৫ কোটি টাকা নিয়ে গায়েব ছাত্রলীগ নেতা

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

এক লাখ টাকা দিলেই এক সপ্তাহ পর সেই টাকার সঙ্গে দিতেন ১০ হাজার টাকা লাভ। দুই লাখে ২০ হাজার। যে যত বেশি টাকা দেবেন, তার লাভ তত বেশি। কাউকে বলেছেন স্বর্ণ, কাউকে বলেছেন জমির ব্যবসা, আবার কাউকে বলেছেন সিগারেটের ব্যবসায় লগ্নি করে এই টাকা লাভ হয়। এই লাভের ফাঁদে পড়েন দুই গ্রামের অন্তত ১৫ জন। তাদের থেকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন এক ছাত্রলীগ নেতা।

অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা শান্ত কুমার রায় (৩০) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বড়িকান্দি ইউনিয়নের থোল্লাকান্দি গ্রামের নির্মল রায়ের ছেলে। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে। দেখতে সুশ্রী-ভদ্র। ধর্মীয় আচার-আচরণ মেনে চলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতির পাশাপাশি সক্রিয় সদস্য ছিলেন ইসকনের (ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস)।

তবে গত শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) থেকে ছাত্রলীগ নেতা শান্তকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরই উন্মোচন হতে থাকে শান্ত রায়ের আসল পরিচয়। একে একে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত অন্তত ছয়টি অভিযোগ পড়েছে নবীনগর থানায়। এসব অভিযোগে শান্ত রায় ছাড়াও তার বাবা নির্মল রায়কে বিবাদী করা হয়েছে।

এর মধ্যে ওই ছাত্রলীগ নেতাকে শ্যামল চন্দ্র দাস ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ছগির আহমেদ ১২ লাখ, হক সাব ৪০ লাখ, আব্বাস উদ্দিন ২০ লাখ ৬০ হাজার, সুজন মিয়া ২০ লাখ, অক্লান্ত দেবনাথ ৩ লাখ টাকা দিয়েছেন বলে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছেন।

এছাড়া সাইমন স্টোরের মালিক মাহফুজুর রহমান তিন লাখ ৬ হাজার, ঢাকা কনফেকশনারির বাবুল মিয়া ১১ লাখ, জাহাঙ্গীর আলম ৩৯ লাখ, বিকাশ এজেন্ট আরিকুর রহমান রনি তিন লাখ, আরেক বিকাশ এজেন্ট মা টেলিকমের মালিক ওই ছাত্রলীগ নেতাকে ৮০ লাখ টাকা দিয়েছেন। তারাও লিখিত অভিযোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছেন।

সেইসঙ্গে শুভ বড়িকান্দি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি প্রার্থী জাহিদুল ইসলামের থেকে এক লাখ ও সলিমগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী রিফাত আহমেদের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শান্ত কুমার রায়ের বাবা নির্মল কুমার রায় পরিবার নিয়ে চট্টগ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু শান্ত গ্রামের বাড়ি নবীনগর উপজেলার বড়িকান্দিতে বসবাস করতেন। তিনি সবাইকে জানিয়েছেন, তার বাবা স্বর্ণের ব্যবসা করেন। শান্ত দীর্ঘদিন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি হতে চেষ্টা করেছিলেন। তাই জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সিনিয়র নেতাদের সান্নিধ্য পান। ফলে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতির বদলে এক লাফে জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন। শুধু তাই নন, পেয়ে যান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক পদও। এসব পদ-পদবীর কারণে অনেকেই তার আশপাশে থাকতেন।

ছাত্রলীগ নেতার পাশাপাশি তিনি পরিচয় দিতেন সিগারেট, স্বর্ণ ও জমি ব্যবসায়ী। তাই তার ব্যবসায় লগ্নির প্রস্তাব দিয়ে প্রথমদিকে পরিচিতদের আস্থা অর্জন করতে অল্প টাকায় অধিক মুনাফা দিতে শুরু করেন। কেউ এক লাখ টাকা দিলে তাকে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকাসহ ফেরত দিয়েছেন। কেউ ১০ লাখ টাকা দিলে এক লাখ টাকা লভ্যাংশসহ ফেরত দিয়েছেন। ব্যাংকের চেয়েও অধিক লাভ পাওয়ায় অনেকেই লোভে পড়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ তাকে দিয়েছেন। শর্ত ছিল কাওকে এই লাভের কথা বলা যাবে না। কিন্তু গত শনিবার থেকে শান্ত রায়ের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বের হয়ে আসে একে একে অনেক পাওনাদার। প্রায় পাঁচ কোটি টাকা নিয়ে এই ছাত্রলীগ নেতা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার খবরে উপজেলাজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়।

ছাত্রলীগ নেতা শান্তকে ৪০ লাখ টাকা দেওয়া হক সাব বলেন, শান্ত ও তার বাবা ব্যবসার কথা বলে আমার কাছ থেকে প্রায়ই টাকা নিতেন। আবার ফেরতও দিতেন। সবশেষ ৪০ লাখ নিয়েছেন। অন্য কারও থেকে টাকা নিতেন বলে আমার জানা ছিল না। এখন শুনতে পাচ্ছি, আমার মতো ৩০ থেকে ৪০ জনের থেকেও কয়েক কোটি টাকা নিয়েছেন।

সুজন মিয়া নামে এক যুবক বলেন, শান্ত আমার বন্ধু। তার বাবা চট্টগ্রামে সোনার ব্যবসা করেন। সোনা কেনার কথা বলে কয়েকদিনের জন্য আমার থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। টাকাগুলো আমি বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। গত শনিবার আমার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাত থেকে তার মোবাইলফোন বন্ধ আছে।

সলিমগঞ্জ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী রিফাত আহমেদ বলেন, তার সঙ্গে আমি দীর্ঘ ছয় বছর ছিলাম। দুইজনের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। আমার কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা নিয়েছেন সিগারেটের ব্যবসার কথা বলে। কিন্তু হঠাৎ তিনি গায়েব হয়ে গেলেন। এখন শুনি অসংখ্য মানুষ তার কাছে টাকা পান।

এ বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগ নেতা শান্ত কুমার রায় ও তার বাবা নির্মল রায়ের মোবাইলফোনে অনেকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

জানতে চাইলে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল হোসেন রুবেল বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শান্ত কুমার রায়ের বিষয়ে শুনেছি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। ঘটনা যদি সত্যি হয়, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে

নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুদ্দিন আনোয়ার বলেন, শান্তের বিষয়ে আমরা বেশকিছু লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।