১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে শরণার্থীদের নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের রচিত ৩য় গ্রন্থ ‘শরণার্থীদের যুদ্ধ জীবন : ১৯৭১’ বইটির পাঠ পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিকালে কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্রের মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।বিশ্লেষণ আলোচনা চক্রের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলেয়মান।
বিশ্লেষণ আলোচনা চক্রের আহবায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক দুলালের সভাপতিত্বে ও ব্যাংক কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন রনির সঞ্চালনায় আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন,বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড.আলী হোসেন চৌধুরী ও দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা। অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা আলোচনা করেন সান মেডিকেল সার্ভিসেস’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.আবদুল লতিফ ও বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক বদরুল হুদা জেনু। গ্রন্থ থেকে অংশ বিশেষ পাঠ করেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক রুবেল কুদ্দুস ও কলেজ শিক্ষক শামীম আরা ইসলাম। অনুভূতি প্রকাশ করেন ‘শরণার্থীদের যুদ্ধ জীবন : ১৯৭১’র লেখক সাংবাদিক শাহাজাদা এমরান।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জন্য একটি বড় বিষয়। মুক্তিযুদ্ধে যারা তখন প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছে, তাদের জন্য এটা বড় বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের আগামীর পথ চলার প্রাথমিক পাথেয়৷ আমরা যারা আগামীতে নিজেকে দেশ গঠনে নিয়োজিত রাখবো আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শরণার্থীরা নিজেদের সব ফেলে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে, মানুষ তাদেরকে যেভাবে সাহায্য করেছে এগুলো আমাদের জন্য প্রেরণা। শরণার্থীদের তখনকার সময়ে কি পেল আর কি পেল না সেটা নিয়ে কোনো আক্ষেপ না থাকলেও, স্বাধীনতার ৫০ বছরে তারা কি পেলো সেটা নিয়ে আক্ষেপ রয়ে গেছে তাদের। বৈষম্য দূর করতেই আমরা কিছুদিন আগে জুলাই আগষ্ট বিপ্লব দেখলাম। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও আমাদের দেশের বৈষম্য দূর হয় নি। ‘শরণার্থীদের যুদ্ধ জীবন : ১৯৭১’ গ্রন্থটি আমাদেরকে আগামীতে এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা যোগাবে। সাংবাদিক শাহাজাদা এমরানের লেখা শরণার্থীদের যুদ্ধজীবন বইয়ের অনেকগুলো প্রবন্ধে আমি দেখেছি শরণার্থীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্বীকৃতি চেয়েছে। আমার কথা, তাদেরকে স্বীকৃতি চাইতে হবে কেন। আমি বইটির লেখক শাহাজাদা এমরানকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি শরণার্থীদের সেই কষ্টের দিনগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমি আশা করবো, শরণার্থীদের নিয়ে৷ আগামীতে যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে কাজ হয়। এই বইটির মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি অঙ্গ শরণার্থীদের নিয়ে আমাদের একটি নতুন যাত্রা হবে বলে আমরা মনে করি।
আলোচক হিসেবে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আলী হোসেন চৌধুরী বলেন, এই গ্রন্থটির প্রণেতা শাহাজাদা এমরানকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবো। এটা চিন্তা করা যায় না, ৫০ বছর পরে এসে শরণার্থীদের কথাগুলো কেউ তুলে ধরেছেন। এই বইটি পড়লে চোখের সামনে ৭১ ভেসে উঠে। শাহাজাদা এমরানের লেখনীতে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আমাদের। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার শরণার্থীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই কাজগুলো যে শাহাজাদা এমরান করেছে, আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি গর্বিত যে, আমাদের ইতিহাসের একটি অংশকে সে নাড়া দিয়েছে। পানিতে যেমন ঢিল ফেললে পানি নড়ে, তেমনি শাহাজাদাও আমাদের ইতিহাসের একটি অংশকে নাড়া দিয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের জীবনের কথাগুলো সে খুবই সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছে। এখানে আমরা কোনো ভুল নয় বরং বিষয়গুলো দেখবো। প্রায় হারিয়ে যাওয়া জিনিসগুলো শাহাজাদা তার এই গ্রন্থটিতে তুলে ধরেছেন। বইটিতে যদি শরণার্থীদের দুঃখ বেদনা, তারা কিভাবে শরণার্থী শিবিরে দিন কাটিয়েছিলো সেই ভিতরের কথাগুলো তুলে আনতে পারলে আরো ভালো হতো। তারপরেও বলবো, শাহাজাদা এমরান কাজটা শুরু করে দিয়েছে, এখন বাকিটা করবে সরকার। এমন দুঃসাহসী কাজ করার জন্য, আমি শাহাজাদা এমরানকে আবারো প্রশংসার সাথে ধন্যবাদ জানাই।
দৈনিক শিরোনাম সম্পাদক নীতিশ সাহা বলেন, আমি প্রথমে শাহাজাদা এমরানকে দেখেই আজ বলেছিলাম একটি চমৎকার কাজ হয়েছে। আমি নিজেও শরণার্থী ছিলাম। আমি তখন ছোট ছিলাম। আমি যখন ক্লাস ফোর এ পড়ি তখনকার স্মৃতি মনে পড়েছিলো আমার এই বইটি পড়ে। শরণার্থীরা বইটি পড়লে তাদের অতীত মনে পড়বে। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ জীবন নিয়ে আমাদের দেশে অনেকে বই লিখলেও শরণার্থীদের যুদ্ধ জীবন নিয়ে কেউ তেমন বই লিখে নি। শাহাজাদা এমরান যে বইটি লিখেছে, সেটাতে শরণার্থীদের লড়াই করার বিষয়টি উঠে এসেছে। তাদের ত্যাগ তিতিক্ষার বিষয়টি উঠে এসেছে। শরণার্থীরা হচ্ছে পরবর্তী মুক্তিযোদ্ধা৷ বইটিতে ৬৩ জন শরণার্থীদের যুদ্ধজীবনের কথা উল্লেখ করেছেন লেখক। বইটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী হয়েছে। শরণার্থীদের নিয়ে এভাবে খুব কমজনই বই লিখেছেন। শাহাজাদা প্রচুর পরিশ্রম করেছে এই বইটির জন্য। এজন্য শাহাজাদা ও তার সহধর্মীনীকে ধন্যবাদ জানাই৷ শাহাজাদা যে কাজটি করেছে তা ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখা উচিৎ। এই বইটি লেখার মাধ্যমে সে একটি মহান দায়িত্ব পালন করেছে। সবার অবশ্যই এই বইটি পড়া উচিৎ। বইটিতে যে টাইটেলগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে শরণার্থীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহবানও জানিয়েছে লেখক। আমরাও যদি লেখক শাহাজাদা এমরানের কণ্ঠের সাথে কণ্ঠ মেলাই তাহলে শরণার্থীদেরকেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হতে পারে।
সভার সভাপতির বক্তব্যে বিশিষ্ট ছড়াকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল হক দুলাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩টি পক্ষ ছিলো। পাকিস্তানী বাহিনী, গেরিলা বাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। শাহাজাদা এমরান যখন বইটি লিখলো তখন আমি বইটি পূঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়েছিলাম। বইটি পড়ার পর আমি বুঝলাম, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আমরা অবহেলা করেছিলাম। আমি শাহাজাদা এমরানকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি বই আমাদের সামনে আনার জন্য।
এর আগে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে ‘শরণার্থীদের যুদ্ধ জীবন ১৯৭১ বইটির লেখক শাহাজাদা এমরান বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ৩ বছর পরের প্রজন্ম। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও, তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহায়তা করেছিলেন। আমি আমার বাবার কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গল্প শুনতাম। সেই গল্পগুলো শুনা থেকেই আমার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহ জাগে। কুমিল্লার অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে গিয়ে আমি দেখেছিলাম তাদের মাথার উপর থাকার চালও নেই। সেটা নিয়ে আমি একটি বইও লিখেছিলাম, ২০১৪ সালে, নাম রণাঙ্গনের বীর। এরপর আমি কাজ করি বীরাঙ্গনাদের নিয়ে । ২০১৭ সালে বের হয় বীরাঙ্গণার কথা। পরে কাজ করার আগ্রহ জাগে শরণার্থীদের নিয়ে। আমি যখন শরণার্থীদের সাথে কথা বলেছিলাম, তখন মনে হলো, শরণার্থীদেরও মুক্তিযুদ্ধে অনেক ভূমিকা রয়েছে। পরে, শরণার্থীদের নিয়ে লেখার সময় করোনা শুরু হয়েছিলো। সেই করোনার ঝুঁকি নিয়েও আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি তাদের কথাগুলো তুলে আনার জন্য।
শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করার জন্য আমি সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব দিবো আমার জীবনবন্ধু স্কুল শিক্ষিকা জাহেরা আক্তারকে। তার আন্তরিক সহায়তা না থাকলে হয়তো আমার দ্বারা এই কাজটি করা সম্ভব হতো না। আগামীতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার আরো কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। সবাই আমাকে সহায়তা করবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।
অনুষ্ঠানে কুমিল্লার কুমিল্লার বিভিন্ন পেশার নাগরিকগণ উপস্থিত ছিলেন।