৫১ বছরেও মিলেনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কিশোরী শর্মার

স্বামী স্বর্গে, আমার স্বীকৃতি মর্গে
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ১ বছর আগে

বয়স ৮৫ বছর।১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর গুলিতে বাম হাত বিদ্ধ হয়। সেই ক্ষত বহন করছেন আজো।বার্ধক্যসহ নানা রোগে শোকে একাকার তার জীবন। চলতে পারেন না একা। জীবন সঙ্গি ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গি প্রিয় স্বামী গত হয়েছেন প্রায় ৮ বছর আগে। অসুস্থতা আরো দানা বেঁধে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সাথে নিত্য সঙ্গি হিসেবে রয়েছে অভাব অনটন। স্বামী পরিত্যক্তা একমাত্র মেয়েও রয়েছে সংসারে। সবেধন নীলমণি উপার্জনক্ষম ছেলেটিও বছর চারেক আগে ট্রেন দূর্ঘটনায় মারা যান। অভাবের মহাসমুদ্রে সাঁতরিয়েও ব্যক্তিত্ব বির্সজন দিতে রাজি নন। বললেন, বাবা, এক বেলা খাওয়ার পর দ্বিতীয় বেলা খেতে পারব কি না জানি না। তারপরেও বলছি, আমার টাকার দরকার নেই। প্রয়োজনে না খেয়ে মরব। তবুও যেই দেশের জন্য যুদ্ধ করে , যারা যুদ্ধ করেছে তাদের সহযোগিতা করে পাকিস্তানিদের বন্ধুকের গুলিতে আহত হয়ে চির দিনের জন্য পঙ্গু হলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধুক বানিয়ে আর মেরামত করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলাম সেই দেশের সরকার কি আমাদের স্বামী স্ত্রীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারে না। স্বীকৃতির জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে গত ৮ বছর আগে মারা যান স্বামী অরুন প্রসাদ শর্মা। ৮৫ বছর আমার বয়স। আমিও মৃত্যুর পথে। কত অমুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযোদ্ধা হলো অথচ আমরা স্বামী স্ত্রী রয়ে গেলাম স্বীকৃতির বাহিরে। বিক্ষুদ্ধ কন্ঠে কথা গুলো বলেই চোখের পানি ছেড়ে দিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কিশোরী রানী শর্মা।

গত ৩ ডিসেম্বর দুপুরে কুমিল্লা নগরী থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে আঁকা বাঁকা পথ পেরিয়ে কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার ১নং বিজয়পুর ইউনিয়নের মধ্যম বিজয়পুর গ্রামে গিয়ে আমরা কথা বলি এই বীর নারীর সাথে। এ সময় সাথে ছিলেন দৈনিক আমাদের কুমিল্লার স্থানীয় প্রতিনিধি শাহ ফয়সাল কারীম ।
কিশোরী রানী শর্মা। পিতা হাবুলাল ধোপা ও মাতা শমরিয়া ধুপির দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে কিশোরী শর্মা সবার ছোট। ১৯৩৭ সালের ৬ মে কুমিল্লা নগরীর বাদুরতলায় তিনি জন্মগ্রহন করেন। পড়াশুনা করেন ফরিদা বিদ্যায়তনে। সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর অভাবের সংসারে আর পড়াশুনা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ষাট দশকের শুরুতেই বিয়ে করেন কুমিল্লা নগরীর মোগলটুলি এলাকার শিবু প্রসাদ শর্মার ছেলে অরুণ প্রসাদ শর্মাকে। স্বামী অরুণ প্রসাদ শর্মার পৈত্রিক ব্যবসা ছিল বন্ধুক বিক্রি এবং তৈরী করা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পুলিশ লাইনসহ সারা কুমিল্লা শহরে অতর্কিত ভাবে পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ করলে রাতের মধ্যেই শহর শূন্য হয়ে পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। পরদিন ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । শহর থেকে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা আওয়ামীলীগ নেতারা অরুণ প্রসাদ শর্মার কাছে তার দোকানে থাকা অস্ত্রগুলি চায় । ২৮ বা ২৯ মার্চ লোক মারফত কিছু অস্ত্র দেন এবং পুরাতন বন্ধুক ঠিক করে দেন কঠোর গোপনীয়তায়। কিন্তু গোপন খবর আর গোপন থাকেনি। জেনে বাসায় অভিযান চালায় ৭১ সালের কুমিল্লা শহরের সাধারণ মানুষের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত ক্যাপ্টেন বোখারী। অরুণ প্রসাদ শর্মা তখন বাসায় ছিলেন না। বলে যান বাসায় এলে যেন বোখারী সাহেবের সাথে দেখা করেন। এই খবর পেয়ে রাতেই ( সম্ভবত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে) স্ত্রী কিশোরী রানী শর্মা ও ৯ বছর বয়সের একমাত্র পুত্রকে নিয়ে গোমতী নদী হয়ে চলে যান ভারতের উদয়পুরে।

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুরে গিয়ে প্রথমে কয়েক দিন চাচা শ^শুরের বাসায় থাকেন স্বামী,সন্তানসহ কিশোরী শর্মা । এর কিছুদিন পর চলে যান উদয়পুর ক্যাম্পে। এপ্রিলের মধ্যভাগে একদিন উদয়পুর শরণার্থী ক্যাম্পে দেখা হয় কুমিল্লার মেজর এনামের সঙ্গে। মেজর এনাম স্বামী অরুণ প্রসাদ শর্মাকে দেখেই বললেন, আরে অরুন তুমি এখানে। তোমাকে তো আমি খুঁজে বের করার জন্য কুমিল্লায় লোক পাঠিয়েছি। তুমি শরণার্থী ক্যাম্পে না, উদয়পুর আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে থাকবা। আমাদের বন্ধুক গুলি তুমি মেরামত করবা আর তোমার বউ আমাদের জন্য তিন বেলা রান্না করবে। পরে আমরা উদয়পুর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে যাই । দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই ছিলাম।

বয়সের ভারে একেবারেই নূহ্য ৮৫ বছর বয়সী বীর নারী কিশোরী রানী সরকার। কথা বলতে কষ্ট হয়। আটকে যায়। আগের মত স্মরণ শক্তি নেই। তাই দিন, তারিখ , স্থান ও নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের নামও বলতে পারেন না। শরীরের চামড়া গুলো আলগা হয়ে গেছে। চলতে হয় লাঠি ভর করে। তারপরেও জীবন থেকে বিস্মৃতি হতে যাওয়া অতীতের কথা গুলো বলতে চান কিশোরী শর্মা। তিনি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলে চললেন, আমরা থাকতাম উদয়পুর ক্যাম্পে। প্রতিদিন সকালে স্বামী উদয়পুর ক্যাম্পের অস্ত্রগুলি মেরামত করে চলে যেতেন বিলুনিয়া। ঐখানেও অস্ত্র মেরামতের দায়িদ্ব ছিল আমার স্বামীর উপর। ফিরতেন রাতে। আমাকে প্রায়ই সকালে ক্যাম্পে ভাত রান্না করে দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছে দিতাম মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।

মুক্তিযুদ্ধের কোন সুনির্দিষ্ট স্মৃতি মনে আছে কিনা জানতে চাইলে কিশোরী শর্মা বলেন, উদয়পুর ক্যাম্পে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের টিম ছিল। একেক দিন একেক সময় একেক টিম ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় যাইতো যুদ্ধ করতে। যদি কোন টিম অস্ত্র সংকটে পড়ত তাহলে আমার দায়িত্ব ছিল ভাতের পাতিলে করে উপরে ভাত নিচে ভাত রেখে মাঝখানে পলিথিনের ভিতর অস্ত্র রেখে সীমান্তে দিয়ে আসা। সীমান্তে যদি কোন কারণে পাকিস্তানি বাহিনী টহলে থাকে যাতে আমাকে সন্দেহ না করে এই জন্যই এই ব্যবস্থা করা।

একদিন গোমতী নদী এলাকায় ভয়াভহ যুদ্ধ হয়। অস্ত্র সংকটে পড়ে মুক্তিযোদ্ধারা। তাই কমান্ডারের মাধ্যমে খবর এলো আজ সন্ধ্যায় অপারেশন হবে। দুপুরের মধ্যে অস্ত্র পাঠাতে হবে। অস্ত্রের নাম মনে নেই। বড় এক ভাতের পাতিলে অস্ত্র ভরে মাথায় করে গোমতী নদী সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় যেই না পাড়া দিলাম সাথে সাথে পাকিস্তান আর্মির একটা গুলি আমার বাম হাতের কনুই এর উপর এসে লাগে। আমি মাটিতে গড়াগড়ি করতে করতে গোমতী নদীতে পড়ে যাই। আমি মরে নদীতে পড়ে গেছি ভেবে হানাদার বাহিনী আর এদিকে আসেনি। তখন গোমতী নদীতে ¯্রােত ছিল। আমি স্ত্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক দূরে চলে যাই। পড়ে শুনেছি, আমি নদীতে পড়ার পর ভেসে কোন দিকে যাই তা মনিটর করছিল মুক্তিযোদ্ধারা। হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর তারা আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় নদী থেকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে যায়। অপারেশন করে হাতের গুলি বের করে। হাসপাতালে যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার স্বামী ও ছেলে আমাকে ধরে কান্না করতেছে। সেদিন মেজর এনাম সাহেব আমার স্বামীকে বলেছিল , অরুণ, আমরা মাঠে গিয়ে যুদ্ধ করে দেশের জন্য যে অবদান রাখছি তুমি আর তোমার বউ তার চেয়ে অনেক বড় অবদান রেখেছ। আজ মেজর এনাম স্যারও নেই আর আমাদের অবদানের কথা বলারও কেউ নেই বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন কিশোরী শর্মা।

শফিক ভাই, রফিক ভাই ও শিরাজ ভাইসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বলে আর তাদের ঠিকানা বলতে পারছেন না কিশোরী শর্মা। শুধু এতটুকু বলতে পারেন, দেশ স্বাধীনের পর রফিক ভাই আমার স্বামীকে একটা কার্ড দিয়ে বলল, তোমরা যে মুক্তিযোদ্ধা ছিলা এই কার্ডে লেখা আছে। তালিকা করার সময় এটা কাজে লাগবে। যেহেতু আমার স্বামী শিক্ষিত ছিল না তাই এই কার্ডটি তেমন গুরুত্ব দিয়ে রাখেওনি। আমরা মনে করেছি, দেশের জন্য কাজ করেছি , দেশ স্বাধীন হয়েছে এটাই তো আমাদের প্রাপ্তি। কিন্তু যখন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির মর্ম বুজলাম তখন অনেক খুঁজেও সেই কার্ড পেলাম না।

আমার স্বামী মৃত্যুর আগে যে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কাজ করেছে তাদের অনেকের কাছেই গিয়েছিল কেন্তু কেউ তাকে সহযোগিতা করেনি। শুধু বলেছে, এখন এসো, তখন এসো। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পেয়ে আফসোস করে মারা গেল স্বামী আমার। আমার অবস্থা দেখছেন, যে কোন দিন আমিও মারা যাব। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেও ট্রেনে পড়ে মারা গেছে। স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে বাড়িতে।ছেলের বউ, নাতিরা আছে। তাদের নিয়ে কত কষ্টে বেঁচে আছি ভগবান জানেন।

বাম হাতটি দেখিয়ে বলেন, এই দেখেন পাকিস্তান আর্মির গুলিতে পঙ্গু হওয়া আমার হাতটি। দেশের জন্য স্বামী স্ত্রী এত কষ্ট করলাম অথচ, দেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম না। স্বামীর এখন আর স্বীকৃতির দরকার নেই। তিনি স্বর্গে চলে গেছেন। আমি আছি মরার মত মর্গে। যদি মরার আগে এক দিনের জন্য হলেও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতাম তাহলে মরে গিয়েও আমি শান্তি পেতাম,আমার স্বামীর আত্মাও শান্তি পেত।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কিশোরী শর্মার বিষয়টি জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিন উপজেলার নির্বাহী অফিসার শুভাশিস ঘোষ বলেন, কিশোরী রানী শর্মা ও তার স্বামীর বিষয়টি আমি অবগত। সংশ্লিষ্ট কাগজ সংরক্ষণ করতে পারেন নি বলে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান নি। আশা করবো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের স্বামী স্ত্রীর এই ত্যাগের বিষয়টি মূল্যায়ণ করবেন।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, আমাদের তিনটি তালিকার কোথায়ও তাদের নাম নেই। তারা যদি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয় বা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে গিয়ে প্রমান করতে পারে সেক্ষেত্রে তাদের নাম গেজেটে অর্ন্তভুক্ত হতে পারে।