দেশ স্বাধীনের ৮ দিন পর গাগুটিয়া মুক্ত করি – জালাল দেওয়ান

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -১১
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ মাস আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
যুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতি জানতে চাইলে বাউল শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জালাল দেওয়ান জানান, যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর পরই আমাদের এলাকার ভাগন মিয়া এলাকার যুবকদের বলতে শুরু করেন হয় যুদ্ধে যাও, নতুবা বাড়ি থেকে যাও। কারণ, তোমাদের মত উঠতি বয়সের ছেলেদের পাঞ্জাবিরা দেখলে আর রক্ষা নেই। একেবারে মেরে ফেলবে। তার কথা মতো আমাদের আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের আমরা ৩১ জন যুবক, এই মুহুর্তে যাদের নাম মনে করতে পারছি তারা হলেন, আবদুল কাদের, মোসলেম মিয়া, আবদুল মতিন, আবদুর রহমান,আলী হোসেন, আশাদ মিয়া,ফুল মিয়াসহ অন্যান্যরা কসবা সীমান্তের চারগাছ বাদুর এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। ঐ খানে গিয়ে এলাকার আবদুল কাদেরর মাধ্যমে আমরা ত্রিপুরা রাজ্যের আগড়তলার কংগ্রেস ভবনের শরনার্থী শিবিরে উঠি।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
আগড়তলার কংগ্রেস ভবনের শরণার্থী শিবিরে উঠার দুই দিন পর একদিন সকালে কয়েকজন এসে আমাদের শারিরিক পরীক্ষা নেয়। যুদ্ধে যাওয়ার মত আমরা উপযুক্ত কিনা তারা বিভিন্ন ভাবে আমাদের পরীক্ষা করে। পরে এই শিবির থেকে আমাদের ২৫জনকে নেওয়া হয় চরিলাম ক্যাম্পে। ঐ খানে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে প্রথম। জঙ্গল পরিস্কার করে তাবু টানিয়েছি। এখানে আমাদের ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় মেজর চ্যাটার্জি আর আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন আমাদের বাঙ্গালী আর্মি অফিসার মেজর আইয়ুব। জঙ্গলে তাবুর মধ্যে থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া প্রথম প্রথম বেশ কষ্ট হলেও পরে তা সয়ে যায়। এখানে আমরা পুরো ২ মাস প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণের পরে সম্ভবত আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বর হবে গিয়াস উদ্দিন কে কমান্ডার করে আমাদের হোমনা পাঠানো হয়।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :

হোমনার কয়েকটি স্থানে তখন পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। বিশেষ করে গাগুটিয়া এলাকায় ছিল শক্তিশালী ক্যাম্প। এই ক্যাম্পটি দিয়েই মূলত পাকিস্তান বাহিনী হোমনা মেঘনা অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রন করতো। আমরা ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চারগাছ বাদুর সীমান্ত দিয়ে রাতে হোমনা প্রবেশ করি। প্রথমেই আমরা হোমনার গাড়মোরা বাজার আসি। গাড়মোরা বাজারে হানাদার বাহিনীর একটি ছোট ক্যাম্প ছিল। এখানে আসার আগেই আমাদের কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন ভাই তার সোর্সের মাধ্যমে জায়গায়টি ভাল ভাবে রেকি করে নেয়। আর আমাদের যাদের এই অভিযানে পাঠিয়েছে আমরা প্রায় সবাই ছিলাম হোমনা ও আশেপাশের এলাকার সন্তান। সুতরাং জায়গাটিও আমাদের কাছে খুব পরিচিত । ভোর রাতে আমরা গাড়মোরা বাজার আক্রমণ করি। আমার হাতে ছিল একটি থ্রিনটথ্রি রাইফেল। আমাদের এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য হানাদার বাহিনী মোটেই প্রস্তুত ছিল না। আমাদের আক্রমনের কিছুক্ষণ পর তারাও পাল্টা আক্রমণ করে। তখনো ভোরের আলো ভাল করে ফুটেনি। প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে দেখি আমাদের সহযোদ্ধা মধ্যকান্দি গ্রামের আবদুল হাকিম, আমাদের মিরেশ্বকারি গ্রামের ফুল মিয়া ও আরেকজন এই মুহূর্তে নাম মনে আসছে না এই তিনজন সামান্য ব্যবধানে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের রক্তমাখা দেহ দেখে আমরা বিচলিত হয়ে উটি। গুলি করতে করতে একেবারে বাজারের সামনে চলে আসি। আমাদের দাপটে আগানো দেখে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। তারা চলে যায় তাদের নিরাপদ আশ্রয় গাগুটিয়া ক্যাম্পে। তারা চলে যাওয়ার পর দেখি পাঞ্জাবিদের ৪/৫ জন সৈনিক আমাদের গুলিতে নিহত হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। এই যুদ্ধে আমরা জয়লাভ করলেও আমাদের ৩জন সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়েছে। আহত হয়েছে আরো কয়েকজন। আমরা এই গাড়মোরা বাজার থেকে আরো কয়েকটি অভিযানে অংশ নেই।
এরপার আমাদের মূল সেক্টর অফিস থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলো, গাগুটিয়া ক্যাম্পে আক্রমন করার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। ইতিমধ্যে গাগুটিয়া ক্যাম্প আক্রমন করার জন্য আরো বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আমাদের ক্যাম্পে মুক্তিফৌজ ও এফএফ বাহিনী যোগ দিল। গাড়মোরা বাজার থেকে গাগুটিয়া পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমন করা কঠিন। তাই আমরা কিছু দিনের মধ্যেই গাগুটিয়া গ্রামের পাশের গ্রাম দরিচর গ্রামে আমাদের ক্যাম্প স্থাপন করে আমরা ঐ খানে চলে যাই। আমরা দরিচর যাওয়ার কারণে হানাদার বাহিনীর বাহিরে যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়ে গেল। কারণ, তাদের ঢাকার দিকে ব্যাক করতে হলে মেঘনা নদী দিয়েই যেতে হবে। এই জায়গায় আমাদের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে তারা এক প্রকার বের হতে পারছিল না। এখানে প্রথমে আমাদের সোর্সের তথ্যটি ছিল কিছুটা ভুল। যার কারণে এই ক্যাম্পে পাক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা কম ভেবে আমরা কয়েকটা ছোট আক্রমণ করতে গিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হই এবং আমাদের কিছু ক্ষতিও হয়। পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে সম্ভবত মেজর হায়দারের নির্দেশেই আমরা গাগুটিয়া পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমন করার জন্য পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করি।
১৬ ডিসেম্বর রাত ১০টায় বিবিসির খবরে জানতে পারি পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে এবং আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু এই খবরেও আমরা আনন্দ করতে পারিনি। এখানে পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে আমাদের ক্ষনে ক্ষনে যুদ্ধ লেগেই ছিল। ১৭ ডিসেম্বর যখন তাদের জানাই যে, তোমাদের সৈন্যরা আত্মসমর্পন করেছে তোমরাও আত্মসমর্পন কর। কিন্তু তারাতো আত্মসমর্পন করলই না বরং আরো প্রচন্ড ভাবে তারা ফায়ার শুরু করল। ১৮ ডিসেম্বর আমরা তাদের বাহির হওয়ার মত কোন জায়গায় রাখলাম না। চর্তুদিকে সব পথ বন্ধ করে দিলাম। এদিকে দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার কারণে এক দিকে রাজাকারদের সহযোগিতা পাচ্ছে না , অন্য দিকে এলাকার সাধারণ মানুষও আমাদের সাথে এসে যোগ দিল ।শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। ২০ ডিসেম্বর মাইক যুগে তাদের আত্মসমর্পনের আহবান জানাচ্ছি যে ,তোমাদের সবাই আত্মসমর্পন করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তোমরাও আত্মসমর্পন কর। কিন্তু তারা কিছুতেই কোন কথা শুনছে না। ফলে থেমে থেমে উভয় পক্ষের যুদ্ধ চলছেই। পরে ২৩ ডিসেম্বর সকালে কুমিল্লা সেনা নিবাস থেকে এক পাকিস্তানী মেজরকে এনে তাদের বুঝিয়ে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করি। ফলে দেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর আর হোমনার গাগুটিয়া স্বাধীন হয়২৩ ডিসেম্বর। পরে দুপুরে বিজয়ীর বেশে বাড়ি যাই। তখন আমাকে এক নজর দেখার জন্য গ্রামের সকল মানুষ চলে এসেছিল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর কমালে চুমু খাচ্ছে। সেই এক অন্য রকম দৃশ্য ছিল।
পরিচয় :
মো. জালাল দেওয়ান। পিতা মো. ইদ্রিস আলী এবং মা জোহরা খাতুন। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ৮নং গাড়মোরা ইউনিয়নের মিরশ্বিকারী গ্রামে ১৯৫৪ সালে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি পিতা মাতার ৪ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে সবার বড় সন্তান। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত ভাউল শিল্পী। হোমনার কালামিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় ওস্তাদ আবদুল খালেক দেওয়ানের হাত ধরে তিনি সংগিত জগতে প্রবেশ করেন।