গাইডের বিশ^াস ঘাতকতায় প্রথম যুদ্ধেই কমান্ডারসহ ২৫জন শহিদ হয় – আবুল কালাম আজাদ

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -৮
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ৩ মাস আগে

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এইড-কুমিল্লার প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে হবিগঞ্জের সাহাজী বাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায় আসেন সেনা বাহিনীর কর্মকর্তা খালেদ মোশারফ,নুরুজ্জামান চৌধুরী,কেএম সফিউল্লা(পরবর্তীকালে সেনা প্রধান ও এমপি হন)। তারা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করেন। সেই সভায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মকর্তা আব্বার সাথে আমিও ছিলাম। সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে খালেদ মোশারফ খুব সংক্ষেপে দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এর পটভূমিকা বর্ণনা করে বলেন, এই এলাকায় আমাদের একটি ক্যাম্প করতে হবে। এখন এটা কোথায় করা যায় । তখন আব্বা, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মজিদ, স্টোর অফিসার মোসলেহ উদ্দিনসহ অফিসাররা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিতর খালি জায়গায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার প্রস্তাব দেন আর স্থানীয়রা নানা ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার আশ^াস দেন। তখন তিন সেনা অফিসার বলেন, ক্যাম্পটি সাহাজি বাজার করা যাবে না। তারা তেলিয়াপাড়া চা বাগান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে করার সিদ্ধান্ত নেন এবং উপস্থিত যুবকদের মধ্যে কারা কারা এই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ করতে আগ্রহী তাদের নাম জানতে চান। মুক্তিযুদ্ধে যেতে আগ্রহী অন্যান্যদের সাথে আমিও হাত উঠাই। নবম শ্রেণীর ছাত্র হলেও তখন বয়স বা দেখতে একেবারে ছোট দেখাত না। তাই পরদিন ২৮ মার্চ তেলিয়াপাড়া চা বাগানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমরা প্রায় শতাধিক যুবক অংশ নেই। এখানে আমরা এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি প্রশিক্ষক সফিউদ্দিন আহমেদের কাছে। এই স্থানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি নিরাপদ না মনে করায় ১৫ এপ্রিল এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নরসিংহপুরে স্থানান্তর করা হয়। ভারতে যাওয়ার সময় ক্যাম্প কমান্ডার বয়সে ছোট বলে আমাকে ভারতে নেয়নি। ।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু : বাড়িতে আসার পর কিভাবে ভারতের নরসিংপুর ক্যাম্পে যাব এই চিন্তা করতে থাকি। একদিন খবর পেলাম আমাদের এলাকার এমপি দেওয়ান আবদুল আব্বাস নরসিংহপুর ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন। এ কথা শুনে দুই দিনের মাথায় আমার বন্ধু মুজাফ্ফরসহ ২৫জন মিলে কসবা হয়ে ভারতের নরসিংহপুর রওয়ানা দেই। বিকালে ক্যাম্পে গিয়ে পৌঁছি। যেতে দিবে না বলে মাকে, বলে যাইনি। তবে বাবাকে গোপনে বলে যাই। তিনি আমাকে ২শ টাকা হাতে দিয়ে বলেন, টাকাটা রাখ,দেশ স্বাধীন করে ফিরবা ইনশাআল্লাহ। আমরা এখানে এসেই আমাদে এমপি দেওয়ান আবদুল আব্বাসের কাছে গেলে, তিনি একটি চিরকুট লিখে দেন। ফলে আমাদের এখানে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। তিন দিন পর একদিন সকালে একটি জিপ গাড়িতে করে ২জন বাঙ্গালী আর্মি অফিসার এসে বলল, এখানে কে আছ যে, সিলেট অঞ্চলে যুদ্ধ করতে পার। আমি হাত তুলে বললাম, স্যার আমি হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সব রাস্তাঘাট চিনি। আমার বয়স কম বলে প্রথমে বিশ্বাস না করে প্রায় ১৫ মিনিট মাধবপুর ও সাহাজীবাজার এলাকার বিভিন্ন রাস্তাঘাট নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলে আমি চটপট সব উত্তরে দেই। পরে এই ক্যাম্প থেকে শুধু মাত্র আমাকেই তিনি তার জিপ গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। দুপুরে আমরা তিন সেক্টরের অধীনস্ত একটি ক্যাম্পে যাই। এই মুহূর্তে ক্যাম্পের নাম মনে করতে পারছি না। এই ক্যাম্পে আমিসহ প্রায় শতাধিক তরুণ একটানা ২১ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এখানে আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন বাঙ্গালী এবং ভারতীয় আর্মির প্রশিক্ষকরা। প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ৩নং সেক্টরের প্রধান অফিস হেজামারা ক্যাম্পে। এখানে আমি ৭ দিন ছিলাম। আমার এখানে একমাত্র কাজ ছিল, দিনে বাবুর্চিকে রান্নার বিভিন্ন কাজে এবং রাতে নৈশপ্রহরীদের সহযোগিতা করা।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রথম যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে আমাদের কমান্ডার হাবিলদার সফিউদ্দিন আমাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের মধ্যে কারা সাহাজী বাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন আশেপাশের রাস্তা ভাল করে চিন। আমরা এক সাথে ৩০ জন হাত উঠাই। তখনি জানতে পারলাম আমার বাবার কর্মস্থল আর আমার আবাসস্থল সাহাজী বাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র হানাদার বাহিনী দখল করে নেয়। বিষয়টি শুনে অন্য রকম এক উত্তেজনা কাজ করেছিল আমার মধ্যে। পরদিন সকাল ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফোরকান উদ্দিনকে কমান্ডার করে হেজামারা ক্যাম্প থেকে আমাদের ৩০ জনকে সাহাজী বাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র আক্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। সাথে ছিল স্থানীয় এক গাইড। যদিও এই গাইড আমাদের সাথে বেঈমানী করেছিল। তেলিয়াপাড়া চা বাগান যাওয়ার আগেই রাত হয়ে যায়। গাইড আর কমান্ডার ফোরকান উদ্দিন সবার আগে। তেলিয়াপাড়া চা বাগানের প্রবেশ পথ বন দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল, দূর থেকে গাড়ির হেড লাইটের আলো। মুহূর্তেই আমাদের ভুল ভাঙ্গল। গাইড আমাদের সঠিক রাস্তা দিয়ে না এনে হানাদার বাহিনীর বলে দেওয়া এবং পজিশন নেওয়া রাস্তা দিয়ে এনেছে আমাদের শেষ করে দেওয়ার জন্য। সাথে সাথেই কমান্ডার ফোরকান উদ্দিন ভাই গর্জে উঠে গাইডকে বলল,তুই আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছিস। এ সময় গাইড দৌঁড় দেয়ার চেষ্টা করলে সাথে সাথে ফোরকান ভাই তাকে গুলি করে মেরে ফেলে। আর অপর দিকে, পাকিস্থানী বাহিনী যে আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে তা বুঝতে বাকি রইল না। তারা মাইকে বার বার উর্দুতে ঘোষণা দিচ্ছে, আমরা যেন গুলি না চালিয়ে আত্মসমর্পণ করি। অপেক্ষাকৃত বয়সে আমরা যারা ছোট ছিলাম তারা একেবারে পেছনের দিকে ছিলাম। কোন উপায় না দেখে হঠাৎ করে কমান্ডার ফোরকান ভাই ফায়ার এবং গো ব্যাক বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। তখন আমরা এক সাথে ফায়ার করতে শুরু করি। হানাদার বাহিনীও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো আমাদের সামনের সব সহযোদ্ধাই শহীদ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। আমার বন্ধুকের গুলিও শেষ হয়ে গেল। আশে পাশে কাউকে না দেখে মৃত্যু নিশ্চিত মেনে নিলাম। আমাদের দিক থেকে কোন ফায়ারের আওয়াজ না শুনে তারাও এগুতে লাগল। তখন আমি বন্ধুকটা চা গাছের উপর রেখে কলেমা পড়ে এবং তওবা করে যেই না হাত দুটো উপরে উঠিয়ে আল্লাহর কাছে শেষ বারের মত ক্ষমা চাইব, ঠিক এমন সময় কোমরের মধ্যে হাত লাগলে বুঝতে পারি, আমার কাছে দুটো গ্রেনেড আছে। তখন আমি একটি গ্রেনেড খুলে জীবনের সব শক্তি দিয়ে আমার দিকে অগ্রসরমান হওয়া হানাদার বাহিনীর গাড়িটির দিকে নিক্ষেপ করি। এরপর দেই দোঁড়। কিছু দূর গিয়ে আরেকটি গ্রেনেড মারি। কিভাবে যে সে দিন এমন দৌঁড় দিতে পেরেছিলাম তা এখন ভাবতেই অবাক লাগে। নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পর দেখি আহত অবস্থায় আরো চার সহকর্মী এসেছে। কমান্ডারসহ বাকী ২৫জনই এই যুদ্ধে শহিদ হয়। আর আমার ছোড়া দুটি গ্রেনেডে সম্ভবত বেশ কয়েকজন হানাদার মারা যায়। এই যুদ্ধে আমার বাম পা গুলিবিদ্ধ হয় । সেই ক্ষত আজো আমি বহন করে চলি।

সর্বশেষ যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ডিসেম্বর শুরুতে আমরা সদর উপজেলার তারুয়া গ্রামের মহিউদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়িতে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করি। আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে, ভৈরব আক্রমণ ও দখলে নেওয়া। কিন্তু পাক বাহিনীর শক্তিশালী ঘটি ছিল ভৈরবে। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে ভৈরব আক্রমণের জন্য আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করি। এক দিকে, মেজর নাসিম ও লে.ইব্রাহিমের (বর্তমানে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান ও এমপি ) নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপ,আখাউড়া দিয়ে মিত্র বাহিনীর একটি গ্রুপ আর শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে আমরা। এই তিনটি টিম এক সাথে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হই। কিন্তু আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব যাওয়ার পথে একমাত্র রাস্তা হচ্ছে মেঘনা ব্রিজ। আমাদের আগমনের কথা জেনে হানাদার বাহিনী মেঘনা সেতু দিয়ে নামার জায়গায়টি ভেঙ্গে ফেলে। ফলে আমরা আর নদী পার হতে পারিনি । পরে আমরা ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আশুগঞ্জ অবস্থান করি। দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৬ ডিসেম্বর কিন্তু ভৈরব স্বাধীন হয় ১৮ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও ভৈরবে তারা নদীর এপার ওপার যুদ্ধ চালিয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন অব্যাহত রাখে। পরে বাধ্য হয়ে ১৭ ডিসেম্বর রাতে ভারত থেকে আনা উভয়চর ট্যাংক নিয়ে নদী পার হয়ে স্থল হামলা আর একই সাথে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলা চালানো হয়। আমাদের স্থল ও বিমান হামলায় মুহূর্তেই গুড়ে যায় পাক বাহিনীর শক্তিশালী দুর্গ । পরে তারা ১৮ ডিসেম্বর সকালে আত্মসমর্পণ করে।

পরিচয় : আবুল কালাম আজাদ। পিতা আমিনুল ইসলাম। যিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মা আফিয়া খাতুন। ১৯৫৮ সালের ২ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর উপজেলার তেজখানী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মাতার চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিনি চলে যান পিতার কর্মস্থল হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার সাহাজী বাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকায়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পিতা আমিনুল ইসলাম নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় জগদিশপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশুনা করেন। ১৯৮৪ সালের ২ জুলাই এইড কুমিল্লার নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া বেগম শেফালীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি দুই পুত্র সন্তানের গর্বিত পিতা।