বিশ্বায়নের এই প্রবল স্রোতে ইংরেজি আজ বিদেশি ভাষা বা যোগাযোগের মাধ্যমটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মহাসাগরে ডুব দেওয়ার প্রধানতম হাতিয়ার, বিশ্বকে জানার জানালা এবং ভিন্ন সংস্কৃতির গভীরে প্রবেশের এক শক্তিশালী সেতুবন্ধন। আর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে, শান্ত ও সবুজে ঘেরা লালমাই পাহাড়ের কোলে অবস্থিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ বিগত দেড় যুগ বছর ধরে এই ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনকে সফলভাবে ধারণ করে চলেছে।
২০০৭ সালের ৬ মে মাত্র দুই জন শিক্ষকের প্রাধান্যতায় যাত্রা শুরু করা এই বিভাগটি দেখতে দেখতে পার করে দিয়েছে দেড় যুগ। আঠারো বছরের এই পথচলা খুব মসৃণ ছিল না। এই পথচলায় এসেছে নানা চ্যালেঞ্জ, তবে সেসব অতিক্রম করেই বিভাগটি নিজস্ব এক স্বকীয়তা অর্জন করেছে। নিজস্ব একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।
বিভাগের মূল উদ্দেশ্য হলো ভাষা ও সংস্কৃতির নিবিড় সম্পর্ককে অনুধাবন করানো। এখানকার পাঠ্যক্রম প্রণীত হয়েছে এই দর্শনের উপর ভিত্তি করে। কেবল ব্রিটিশ বা আমেরিকান সাহিত্যের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকেনি। শেক্সপিয়রের কালজয়ী সৃষ্টিকর্ম থেকে শুরু করে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সাহিত্যিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো এখানে পড়ানো হয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শুধু ইংরেজি ভাষার বিভিন্ন রূপভেদ ও প্রকাশভঙ্গির সাথেই পরিচিত হয় না, বরং ভিন্ন ভিন্ন সমাজ, তাদের ইতিহাস, জীবনবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করে। ঔপনিবেশিকতা এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটের সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শেখে কীভাবে ভাষা ক্ষমতা, পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক সংঘাতের সাথে জড়িত। এই বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা তাদের মননকে প্রসারিত করে এবং বিশ্ব নাগরিক হিসেবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।
বিভাগের এই ১৮ বছরের পথচলা এবং ভাষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের দর্শন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিভাগটির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. এম. শরীফুল করিম বলেন, ” ভাষা ও সাহিত্যের মেলবন্ধনের কাঠামোতে আমাদের শিক্ষা কারিকুলাম ঢেলে সাজানো। আমাদের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মননশীল করে তোলা, যাতে তারা ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখে। আমরা আমাদের কারিকুলামে সমকালীন নোভেল প্রাপ্ত লেখকদের সাহিত্য সংযুক্ত করেছি। এর ফলে শুধু প্রাচীন নয়, বর্তমানের বিভিন্ন দোশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও শিক্ষার্থীরা জানতে পারছে।”
শিক্ষার্থীদের একাডেমিক কার্যক্রম ছাড়াও তাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভাগ সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশ, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহজ যোগাযোগ এই বিভাগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা শোনা, তাদের পরামর্শ দেওয়া এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন স্টুডেন্ট এডভাইজর।
বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক এবং তাদের সার্বিক বিকাশে ভূমিকা নিয়ে বিভাগের স্টুডেন্ট এডভাইজর সহকারী অধ্যাপক তারিন বিনতে এনাম বলেন, “আমরা চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে, যেখানে তারা মুক্তভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে। পাঠ্যক্রমের বাইরেও বিতর্ক ক্লাব, সাহিত্য ক্লাব এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে আমরা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে এবং তাদের ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সাহায্য করি। ভাষা শেখার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরি হয় তাদের মধ্যে, যা তাদের আরও মানবিক ও সচেতন করে তোলে।”
বিভাগের এই পরিবেশ এবং শিক্ষাদান পদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীর কাছে কেমন লাগে? এ বিষয়ে বিভাগের একজন বর্তমান শিক্ষার্থী হিসেবে ফারিহা জাহান তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এইভাবে, “আমি যখন এই বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন ইংরেজি বলতে কিছুটা ভয় পেতাম। কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারলাম ইংরেজি শুধু একটা ভাষা নয়, এটা আসলে মানুষের মনের ভাবনা আর সংস্কৃতির একটা অসাধারণ প্রকাশ। আমাদের শিক্ষকরা শুধু পড়ানই না, তারা আমাদের গাইড হয়ে পথ দেখান। বিভিন্ন দেশের সাহিত্য পড়ে, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে আমার দৃষ্টিভঙ্গি অনেক প্রসারিত হয়েছে। মনে হয় আমি শুধু কুমিল্লাতেই নেই, আমি যেন পুরো বিশ্বের সাথে যুক্ত হয়ে গেছি।”
১৮ বছরের পথচলায় বিভাগটি সমৃদ্ধ করেছে তার অবকাঠামোকেও। আধুনিক শ্রেণিকক্ষ, সেমিনার লাইব্রেরী এবং বইয়ের বিশাল সংগ্রহ শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের পথকে আরও সুগম করেছে।
তবে এই বিভাগের ১৮ বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো এর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। আজ তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা, প্রশাসন, কর্পোরেট জগত, গবেষণা – সর্বত্রই তারা তাদের দক্ষতা ও মননের পরিচয় দিচ্ছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অর্জিত ভাষা ও সংস্কৃতির জ্ঞান তাদের শুধু ভালো চাকরি পেতেই সাহায্য করেনি, বরং মানুষ হিসেবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি করেছে প্রসারিত, তৈরি করেছে সংবেদনশীলতা এবং ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি দিয়েছে সম্মান।
ভাষা ও সংস্কৃতির এই মেলবন্ধনের চর্চা একাডেমিক গণ্ডি পেরিয়ে বিস্তৃত হয়েছে সহশিক্ষা কার্যক্রমেও। বিভাগীয় ক্লাবগুলো বছরব্যাপী আয়োজন করে সাহিত্য আড্ডা, কবিতা পাঠের আসর, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, সেমিনার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এসব আয়োজনে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে তাদের ভাষাগত দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। নাটকের মঞ্চায়ন বা সাহিত্য আড্ডার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা করে এবং নিজেদের সাংস্কৃতিক বোধকে সমৃদ্ধ করে। বিভাগের নিজস্ব দেয়াল পত্রিকা বা ম্যাগাজিনে শিক্ষার্থীরা তাদের সৃষ্টিশীল লেখা প্রকাশের সুযোগ পায়, যা তাদের লেখকসত্তাকে জাগিয়ে তোলে।
১৮ বছর পেরিয়ে এসে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ আজ অতীতের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলেছে। ভাষা ও সংস্কৃতির এই মেলবন্ধনকে তারা শুধু ধারণই করছে না, বরং এটিকে আরও বিকশি