স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, লাইসেন্স বাতিল হওয়ায় অস্ত্রগুলো এখন অবৈধ। এসব অস্ত্র উদ্ধারে সব জেলা পুলিশ সুপারকে (এসপি) চিঠি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে বলা হয়েছে। এসব অস্ত্রের বেশির ভাগ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও পাবনা জেলার।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ও প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করেন।
কখনো অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে পরে সেটিকে বৈধ অস্ত্র বলে দাবি করার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ সময় নিশ্চুপ ছিল জেলা প্রশাসন ও পুলিশ।
অথচ ‘আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নিজের লাইসেন্সের বিপরীতে নেওয়া অস্ত্র শুধু আত্মরক্ষার জন্য বহন ও ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যের মধ্যে ভীতি বা বিরক্তি তৈরি হতে পারে, এমন ক্ষেত্রে অস্ত্র প্রদর্শন করা যাবে না। এটি করলে তাঁর অস্ত্রের লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে বাতিলযোগ্য হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে (২০০৯-২০২৪) সারা দেশে ১৯ হাজার ৫৯৪টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। ওই সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট। পরে ২৫ আগস্ট বিগত সরকারের সময় অনুমোদন দেওয়া সব আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যাঁদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাঁদের গত ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে গোলাবারুদসহ অস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দিতে বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেকে অস্ত্র জমা দেননি।
মন্ত্রণালয়ের আরও তথ্য, যে ৭৭৮টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশের মালিক আওয়ামী লীগ সরকারের সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে যাওয়ার পর থেকে তাঁরা পলাতক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ বিদেশে পালিয়েছেন, কেউ কেউ দেশেই আত্মগোপনে আছেন। তাঁদের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। এ জন্য অনেকে অস্ত্র জমা দেননি।
২৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তাঁর সহযোগীদের গুলি ছোঁড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে রয়েছে আটটি আগ্নেয়াস্ত্র।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানিয়েছে, ওসমান পরিবারের একটি অস্ত্রও জমা হয়নি। অস্ত্র জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন, শামীম ওসমান, তাঁর ভাই সেলিম ওসমান, ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়ন, শ্যালক তানভীর আহম্মেদ। ৫ আগস্টের পর শামীম ওসমান আত্মীয়স্বজনসহ ভারতে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।
ওসমান পরিবারের এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মাহমুদুল হক।
তিনি বলেন, এ জেলায় ২৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। অবৈধ লাইসেন্সধারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনো জবাব আসেনি।
অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয় পাঁচজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। মূলত জেলা প্রশাসকেরাই অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করেছেন।
ওই পাঁচ জেলা প্রশাসক জানান, লাইসেন্সধারী ব্যক্তিরা বেশির ভাগ বিদেশে চলে গেছেন। কেউ কেউ দেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। লাইসেন্সধারীদের কেউ কেউ বলেছেন, তাঁদের অস্ত্র লুট হয়ে গেছে।
ডিসিরা বলেন, লাইসেন্স বাতিল হওয়ায় এসব অস্ত্র এখন অবৈধ। অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে সব পুলিশ সুপার কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কয়েকটি জেলায় খবর নিয়ে জানা গেছে, এ–সংক্রান্ত মামলার সংখ্যা কম।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এ কে এম আওলাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, মামলা একটি চলমান প্রক্রিয়া। অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। এখনো জবাব আসেনি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ৭৭৮টি অবৈধ অস্ত্র কোথায় আছে, এর মালিকেরা কোথায় আছেন, সেসব তথ্য নেই। অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য এখনো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েনি। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মামলার বিষয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের গাফিলতি থাকতে পারে। যদিও ৫ আগস্টের পর পুলিশ বিভাগ এখনো পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় অনেক কাজ স্থবির হয়ে আছে বলে জানান এই কর্মকর্তারা।
এদিকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছেন, তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেসব অস্ত্র ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের কমিটি করে দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কমিটির অন্য তিন সদস্য হচ্ছেন পুলিশ সুপার, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) একজন প্রতিনিধি ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। গত ২৮ অক্টোবর এসব কমিটি গঠন করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, যেসব অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে ব্যবহার করার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব অস্ত্র ফেরত দেওয়া হবে না। যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা চলমান, তাঁরা অস্ত্র ফেরত পাবেন না। এ ছাড়া যাঁরা ফৌজদারি অপরাধে এরই মধ্যে দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁরাও ফেরত পাবেন না। কমিটি অস্ত্র ফেরত দেওয়ার প্রতিটি আবেদন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে যাঁদের অস্ত্র ফেরত দিলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটার কোনো আশঙ্কা নেই কিংবা ক্ষতিকর কিছু হবে না, তাঁদের অস্ত্র ফেরত দেওয়া হবে।