এক সরকারি কর্মকর্তার আর্তি ও শীতের দিনের লোডশেডিং

সময়ের কড়চা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গত ২২ জানুয়ারি দৈনিক আমাদের কুমিল্লার স্টাফ রিপোর্টার সোহাইবুল ইসলাম সোহাগকে নিয়ে একটি বিশেষ রিপোর্ট করার জন্য কুমিল্লার এক সরকারি কর্মকর্তার দপ্তরে যাই বেলা ১২টায়। অত্যন্ত বন্ধুবাৎসল্য ও অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারি ঐ কর্মকর্তা আমাকে দেখেই বললেন, ভাই, সকাল থেকে বিদৃ্যুৎ নেই। গত রোববারও একই অবস্থা ছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের যদি কাজ থাকে তাহলে বন্ধের দিন কেন তারা কাজ করে না। অফিস খোলার দিন কেন? আমরা এখন কিভাবে কাজ করি। ঢাকায় মেইল করতে হবে,ফ্যাক্স পাঠাতে হবে। কিন্তু বিদ্যুতের খবর নেই। কোন সময় আসবে তাও জানি না। কৌতুকের স্বরে ঐ সরকারি কর্মকর্তা বলেন, আচ্ছা এমরান ভাই, আগে দেখতাম শীত মৌসুমে লোডশেডিং হতো না, কিন্তু এখন দেখি কি শীত আর কি গ্রীস্ম । লোডশেডিং যেন পুরো জাতিকে মামার বাড়ি পেয়ে বসেছে। শীত কি পারে না লোডশেডিংকে কাবু করে ঘরে বসিয়ে রাখতে। এক নাগারে কথা গুলো বলেই এই বিসিএস ক্যাডারের অফিসার ক্ষুদ্ধে কন্ঠে বললেন, ভাই, অন্য নিউজ বাদ দেন। এই শীতের মধ্যেও বিদু্যৃৎ বিভাগ কেন লোডশেডিং দেয়, কি তাদের সমস্যা ,কেন তারা শুক্র ও শনিবার বিদ্যুতের কাজ না করে রোববার অফিস খোলার দিন করে এই বিষয়ে বিস্তারিত নিউজ করেন। জানতে চাইলাম,নিউজে আপনার নাম দিব কিনা। বিনয়ের সাথে প্রথম শ্রেণীর এই সরকারি কর্মকর্তা বললেন, ভাই, চাকরি খাইয়েন না।
এখন কুমিল্লাসহ সারা দেশেই ভরা শীত মৌসুম।বর্তমান সময়ে শৈত্যপ্রবাহ না থাকলেও শীতের যৌবনকাল বলতে যা বুঝায় তা বিদ্যমান রয়েছে। সাধারণত শীত মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে। ফ্যান,এসি কম চলে।তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়ে লোডশেডিং থাকে না। মানুষ শীতে কষ্ট করলেও বিদ্যুতের অভাববোধ করে না। কিন্তু এবার হচ্ছে ব্যতিক্রম। গ্রীস্মকালে বিদ্যুতের জন্য এবার যেমন হাহাকার ছিল ঠিক তেমনি না হলেও জনসাধারণে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য, শীতের এই ভরা মৌসুমে যদি লোডশেডিং থাকে তাহলে গ্রীস্মকালে কি অবস্থা দাঁড়াতে পারে তা কল্পনা করতেই আৎকে উঠার উপক্রম ঘটে। ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। সক্ষমতা থাকলেও জ্বালানির অভাবে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ৯ তারিখের পর থেকে দেশে ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করছে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। এ তথ্য জানিয়েছেন তারা নিজেরাই।
গত ২৩ জানুয়ারি দৈনিক মানবজমিনে অনলাইন ভার্সন থেকে সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, সারা দেশে শীত মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন বিদ্যুৎ চাহিদা ৯ থেকে ১০ হাজার মেগাওয়াট থাকে । কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ৯ হাজারের কিছু বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন বিদ্যুতের উৎপাদন ও পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯শে জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১০ হাজারের একটু বেশি। সর্বনিম্ন উৎপাদন হয় ৬ হাজার ৬৯৫ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১০ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। যদিও উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি।
সংকট স্বীকার করে দায়িত্বশীলরা বলছেন, কয়লার অভাবে একদিকে রামপাল আর অন্যদিকে পায়রা থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ মিলছে না। আবার ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারায় কয়লার আমদানিও হচ্ছে না পর্যাপ্ত। যে কারণে লোডশেডিং হচ্ছে সারা দেশেই।
এদিকে, আসছে এপ্রিলে গরমকাল, এর সঙ্গে যুক্ত হবে রমজান। উৎপাদন পরিস্থিতি এমন থাকলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। যদিও এই পরিস্থিতি কেটে যাবে- এমন আশা করছেন কর্মকর্তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল। গড়ে ওই সময় ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। এখন শীতের সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে দাঁড়িয়েছে ৯ থেকে ৭ হাজার মেগাওয়াটে। অথচ এটা সরবরাহ করা যাচ্ছে না। কেন সরবরাহ করা যাচ্ছে না এর উত্তর কে দিবে ?
আমাদের দেশের এক জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী ও সংসদ সদস্য মমতাজ বেগম বিদ্যুৎ নিয়ে জাতীয় সংসদে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেটি মুহুর্তেই সারা দেশব্যাপী ভাইরাল হয়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশে ফেরিওয়ালারা গ্রামে গ্রামে করে ফেরি করে বলে, চুরি ,বালা রাখবেন। শেখ হাসিনা আজ এমন করেছে যে, ফেরিওয়ালার মতো গ্রামে গ্রামে বলতে হচ্ছে বিদ্যুৎ রাখবেন ভাই, বিদ্যুৎ রাখবেন । আজ কিন্তু সেই বক্তব্য উপহাসে পরিণত হয়েছে। গেল গ্রীস্ম মৌসুমে বিদ্যুতের অভাবে দেশে অফিস সময় পর্যন্ত এগিয়ে আনা হয়েছিল। তখন সরকার বলেছিল, শীত মৌসুম আসতেই অবস্থার উন্নতি হবে। আসলে অবস্থার কতটুকু উন্নতি হয়েছে উপরের পরিসংখ্যান দেখলেই তা সহজে অনুমেয়।

বর্তমান প্রযুক্তির এই যুগে অবাধ বিদ্যুৎ প্রাপ্তি দেশের জনগনের একটি অন্যতম মৌলিক অধিকারের স্বরূপ।বিদ্যুৎ বিহীন বর্তমান বিশ^ কল্পনাই করা যায় না। বহুল প্রচলিত,আলোচিত ও সমালোচিত কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট করেও কিন্তু আমরা স্বস্তি খুঁজে পাইনি। কারণ, দেশের মানুষ কম বেশি সবাই জানে। পুরাতন কথা নতুন করে সামনে না এনে সংশ্লিষ্টদের বলতে চাই, এবার কিন্তু গ্রীস্মকালে পবিত্র রমজান মাস। শীতকালেই যেহেতু লোডশেডিং চলছে তাই গ্রীস্মকালে কি অবস্থা হতে পারে তা ভেবে দেশের মানুষ কিন্তু চরম আতঙ্কে রয়েছে। সুতরাং দেশের জনগণকে আতঙ্কমুক্ত রাখার জন্য এবং গ্রীস্মকালে যাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে আসছে আগামী পবিত্র রমজান মাসে যেন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকে সেই ব্যবস্থা এখনি শুরু করতে হবে। বিদ্যুৎ নিয়ে বহু পানি ঘোলা হয়েছে। এবার আর সেই ঘোলাটে পানি দেখতে চাই না। আমরা চাই বিদ্যুৎ এবং নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ।

লেখক : সাংবাদিক,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক।
০১৭১১-৩৮৮৩০৮
২৫.১.২৩