ইসলামে কথা বলার নীতি……………………… ড. মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ*

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

কথা ভাব বিনিময়ের এক শক্তিশালী মাধ্যম। কথা ছাড়া কোন কাজ হয় না। জগতের সৃষ্টিশীল সবকিছুর নির্মান ও জীবন-যাপনের সকল সৌন্দর্য কথার উপর নির্ভর করে। কথা বলার জন্য শব্দ প্রয়োগের তারতম্য ও এর যথাযথ ব্যবহার প্রত্যাশিত সফলতা নিশ্চিত করে। কখনো কখনো শব্দ প্রয়োগের অযতœায়ন ব্যক্তির ব্যর্থতাকে অনিবার্য করে তোলে। সুন্দর করে কথা বলা একটি আর্ট বা শিল্প। যে যত বেশী এ শিল্প রপ্ত করে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করেছে সে তত বেশী উদ্দেশ্য সাধনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। কথা বলার সময়ে শব্দ বা বাক্য একটু এদিক সেদিক হলে, এর জন্য কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চড়া মূল্য দিতে হয়। কারো কথার আঘাতে কস্ট পেলে মানুষ মনে রাখে, সে স্মৃতি সে কখনো ভুলে না। যুগের পর যুগ তা স্মৃতির অলিন্দে স্থায়ীভাবে স্থান করে নেয়। সময়ে অসময়ে তা বলে বেড়ায়; রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে, ঘৃনায় ও অভিমানে। এই জন্য আরবী প্রবাদ আছে, জারা হাতুস সিনানে লাহাল ইলতিয়াম; ওয়া লাইয়াল তামুমাজারা হাল্লিসান‘ কথার ঘা শুকায় না; মাইরের ঘা শুকায়’ (শারহেকাফিয়া)। আবার একটি কথা যদি মমতা মাখানো হয়, ¯েœহের পরশে রঙিন হয়, সুন্দর-মায়াবি শব্দ প্রয়োগে ও দয়া-আন্তরিকতার চাদরে আবৃত শব্দ প্রয়োগে হয়, মানুষ কখনো তা ভুলে না; মনে রাখে আজীবন, দাগ কাটে মনে, জীবনের দেয়ালে স্থান করে নেয়।
একটি ভাল কথা শুধু সুন্দর পরিবেশ তৈরীতে অনবদ্য ভূমিকাই রাখে না বরং এর দ্বারা কার্যসিদ্ধ হয় সহজভাবে। এ জন্যই ইসলামে কথা বলার আদাব বা শিষ্টাচার বর্ণিত হয়েছে মহান আল্লাহ পাকের বাণী ঐশী বিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ও মহানবী সাঃ এর বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসে। তার প্রথমটি হলো কথা বলার পূর্বে সম্ভাষণ করা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মনোযোগ আকর্ষনে ও বক্তা-¯্রােতার মাঝে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরীতে চরমভাবে কাজ করে। এ জন্য মহান আল্লাহ কথা বলার পূর্বে প্রথমে সালাম দেয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন (সূরা নূর: ৬১)। সালাম মানে অন্যের কলাণ কামিতার ঘোষনা প্রদান করা। এই ঘোষণা বক্তা-¯্রােতার মাঝে আন্তরিক সহমর্মি ভাব তৈরী করে। রাসূল সাঃ সাদর সম্ভাষণ বা সালাম বিনিময়ের ব্যাপারে বিভিন্ন হাদীসে অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। এক মুসলমানের জন্য অপর মুসলমানের ছয়টি হক্ব বা অধিকারের প্রথমটি হলো দেখা হলে সালাম দেওয়া তার পর কথা শুরু করা।
কথা শুরু করা বা বক্তব্য প্রদানে সতর্কতা অবলম্ভনের গুরুত্ব অনিস্বকার্য। সতর্কতার সাথে কথা বললে মানুষ বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত বিষয়ের থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে। তাছাড়া প্রত্যেকটি কথা আল্লাহ তায়ালার নিয়োগপ্রাপ্ত ফেরেশতাগন লিপিবদ্ধ করে রাখেন। তা রেকর্ডভুক্ত হয়ে দলিল হিসেবে সংরক্ষিত হয় (সূরা ক্বাফ: ১৮) শব্দ প্রয়োগ ও সুন্দরভাবে বক্তব্য উপস্থাপনের প্রতি খেয়াল করা বা কথা বলার আদাব বর্ণনা সংক্রান্ত নির্দেশনা মহান আল্লাহ আল কুরআনে দিয়েছেন। এই জন্যই সুন্দরভাবে ও উত্তমরূপে কথা বলতে, ভাব বিনিময়ে করতে বলা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে সদালাপ করবে’ (বাক্বারা: ৮৩; বুখারীহা/ ১৪১৩)। ব্যক্তিগত জীবনে সদালাপি লোকদের সকলে ভালবাসে ও পছন্দ করে। কথা বলার সময়ে ইচ্ছায় হউক অনিচ্ছায় হউক অনেকে আমরা অপ্রয়োজনীয় বা ইরিভিলেন্ট কথা, অনর্থক ও বাজে কথা মুখ ফসকে বলে ফেলি। তর্কের খাতিরে বা নিজের মতকে প্রাতিষ্ঠানেক রূপ দিতে অনেক কথায়ই বলা হয়। কথা বলার সময়ে হয়ত কথার ধারাবাহিকতায় মনে থাকেনাবা সচেতন থাকি না। পরে মনে হয়, একথাটা না বললে ভাল ছিল। এই জন্য ইসলামে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা পরিহার করতে বলা হয়েছে। সূরা মুমিনুনে সফলকাম ব্যক্তিদের দীর্ঘ একটি তালিকা দয়াময় প্রভূ উপস্থাপন করেছেন (২৩:১-১১)। তৃতীয় নম্বরটি হলোÑ ‘যারা অপ্রয়োজনীয় কথা বা অসার ক্রিয়াকলাপ হতে নিজেদের বিরত রাখে’ (মুমিনুন: ৩)। সহীহ বুখারীতে এই মর্মে নির্দেশনা রয়েছে(বুখারীহা/ ৩৫৫৯)। কথা বলার সময়ে শব্দ প্রয়োগের পাশাপাশি কণ্ঠস্বরের উঠানামা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভাল কথা কর্কশভাবে বললেও ¯্রােতা সহজভাবে সেটা নেয় না। প্রয়োজনীয় কাজে উদ্দেশ্য সফল হয় না। তাই কণ্ঠস্বরের ম্যকানিজম কথা বলার প্রয়োজনকে সফলতার প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। আলকুরআনে এই জন্যই কথা বলার সময়ে কণ্ঠস্বর নিচু করে কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন ( সূরা লুকমানঃ১৯ সূরা হুজুরাতঃ২-৩)। অন্যদিকে বুদ্ধি খাটিয়ে বিচক্ষণতার সাথে কথা বলা হলো কার্যকর পদ্ধতি। তা অন্যের মনযোগ আকর্ষনের পাশাপাশি অর্থবহ আইডিয়া শেয়ারিয়ং কে নিশ্চিত করে। সূরা না হলে এই মর্মে নির্দেশনা রয়েছে (১৬:১২৫)। কথা বলার সময়ে সঠিক কথা বলা শুধু ব্যক্তিত্ববোধ তৈরীতেই অনবদ্য ভূমিকা পালন করে না; বরং দীর্ঘস্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কের মেলবন্ধনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। আর তাইতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল’(সূরা আহযাবঃ৭০)। সঠিক কথা বলতেও আন্তরিকতার প্রলেপ এবং মোলায়েম ভাষা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। কেননা, কর্কশ ভাষায় সঠিক কথাও অনেক সময়ে ¯্রােতা বা যার সাথে কথা বলা হচ্ছে তিনি ইতিবাচক ভাবে নিতে চান না। এই জন্যই কথা বলার সময়ে কর্কশ ভাষা পরিহারের ইসলামে নির্দেশা রয়েছে (লুকমান: ১৯; তিরমিযীহা/ ৪৮৫৯))। নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কথা বলার সময়ে কখনো ভাল-মন্দ মিশ্রণ করা ঠিক নয়। বরং কঠিন হলেও, পরিস্থিতি নিজের প্রতিকূলে গেলেও সত্যাশ্রয়ী এবং উত্তমের সাথে লিন হয়ে সর্বোত্তম কথা বলা উচিৎ। এতে দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণনিহিত থাকে। এই জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দ পতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (সূরা হামীম সাজদা: ৩৪)।
কথা বলার সময়ে মনে রাখা দরকার যে বিষয়ের কথা হচ্ছে সে বিষয়ে কাজটা কেমন হবে। কথা ও কাজে মিল রাখা বা মিল থাকবে কিনা। প্রতিশ্রƒতি দিয়ে পালন করতে পারব কিনা; অথবা যা বলছি নিজে এর সাথে একমত কিনা; নিজে পালন করব কিনা? সাময়িক কিছু পাওয়া বা লাভের আশায় লুকানো চেতনাকে আড়াল করে কথা বললে পরবর্তিতে লজ্জিত হতে হয়। সময়ের ব্যবধানে প্রকাশ পেয়ে যায় কথা ও কাজের যোজন যোজন পার্থক্য। ইসলামে এই বিষয়কে সাংঘাতিকভাবে সম্বোধন করা হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা এমন কথা কেন বল, যা তোমরা করনা? এটা কতই না নিন্দনীয় ব্যাপার যে তোমরা যা করছ না তা বলছ!’ ( সূরা ছফঃ২) । কথা বলার সময়ে সতর্কতা খুবই প্রয়োজন, সেটা যে লেভেলের লোকের সাথেই কথা বলা হউক না কেন। কথা যেমন যাদুর মতো কাজ করে, ঠিক কথায়ই কাল হয়ে যায়। কথা যেমন কাজের অনিবার্যতা তৈরী করে; কর্মপরিবেশ ঠিক করে; ঠিক কথার কারণে সব কিছু অনিশ্চিত হয়ে যায়; সাজানো গুছানো অবস্থা নিমষেই এলোমেলো হয়ে যায়। মুমিনের একটি কথা বা আইডিয়া প্রদান যেমন সাদাকাহ ও বারাকাহ হয়, ঠিক কথাই পাপের বা হতাশার অনুরনন তৈরী করে। এই জন্যে বাক্যালাপে সচেতন হওয়া বাঞ্চনীয়। কথা বলার সময়ে মুর্খ বা যারা যে বিষয়ের উপযুক্ত নয়তাদের সাথে ঐ বিষয়ে বাক্যালাপনা করে বরং এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম( সূরা ফুরকানঃ৬৩)। কথা আমানত, কথা হাতিয়ার, কথা একটি অনিবার্য রূপান্তর ও আসন্ন বিপ্লব। সুতরাং কথা বলতে হবে চিন্তা করে, হিসেব কষে, বুদ্ধিমত্ত্বার সাথে। প্রযুক্তির এ গগনচুম্বি উৎকর্ষ সাধনের এই যুগে কথা বলতে হবে আরো যতœায়নে। টেকনোলজি সব সংরক্ষণ করে রাখে। সময়ে অসময়ে ঘোর বিপদের কারণ হতে পারে আপনার মুখ নিসৃত একটি দুটি কথাই। আল্লাহ্ আমাদেরকে আল কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুযায়ী সঠিকভাবে আমল বা ইসলাম চর্চা করার তওফিক দান করুন।” আমিন।”