আমার বাসা কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে আমি প্রায়ই এই হাসপাতালে বর্হিবিভাগে অসুস্থ হলে চিকিৎসা সেবা গ্রহন করে থাকি। নিয়ম মোতাবেক লাইনে দাড়িয়ে দশ টাকার বিণিময়ে স্লিপ/টিকেট নিয়ে সংস্লিষ্ট বিভাগে গিয়ে আবার লাইনে দাড়িয়ে অবশেষে ডাক্তারের শরনাপন্ন হতে হয়। বর্হিবিভাগে ইদানিং রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় রোগী, ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন সমস্যা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। যাইহোক, ১৭ অক্টোবর, ২০২৪ ইং, বৃহষ্পতিবার, চর্মরোগের সমস্যার কারনে আমি যথারীতি কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলাম।বিগত দিনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে আমি ভাবলাম, একটু দেরি করেই যাই, এতে হয়তো লোকের ভীড় কমে যাবে। কিন্তু আমার এই ধারনা যে সম্পূর্ন ভুল তা একটু পরেই উপলব্ধি করতে পারলাম। আমি হাসপাতালের বর্হিবিভাগে টিকেট নিতে গিয়ে দেখলাম দীর্ঘ লাইন শুধুমাত্র বর্হিবিভাগের কাউন্টারের সীমানার ভিতরেই সীমাবদ্ধ নয়- এটি বর্হিবিভাগের সীমানা পেরিয়ে এর বাইরেও দীর্ঘ জায়গা দখল করে আছে। পর্যবেক্ষনে দেখা যায়, একদিকে যেমন বর্হিবিভাগের দক্ষিন দিকে পুরুষ ও মহিলার দীর্ঘ লাইন বর্হিবিভাগ ছাড়িয়ে বাইরে চলে গিয়েছে এবং বিপরীত দিকে অর্থাৎ বর্হিবিভাগ কাউন্টারের উত্তর দিকে মহিলাদের কয়েকটি লাইন দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অর্থাৎ এককথায় বলা যায়, পুরুষের তুলনায় মহিলা রোগীর সংখ্যা তিন/চারগুন বেশি । এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, কয়েকমাস আগে আমি যখন বর্হিবিভাগে টিকেট সংগ্রহ করতে যাই তখন দেখতে পাইযে, পঞ্চাশোর্ধ্ব রোগীদের জন্য একটি বিশেষ লাইনের কথা কাউন্টারে লেখা থাকলেও বাস্তবে তখন সেখানে কোন লাইন দেখতে পাইনি। আমি গিয়ে সেখানে দাড়ালে হাসপাতালে দাযিত্বরত একজন লোক আমাকে সেখানে না দাড়িয়ে একটি লাইনেই দাড়াতে বলেন।। আমি তার দৃষ্টি আকর্ষন করে বললাম”এখানেতো পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকের জন্য আলাদা লাইনের কথা বলা হয়েছে।” তখন তিনি আমার যুক্তির সাথে একমত হয়ে আমাকে টিকেটের ব্যবস্থা করে দিলেন। মজার ব্যাপার হলো, দীর্ঘদিন পর আমি যখন বাইরে দীর্ঘ লাইন দেখলাম তখন আমি ভিতরে গিয়ে লক্ষ্য করলাম যে এবার পঞ্চাশোর্ধ্বদের জন্য বরাদ্দ লাইনে লোকজন আছে। তাই আমি আশান্বিত হয়ে সেই সুযোগ গ্রহন করার জন্য লাইনে দাড়ালাম এবং মনে মনে ভাবলাম যে,কিছুকাল পূর্বে যে উদ্যোগ গ্রহন করেছিলাম তার সুফল এখন নিজেই পাচ্ছি।মনে মনে নাটকের সেই সংলাপটি মনে মনে কল্পনা করলাম “ নিজের প্রতিভায় আমি নিজেই পুলকিত”। পঞ্চাশোর্ধ্ব রোগীদের জন্য নির্ধারিত লাইনটিতে কিছু বয়ষ্ক রোগী আছে বটে কিন্তু পাশাপাশি সেখানে দু’একজন তরুন রোগীকেও দেখলাম। আবার এর বিপরীত চিত্রও দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যেমন- কিছু বয়ষ্ক রোগীকে তরুনদের লাইনেও দেখলাম। এসব দেখে মনে মনে আমার কিছুটা হাসিও পেল এই ভেবে যে, এসব আচরন প্রকৃতপক্ষে কিছুটা অজ্ঞতা এবং অসচেতনতার কারনেই ঘটেছে। এর মধ্যে আরও একটি কান্ড ঘটে গেল। লক্ষ্য করলাম যে, লাইনে দাড়ানো কিছু রোগী চিৎকার করে একে অপরের সাথে ঝগড়া করছে। আমি তাদেরকে এর কারন জিজ্ঞাসা করায় তারা বলল যে, কিছু লোক লাইনে না দাড়িয়ে অনৈতিক পন্থায় টিকেট/স্লিপ সংগ্রহ করছে। একজন মহিলা রোগী আমাকে বললেন যে, পুরুষ ও মহিলার জন্য পৃথক লাইন থাকলেও দুটি লাইনের জন্য স্লিপ প্রদানকারী রয়েছেন মাত্র একজন ব্যক্তি। মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, পঞ্চাশোর্ধ্ব রোগীদের জন্য যে লাইন রয়েছে সেটি এবং এর পাশের মহিলাদের জন্য বরাদ্দ লাইনের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (একই টিকেট প্রদানকারী) রয়েছেন। প্রাথমিকভাবে টিকেট সংগ্রহ করে আমি চর্মরোগের ডাক্তার দেখানোর উদ্দেশ্যে বর্হিবিভাগে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মারাত্মক অব্যবস্থাপনা দেখতে পেলাম। আমি দেখলাম যে, পুরুষ-মহিলা রোগী একসাথে এলোমেলো ও বিশৃঙ্খলভাবে সম্পূর্ন জায়গা দখল করে বিশাল অসম লাইনে দাড়িয়ে আছে। আমি একটু দুরে একজন আনসার সদস্যকে দেখে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার কথা জানিয়ে বলি যে,” আনসার ভাই আপনি পুরুষ এবং এবং মহিলার আলাদা লাইন করে দিন- যাতে সবাই সুশৃঙ্খলভাবে ডাক্তারের সেবা নিতে পারেন”। আশার কথা হলো, তিনি আমার অনুরোধে ইতিবাচক সাড়া দিলেন এবং সেখানে বাইরে দায়িত্বরত ব্যক্তিকেও বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। তিনিও আমার সাথে একমত পোষন করেন। আমার অনুরোধে ও দিক নির্দেশনায় সাড়া দিয়ে তার উভয়ে পুরুষ ও মহিলার জন্য আলাদা লাইনের ব্যবস্থা করে দেয়ায় তাৎক্ষনিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে দায়িত্বরত ব্যক্তি এরূপ পরিস্থিতির জন্য সাময়িক কিছু অনিবার্য কারন/ সমস্যা ও পরিস্থিতির কথা বলেন। তিনি বলেন যে, চর্মরোগের বহির্বিভাগে দুটি রুমে ৪/৫ জন ডাক্তার থাকেন কিন্তু কিছু ডাক্তার দূর্গা পূজা উপলক্ষে ছুটিতে থাকায় শুধুমাত্র দুজন ডাক্তার (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা) ডিউটিতে নিয়োজিত থাকায় সাময়িকভাবে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে দেখলাম, এজন পুরুষ ও মহিলা ডাক্তার যথাক্রমে পুরুষ ও মহিলা রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। কিন্তু একসাথে অনেক রোগী প্রবেশ করায় সেখানে কোলাহলপূর্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। অন্যকথায় মারাত্মক শব্দ দূষনের সৃষ্টি হয়েছে। প্রিয় পাঠক, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন শেষে আমার বক্তব্য হচ্ছে, কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের (বর্হিবিভাগ) ডাক্তার ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই ভাল। বর্হিবিভাগের টিকেট কাউন্টারের লোকজনেরও কোন দোষ নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও যথাসম্ভব ক্রমান্বয়ে হাসপাতালের পরিবেশের উন্নতির জন্য সচেষ্ট বলে আমি মনে করি। কেননা রোগীদের উদ্দেশ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লেখা একটি বক্তব্য আমার খুব ভাল লেগেছে, যেমন- লেখাটির মূল বক্তব্যে রোগীদের গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে– যেখানে ডাক্তারগন রোগীদের সেবা করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছেন, এই মর্মবাণীটিই প্রতিফলিত হয়েছে। তাই আমি মনে করি কিছু ব্যবস্থা গ্রহন করলে (আমার প্রস্তাব) কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের এসকল সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবেঃ
১. বর্হিবিভাগের টিকেট কাউন্টারের সংখ্যা এবং জনবল বৃদ্ধি করতে হবে।
২. বর্হিবিভাগের টিকেট কাউন্টারে ও ডাক্তারদের রুমে প্রবেশের লাইনে বিশৃঙ্খলা তথা হৈচৈ/ ঝগড়া বিবাদ এড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
৩. পুরুষ ও মহিলা রোগীরা যাতে একই লাইনে না দাড়ায় সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
৪. ডাক্তারদের চেম্বারে দু’জনের বেশি রোগী যাতে একসাথে প্রবেশ না করে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
৫. শত শত রোগীকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে গিয়ে একজন ডাক্তারকে হিমসিম খেতে হয়- তাছাড়া এতে অনেক সময়ের অপচয় হয়, তাই রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় একটি বর্হিবিভাগের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ডাক্তার নিয়োগের (জনবল বৃদ্ধি) ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনজনিত কারনে সংস্লিষ্ট বিভিন্ন ডাক্তারদের ছুটিতে থাকার কারনে সাময়িক শূন্যতা দূর করার জন্য অস্থায়ীভাবে বিকল্প ডাক্তারের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক।
৭.বহির্বিভাগে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ‘দিবা’ ও ‘নৈশ’ নামে দু’টি বিভাগ চালু করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা জরুরি।
৮. আনসারসহ হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষীর সংখ্যা প্রয়োজনানুপাতে বৃদ্ধি করা অতীব জরুরি।
৯. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সপ্তাহে দু’বার সরেজমিনে পরিস্থিতি এবং সিসিটিভি ফুটেজে ধারন করা দৃশ্য পর্যবেক্ষন করে এবং তদনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।
১০. ডাক্তারদের চেম্বারে রোগীদের বসার জন্য প্রয়োজন অনুপাতে চেয়ারের ব্যবস্থা রাখা অত্যাবশ্যক।
১১. হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রোগী, ডাক্তার এবং নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করার জন্য যথেষ্ট প্রচারের ব্যবস্থা করা উচিত।
১২. সার্বিকভাবে কাউন্টার স্লিপ/ টিকেট কাটার ব্যবস্থা না করে সংশ্লিষ্ট বিভাগে উক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করা উত্তম।
১৩. কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও কুমিল্লা সদর হাসপাতালের রোগীর অত্যধিক চাপের কথা বিবেচনায় নিয়ে কুমিল্লার উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে আরো তিনটি সরকারি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। ( এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের বিশেষ উদ্যোগ গ্রহন অত্যাবশ্যক)
মোটকথা- কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে উন্নত পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার, কর্মকর্তা, কর্মচারী, নিরাপত্তা কর্মীসহ সংস্লিষ্ট সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহনের স্বার্থে সকল রোগীকেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে সচেতন ও দায়িত্বশীল আচরন করতে হবে
লেখকঃ গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ; শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজ, বুড়িচং, কুমিল্লা।
ইমেইলঃ [email protected]