশ্য এটিকে উপ নির্বাচন আওয়ামী মডেল হিসেবেও অভিহিত করেছে।

এ নির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা ও সাবেক এমপি-মন্ত্রী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন তিনজন প্রার্থী। যদিও প্রধান প্রতিদ্বন্ধি বিএনপির সাবেক নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদকে ২৭ জানুয়ারি থেকে নির্বাচনী এলাকার কোথাও প্রচারণায় দেখা যায়নি। এর আগে তার নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়কারী ও শ্যালককে একটি সাজানো মামলায় গ্রেফতারের অভিযোগ করা হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। প্রার্থী আসিফের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার রাত থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তাঁরা। তিনি কি নিজেই নিখোঁজ রয়েছেন , না কি তিনি নিখোঁজ হলে নির্বাচনে সুবিধা পেতে পারেন দলছুট সাত্তার এমন কোন পক্ষ তাকে নিখোঁজ করেছেন এই লেখা লেখা পর্যন্ত এর সঠিক তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও পারছে না কোন হদিস দিতে। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী আসিফের পক্ষের লোকেরা দ্বিতীয়টির পক্ষেই মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

এই উপ নির্বাচনকে কেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন উপ নির্বাচনের আওয়ামী মডেল । তার বিশ্লেষন করে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের পর গত ৫০ বছরে এই আসনে আওয়ামীলীগ কখনোই বিজয়ী হতে পারেনি। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে তাদের দলীয় ৭ জন প্রার্থী সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষনা দেন। পরবর্তী পর্যায়ে এই ৭ জন স্পীকারের কাছে আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ করেন সরকারের পদত্যাগের দাবী জানিয়ে। যার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের এমপি উকিল আবদুস সাত্তারও একজন। পরে বিএনপির শূণ্য আসন গুলোতে উপ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা হলে বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে উকিল আবদুস সাত্তার উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং অংশ গ্রহন করেন। যদিও বিএনপি তাকে এই সিদ্ধান্তের পর পরই বহিস্কার করে।

বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তারের উপ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষনার সাথে সাথেই মানুষ বলাবলি করতেছিল সরকারি টোপেই নিজের বর্ণ্যাঢ্য ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিয়ে শেষ সময়ে এসে চরিত্রে কালিমা লেপন করলেন প্রবীন রাজনীতিবিদ উকিল আবদুস সাত্তার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দলছুট উকিল আবদুস সাত্তারকে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের একটার পর একটা সিদ্ধান্ত এমন ভাবে মাঠে কার্যকর হচ্ছে যে, এখন আর মানুষ এটাকে শুধু টোপ হিসেবে মেনে নিচ্ছে না। আরো এক ধাপ এগিয়ে বলছেন , ব্রাহ্মনবাড়িয়া উপনির্বাচন আওয়ামীলীগের নতুন মডেল।
কারণ,ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের সামনে সুবর্ণ সুযোগ ছিল গত অর্ধশত বছর ধরে হারানো আসনটিকে ফিরে পাওয়ার। কিন্তু আওয়ামীলীগ সেই সুযোগটি গ্রহন তো করেই নি , এমনকি দলের যে সকল সম্ভাব্য প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার জন্য মনোননয়ন পত্র জমা দিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেকের মনোনয়ন প্রভাব খাটিয়ে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধার মনোনয়নটিও প্রত্যাহারের নেপথ্যে ভুমিকা রাখেন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ। বলে রাখা ভালো, আওয়ামীলীগ এখানে তাদের দলীয় প্রার্থী পর্যন্ত ঘোষনা করেননি। অর্থাৎ, আওয়ামীলীগ এখানে উকিল আবদুস সাত্তারের বিজয় পথে যাতে নূন্যতম কাঁটা না পড়ে তার সব ব্যবস্থাই দলছুট সাত্তারের আস্থাভাজন কর্মী হিসেবে নিরলস ভাবে করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির দলছুট নেতা বয়োবৃদ্ধ উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে জেতানোর দায়িত্ব আওয়ামীলীগ কেন কাঁধে নিল ? বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা শুধু সাত্তার ভুইয়ার জন্য নিজ দলের সম্ভাব্য এমপি হওয়ার মত ত্যাগী নেতাদের কোরবানীই দেয়নি, কোন রকম রাখ ঢাক না রেখে , লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে প্রকাশ্যে সব ধরনের ‘মেকানিজম’ বা সর্বশক্তি নিয়োগ করে দলছুট সাত্তারকে জেতানোর জন্য মহান (!) দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। এজন্য ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনী এলাকায় পাঠিয়ে সাত্তারের কলারছড়ি প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জনগনকে অনুরোধ করে বলেছেন, আপনারা কলারছড়িকে নৌকা মনে করে ভোট দিন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, আওয়ামীলীগ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে দুটি ম্যাসেজ দিতে চাচ্ছেন। এর একটি হচ্ছে, বিএনপি যদি ভালোয় ভালোয় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান সরকারের অধীনে না যেতে চায় তাহলে উকিল আবদুস সাত্তারের মত এমন লোকদেরকে দল থেকে বের করে এনে স্বতন্ত্র কিংবা অন্য কোন নামে প্রার্থী করা হবে। আর অপর ম্যাসেজটি হচ্ছে, যারা বিএনপি ছেড়ে সরকারের ফাঁদে পা দিবে তাদেরকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে উপ নির্বাচন ব্রাহ্মনবাড়িয়া মডেলের মত কাজ করবে আওয়ামীলীগ। অর্থাৎ, তুমি শুধু বিএনপি ছেড়ে নির্বাচনে এসো,আর তোমাকে এমপি বানানোর মহৎ কাজটি করবে আওয়ামীলীগ। মানে, এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেষ্টা করছে আওয়ামীলীগ ব্রাহ্মনবাড়িয়া উপ নির্বাচন মডেল দিয়ে।

আওয়ামীলীগ যে ভাবে প্রশাসনকে ব্যবহার করে উকিল আবদুস সাত্তারকে সুবিধা করে দিচ্ছে, ইচ্ছে করলে একই পদ্ধতি ব্যবহার করে সাত্তারকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নিয়েও যেতে পারতেন। কিন্তু ঐ যে উপরে বলেছি, দুটি ম্যাসেজ তারা বিএনপিকে দিতে চাচ্ছে। এই মডেলের মাধ্যমে উপ নির্বাচন হয়েছে এবং উকিল সাত্তার বিজয়ী হয়েছে এই দৃশ্যপটও দেখানোর চেষ্টা আছে।
এখন দেখার বিষয়, সরকারের ব্রাহ্মনবাড়িয়া উপ নির্বাচন মডেল কৌশল আগামী নির্বাচনে কতটুকু কাজে লাগে। সময়ই তা বলে দিবে । রাজনীতি সব সময় সমরেখা দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। কখনো কখনো রেখা পরিবর্তন, পরিমর্ধন ও পরিমার্জন হতে পারে। কিন্তু গত প্রায় পনের বছর ধরে পত পত করে ক্ষমতার আকাশে উড়তে থাকা আওয়ামীলীগের জন্য এই উড়া অব্যাহত থাকবে, না কি এবার থামবে তা ভবিষ্যতই ভালো বলতে পারবে। আমরা আম জনতা শুধু দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।
০১৭১১-৩৮৮৩০৮
৩১.১.২৩