সে দিন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাই : মোশারফ হোসেন

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -৭
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ১ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সকাল থেকে কুমিল্লা ছিল থমথমে। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাসা-বাড়ির লোকজনও বাহিরে তেমন একটা বের হতো না। তখন আমাদের নেতা ছিল, কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি (প্রয়াত) অধ্যাপক খোরশেদ আলম, আদর্শ সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান (প্রয়াত) অধ্যক্ষ আবদুর রউফ এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত এড. আফজল খান। তাদের নির্দেশনা ছিল, যে কোন সময় যে কোন ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা যেন শহরের আশেপাশে থাকি। রাতে যখন কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে শহর আক্রমণ করার জন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা আসছে এই খবরে আমরা কুমিল্লা শহরে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। রাতে পাক বাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স আর রামমালায় আনসার ক্যাম্পে আক্রমণ করে। আমরা ঐ তিন নেতার নেতৃত্বে কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করি।
২৬ মার্চ ভোরে কিছুটা অন্ধকার থাকতে বানাশুয়া ব্রিজ দিয়ে গোমতী নদী পাড় হয়ে বাড়ি যাব, এমন সময় দেখি রাস্তার পাশের আখ ক্ষেতে একজন কাতরাচ্ছে আর তাকে ঘিরে আছে আরো দুই জন। কৌতুহল বশতঃ আমি কাছে গিয়ে দেখতে পাই, সে কুমিল্লা পুলিশের একজন হাবিলদার আবদুর রহমান। ময়মনসিংহ তার গ্রামের বাড়ি। পাশের দুই জন পুলিশ কনস্টেবল ছিলেন। রাতে পাকিস্তানী বাহিনী কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে তখন পালিয়ে আসার সময় সে হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়। তার পায়ে গুলি লাগে। সিপাহী দুজন হলেন আবদুল কুদ্দুছ এবং হবিগঞ্জের জব্বার। এই তিনজনকে নিয়ে আমি মাঝিগাছা কাজির বাড়িতে যাই। সেখানে গিয়ে গোলদার বাড়ির ডা. হাবিবুর রহমানকে আনলে তিনি জানান, তার কাছে সিলি করার মত কোন কিছুই নেই, আমরা যেন ডা. জুলফুর কাছে নিয়ে যাই। দ্রুত ডা. জুলফু তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেন দক্ষিণ গ্রামের আমার ভগ্নিপতি ডা. সেকান্দার হায়াতের কাছে। পরে ডা. সেকান্দার তার চিকিৎসা করেন।
ডা. সেকান্দারকে মুক্তিযুদ্ধ করার কথা বললাম। আমি যেহেতু আনসার সদস্য ছিলাম সুতরাং দুলাভাই জানত আমার প্রশিক্ষণের খুব একটা দরকার নেই। ২৭ মার্চ রাতে তিনি দক্ষিণ গ্রামের রাজ্জাক মাস্টারকে খবর দিয়ে এনে আমার সাথে পরিচয় করে দিয়ে বলেন, আমার শ্যালক যুদ্ধ করতে চায়। সে আনসার বাহিনীতে আছে, অস্ত্র চালাতে পারদর্শী। রাজ্জাক মাস্টার কিছুক্ষণ আমার সাথে কথা বললেন। যাওয়ার আগে বলেন, প্রস্তুত থেকো, যেকোন সময় ডেকে নেব।
পরে ১০ এপ্রিল আমি ফোর ব্যাঙ্গলের সাথে ভারতের মতিনগরে সম্পৃক্ত হই। মতি নগরে তখন কমান্ডার ছিলেন ২নং সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম ।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
যেহেতু প্রশিক্ষিত আনসার সদস্য ছিলাম , তাই প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেই।

যুদ্ধের অণুপম গল্প :
যুদ্ধের অণুপম গল্প বলতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন বলেন, সারা দেশে সংগঠিত ভাবে যুদ্ধ শুরুর আগেই আমরা যুদ্ধ শুরু করি। ২৮ মার্চ ভোরে রাজ্জাক মাস্টার এসে আমাকে বললেন, দ্রুত চল আজ যে কোন সময় পাঞ্জাবীরা শংকুচাইল ইপিআর ক্যাম্প দখল করতে আসবে। এই ক্যাম্পে প্রায় সবাই বাঙ্গালী এবং অস্ত্রও আছে প্রচুর। যেকোন মূল্যে তাদের বাঁচাতে হবে। পরে আমাকে রাজ্জাক মাস্টার ঘিলাতলা দিঘির পাড় নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর অবসর প্রাপ্ত সেনা, পুলিশ, বিডিআর, আনসার, মুজাহিদ ও অসংখ্য ছাত্র দেখতে পাই। সেখানে উপস্থিত সবার সাথে কথা বলে রাজ্জাক মাস্টার সিদ্ধান্ত নেন, যে কোন ভাবে শংকুচাইল ইপিআর ক্যাম্পের বাঙ্গালী লোকদের বাঁচাতে হবে এবং আমরা এখনি প্রতিরোধ গড়ে তুলব। এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক যে, তখনো কিন্তু সারা দেশে সংগঠিত ভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি।
এই পর্যায়ে আমি বেশ সাহসের সাথে রাজ্জাক ভাইকে বললাম, রাজ্জাক ভাই, আমার কাছে হাতিয়ার আছে এবং আমি হাতিয়ার চালাতে প্রস্তুত, যদি আপনি অনুমতি দেন। তিনি জানতে চাইলেন, হাতিয়ার তুমি কোথায় পেয়েছ। আমি বললাম, আহত পুলিশ সদস্যরা হাতিয়ার নিয়ে কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের হাতিয়ারগুলোই এখন আমার কাছে আছে। হাতিয়ার তিনটির মধ্যে ছিল, একটি এলএমজি ও দুটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল গুলিসহকারে। পরে তিনি আরো কয়েকটি দু’নালা ও এক নালা বন্দুক সংগ্রহ করে আনে।
পাকিস্তানী বাহিনী ঘুর্ণাক্ষরেও কল্পনা করেনি যে, এখানে আমরা তাদের প্রতিরোধ করব। তারা স্বাভাবিক গতিতে আসতে লাগল। তারা যখন শংকুচাইল ক্যাম্পের কাছাকাছি চলে এল, ঠিক তখনি তারা কিছু বুঝে উঠার আগেই আমরা বাহির থেকে এলোপাতাড়ি ফায়ার করা শুরু করি। ফলে এখানে বেশ কয়েকজন পাক সেনা নিহত হয় এবং আহত হয় আরো বেশী। নিহতদের মধ্যে ছিল, আলাতিতা খান, সের খান, জব্বার খান, গুলজার খান, আজিজ খান। পরে বাকীরা পিছু হটলে আমরা নিহতের মাটি চাপা দিয়ে রাখি। এটাই ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রথম এবং সফল যুদ্ধ।
আরেকটি যুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৫ এপ্রিল ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম আমাদেরকে বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের পাঁচোরা নামক গ্রামে পাঠিয়ে দেন ডিফেন্স করার জন্য। এই ডিফেন্সের কমান্ডার ছিলেন ইপিআর নায়েক আমিন আর টুআইসি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কোরের সৈয়দ নাজির। এই ডিফেন্সে আমাদের সৈনিকদের মধ্যে ছিলাম, আমি, জয়দুল, ইব্রাহিম, নুরুসহ ১৫/২০ জন সদস্য। নানা কারণে এই ডিফেন্সটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই ডিফেন্স থেকে এক দিকে যেমন কুমিল্লা সেনানিবাস কাছে অপর দিকে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও একেবারে লাগোয়া। এই ডিফেন্সে প্রায় খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ লেগেই থাকত। এ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ননজালা ক্যাম্প, গাজিপুর ক্যাম্প, শশিদল ক্যাম্প সহ বিভিন্ন ক্যাম্পে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেই এবং আমি অনেক পাকিস্তানের সৈনিককে হত্যা করি।
কুমিল্লা মুক্ত হওয়ার ৫দিন আগের আরেকটি যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত অভিযানে অংশ নেবার জন্য লে. মালেকের নেতৃত্বে ১৮১ জনের একটি বাহিনী নিয়ে আমরা একাধিক নৌকা যোগে দাউদকান্দি থেকে ঢাকায় রওয়ানা হই। যখন মেঘনার মানিকারচর সংলগ্ন এলাকায় আসি, তখন দেখতে পাই পাকিস্তানী বাহিনীর একটি গানবোট আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এসময় আমরা সবাই বাঁচার আশা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ, মেঘনা নদীর মাঝখানে সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনীর গানবোটের সাথে কিছুতেই আমরা পেরে উঠব না। আমাদের নেতা লে. আবদুল মালেক ওয়ার্লেসের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সহায়তা চাইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম, আমাদের মাথার উপর যুদ্ধবিমান এসে উপস্থিত। তারা সরাসরি পাকিস্তানী বাহিনীর গানবোটটির মধ্যে প্রচণ্ড এক আঘাত করল। আমরা লক্ষ্য করলাম বিকট শব্দে হানাদার বাহিনীর গানবোটটি একেবারে পানির নিচে চলে গেল। ইতিমধ্যে আমাদের বহনকারী নৌকাগুলো নদীর দুই দিকে তীরের কাছে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেদিন সম্ভবত সময় ছিল সকাল ১০টা। মিত্রবাহিনীর যুদ্ধ বিমান যদি আর ১৫ থেকে ২০ মিনিট পড়ে আসত তাহলে আমাদের আর কারোরই বেঁচে থাকা হয়তো সম্ভব ছিল না।

পরিচয় : মো. মোশারফ হোসেন। পিতা- মৃত. আফসার উদ্দিন মুহুরী, মাতা- আমেনা বেগম। ১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার গোয়ালপট্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তার অবস্থান চতুর্থ। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে ঢাকা কোহিনুর ক্যামিকেল কোম্পানী (তিব্বত কোম্পানী)তে আনসারের চাকুরী নেন মোশারফ হোসেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। ভাষণ শুনে যুদ্ধে যাবার মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলন। ৮ মার্চ তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। এরপর বিভিন্ন কারণে তার বেশ কিছু দিন ঢাকায় যাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে চলে এলো ২৫ মার্চের কালো রাত। শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। তিনিও চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে।