লাইলাতুল বারাআতের গুরুত্ব ও করনীয়-বর্জনীয় আমল সমূহ

লেখক : মাওলানা মেহেদি হাসান
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

লাইলাতুল বারাআত হলো হিজরী শাবান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাত। এ মাসটি সম্মানিত ও বরকতময়। এ মাসেই রমযান মাসের আগমনের খোশবার্তা বিশে^র মুসলমানদের দিয়ে যায়, যাতে তারা রমজান মোবারকের জন্য প্রস্তত হতে পারে। লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআতের রাতের মর্যদা নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক কথা প্রচলিত। এ রাতে অনেক মুসলমান বিশেষ ইবাদতে মগ্ন থাকেন। ওয়াজ-নসীহত, মীলাদ-মাহফিল, বিশেষ মুনাজাত, কবর যিয়ারত, তাবারুক বিতরণ, রুটি-হালুয়া, এবং বিশেষ নামাজ পড়ে থাকেন। এ আমল সমূহ কুরআন-সুন্নাহের আলোকে কতটুকু নির্ভরযোগ্য তা নির্ণন করা দরকার।

কুরআন ও হাদীসে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআত
লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআত শব্দগুলো মহা গ্রন্থ পবিত্র কুরআন ও হাদীসে কোথাও পাওয়া যায়নি। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগেও এরকম শব্দের ব্যবহার হয়নি। কিন্তু লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআত এ রাতকে হাদীসের পরিভাষায় লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো (শাবান মাসের মধ্য রজনী) ।
লাইলাতুল বারাআত শব্দ দুইটি আরবী এর অর্থ হলো ক্ষমার রজনী আর শবে বারাআত হলো শব শব্দটি ফার্সী বারাআত শব্দটি আরবী। শব শব্দের অর্থ রাত বা রজনী বারাআত হলো ক্ষমা ।
বারাআত শব্দটিকে অনেকে বরাত বলে থাকেন। সহীহ উচ্চারণ হলো বারাআত এটিই প্রসিদ্ধ মত এর অর্থ হলো ক্ষমা করা বা মুক্তি পাওয়া, লাইলাতুল বারাআত একত্রে অর্থ হলো ক্ষমার রজনী ।
লাইলাতুল বারাআতের আমল ও নাম নিয়ে বিভিন্ন আলেমদের মাঝে ভিন্নতা রয়েছে, হযরত আশরাফ আলী থানভী (র) তার তাফসীর গ্রন্থ বায়ানুল কুরআনে এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত উল্লেখ করেছেন।
শাব্বীর আহমাদ উসমানী (র) তার তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরে ফাওয়ায়েদে এ রাতকে শবে বারাআত নাম লিখেছেন।
রাসূল (সা.) এ রাতের নামকরণ করেছেন, (নিসফি মিন শাবান) ”মধ্য শাবানের রাত”

লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআত প্রসঙ্গে হাদীস
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন: যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণন করেন। অতঃপর তার বান্দাদের মধ্য থেকে শিরকে জড়িত অথবা নিজের ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ পেষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।
আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন: এক রাতে আমি নবী করীম (স.) কে বিছানায় না পেয়ে তার খোঁজে বের হলাম। আমি জান্নাতুল বাকি নামক কবর স্থানে তাকে আকাশের দিকে মাথা রাখা অবস্থায় দেখলাম। তিনি বলেন, হে আয়েশা তুমি ধারণা করছো যে আল্লাহ ও তার রাসূল তোমার প্রতি যুলুম করেছেন? আয়েশা (রা) বলেন, আমি তা ধারণা করিনি। তবে আমি মনে করেছি আপনি হয়তো অপর কোন স্ত্রীর কাছে গমন করেছেন। আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের মধ্য রজনীতে পৃথিবীর নিকটতম আকাশে অবর্তীণ হন, অতপর কালব্ গোত্রের মেষপালের পশমগুলোর চেয়েও অধিক সংখ্যক লোকদের ক্ষমা করেন।
তিরমিযী ও ইবনে মাযা শরীফে হাদীসটি বর্নণা করা হয়েছে। অপর বর্ণনায় আছে, আমি তাকে বাকী আল-গারকাদে গিয়ে তাকে মুমিন নারী-পুরুষ ও শহীদদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায় পেলাম।
আবু মুসা আল আশআরী (রা) বলেন, রাসূল সা. বলেছেন: মধ্য শাবানের রাতে ১৪ শাবান দিবাগত রাতে আল্লাহ তাআলা উদ্বাসিত হন এবং তার সমস্ত সৃষ্ঠিকে ক্ষমা করেন, হিংসুক, অংশীবাদী পৌত্তলিক, আত্মহত্যাকারী ছাড়া।
ইবনে মাযা,পৃ ৯৯ মিশকাত শরীফ ১১৫
হযরত আনাস (রা) বর্ননা করেন, রজব মাস এলে রাসূল (স.) এ দোয়াটি পাঠ করতেন: হে আল্লাহ আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন এবং আমাদের রমযান মাস পর্যন্ত পৌছে দিন।
(বায়হাকী, মেশকাত শরীফ পৃ:১২১)
উপরে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছি! তার মান নিয়ে কিছু মুহাদ্দিসীনে কেরাম দূর্বল মনে করেছেন। কিন্তু হাদীসের যে আমল ও শাবান মাসের ফজীলত তার বিরুদ্ধে কোন অকাট্য দলিল পাওয়া যায়নি। বরং হাদীসের আমল সমূহের উপর কুরআন হাদীসের দলিল পাওয়া যায়।
এ রাতে করনীয় আমল সমূহ: এ রাতে রাসূল (স.) বিশেষ কোন নিয়মে ইবাদত করেননি এবং সাহাবাদের করতে বলেননি। কিন্তু এ রাতের আমল নিয়ে হাদীসের আলোকে যেসব আমল পাওয়া যায় তা সবই নফল ইবাদত। আমাদের সমাজে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআতের রাতে ইবাদত নিয়ে উৎসাহ উদ্দিপনা রয়েছে তা অনেকে ফরজ ইবাদতের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যা কোন ভাবেই ঠিক না। আমাদের উচিত লাইলাতুল বারাআত সহ সকল ফজীলত পূর্ণ দিন-রজনী, দিবস ও ইসলামিক উৎসব উৎসাহে মুসল্লিদের মৌলিক ইবাদতের প্রতি আকৃষ্ট করা। নফল ইবাদত তার জন্য ! যিনি মৌলিক ইবাদত করেন ও ইবাদতের মর্ম বুঝেন। লাইলাতুল বারাআত বা শবে বারাআতের রজনীতে বা যে কোন সময়ে রহমত-মাগফিরাত লাভের জন্য যা করা দরকার।
ক্স শিরক, কুফর ও নিফাক মুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান * ইখলাসের সাথে রাসূল (স.) কে জীবনের সব ক্ষেত্রে অনুসরন করা * শিরক মুক্ত জীবন * হালাল পন্থায় উপার্জন * হালাল খাবার গ্রহণ * হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকা * * বেশি বেশি নফল সালাত-সাওম করা * তাওবা ইস্তিগফার করা । এ বিষয়গুলো আমল করতে পারলে নিসফে মিন শাবান বা যে কোন সময়ই মহান আল্লাহ তাআলা তার বান্দা দের প্রার্থনা বা দোয়া কবুল করতে পারেন ।

এ রাতে বর্জনীয় আমলসমূহ:
ক্স মসজিদ, মাদরাসা, বাসা বাড়ি, কবরস্থান আলোকসজ্জায় সজ্জিত না করা * এ রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় গোসল করাকে ফজীলতপূর্ণ মনে না করা * এ রাতকে কেন্দ্র করে বিভেদ তৈরি না করা * এ রাতকে খাওয়া দাওয়া ও উৎসবের রাতে পরিণত না করা * এ রাতকে ভাগ্য রজনীর রাত মনে না করা * নফল ইবাদতকে ফরজের সমকক্ষ/ বেশি গুরুত্ব না দেওয়া * এ রাতে আনন্দ উল্লাশ, আতশবাজি না করা।
মুমিনদের জীবনে প্রতিটি সময়ই প্রতিটি রাতই গুরুত্বপূর্ণ ! কথাটি অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক হলেও ১০০ ভাগ সত্য।
মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে নবী ! আমার বান্দারা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং তার ডাকে সাড়া দেই। সূরা আল-বাকারা-১৮৬
কোন ব্যক্তি অন্যায় বা যুলুম করার পর নিজেকে সংশেধন করে তাওবা করলে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। সূরা আল মায়েদা-৩৯
রাসূল (স.) বলেছেন, প্রতি রাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে নেমে বলেন, আমি রাজাধিরাজ, আমিই রাজাধিরাজ। আমাকে ডাকার কেউ আছে কি? আমি তার ডাকে সাড়া দিব। আমার কাছে চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে প্রদান করবো। আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করবো। সকালের আভা উঠা পযর্ন্ত এভাবে বলতে থাকেন। বুখারী শরীফ-১১৪৫
সর্বোপরি বলতে চাই শুধু লাইলাতুল বারাআত, লাইলাতুল কদর, রমজান, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহার রজনীই নয়! ক্ষমার জন্য, মাগফিরাতের জন্য, মহান আল্লাহ তাআলার প্রিয় বান্দা হওয়ার জন্য। এখনই নিজেকে পবিত্র করুণ, ক্ষমা প্রর্থনা করুন, গুনাহমুক্ত জীবনের জন্য আল্লাহ তাআলার সাহায্য কামনা করুণ। মহান আল্লাহ সুবহানা ওয়া-তাআলা আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অন্তর্ভুক্ত করুণ। আমীন