নগরীতে নির্মাণ কাজের অবহেলায় ১২ বছরে প্রাণ হারিয়েছে ৮, আহত অর্ধশত

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৪ মাস আগে
ঠাকুরপাড়ার একটি নয়তলা নক্সা অনুমোধনহীন নিমার্ণাধীন ভবন। যাকে সীমানা থেকে সঠিক দূরত্ব না রাখায় নোটিশ করেছে সিটি কর্পোরেশন।

 

#নির্মাণ কাজে অবহেলা মানে মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করা— সনাক সভাপতি

#যখন কোন অভিযোগ আসে, আমরা নোটিশ করি— নগর ভবন

#সিটি কর্পোরেশনকে সহযোগীতা করতে আমরা প্রস্তুত আছি—- জেলা প্রশাসক

আবু সুফিয়ান রাসেল।।
কুমিল্লা নগরীতে অপরিকল্পিত ও বিল্ডিং কোড না মেনে নির্মিত হচ্ছে প্রায় সাতশ’ বহুতল ভবন। নগরীর নির্মাণ কাজে গত ১২ বছরে আহত হয়েছেন অর্ধশতজন। নিহত হয়েছেন ছয় থেকে আট জন, ভোগান্তিতে শিকার নগরীর লক্ষ লক্ষ বাসিন্দা। নির্মাণকালীন সময়ের ভোগান্তির প্রসব বেদনার দায় নিতে চায় না নগর ভবন-প্রশাসন। লিখিত অভিযোগ দিয়েও স্থায়ী সমাধান পায়নি ঠাকুরপাড়ার এক বাসিন্দা। নগর ভবন বলছে, অর্গানোগ্রাম নেই, তাই তদারকি করা হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, সকল সহযোগীতার জন্য আমরা প্রস্তুত।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে ২০নং ওয়ার্ডের কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এক ব্যক্তির ভবন নির্মাণের সময় সেফটি ট্যাংকিতে আটকা পরে এক শ্রমিক নিহত হন। এ সময় তিনজন আহত হন।

২০১৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় রূপায়ণ গ্রুপের নির্মাণাধীন একটি ভবনের তিন তলার ছাদ ঢালাইয়ের সময় ছাদ ধসে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছেন আরও ২২ জন।

২০২০ সালের আগস্টে নগরীর ২৩ নং ওয়ার্ডের (কোটবাড়ি) চাঙ্গিনীর হাইস্যার কলোনিতে সিটি কর্পোরেশনের স্লাপবিহীন ড্রেনে পড়ে মৃত্যুর পর ভেসে উঠে রবিন নামের আট বছরের এক শিশুর লাশ।

২০২২ সালে নগরীর ৫নং ওয়ার্ডের হোমিও কলেজ সংলগ্ন একটি ভবন নিমার্ণের সময় এক শ্রমিক নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালে কাপ্তান বাজার এলাকায় একজন নিহত হয়েছেন। একই বছরের শেষের দিকে রাণীর বাজার মোড়ের একটি বহুতল ভবন নির্মাণের সময় একজন শ্রমিক নিহত হন।
স্থানীয় সাংবাদিক মাসুদ আলম বলছেন, মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়াতে শেষের তিনটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়নি।
সোমবার ২৭ মে নগরীর ২১নং ওয়ার্ডের শাকতলায় নির্মাণাধীন ভবনের পিলার টিনশেড স্কুলের টিনশেড একটি কক্ষে পড়ে মো. সাইফুল ইসলাম সাগর নামে ৫ম শ্রেণির এক ছাত্র নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন স্কুল শিক্ষক।

২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কু তদারকি অভিযানে বলেছেন, কুমিল্লা ট্রমা সেন্টার (হাসপাতাল)সহ নগরীর ৯০ শতাংশ ভবন নকশাবহির্ভূত। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কুসিকের উদ্যোগে এসব ভবন ভেঙে ফেলা হবে। ভবন কর্তৃপক্ষকে অর্থদণ্ড এবং সাজা দেওয়া হবে। সে সময়ে ৯টি ভবন সিলগালা করে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আর কোন দৃশ্যমান তদারকির কথা জানা যায়নি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কুমিল্লার সহকারী পরিচালক মোঃ তৌফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা এসব ভবন অগ্নিকাণ্ড ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে রয়েছে। ছাড়পত্র না নিয়েই নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব দেখবে সিটি কর্পোরেশন। অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে ছাড়পত্র প্রদান করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এটি ২০০৩ সালের একটি আইন। এছাড়াও সরকারি অন্যান্য দপ্তরের ছাড়পত্র লাগে। সব ঠিকঠাক থাকলে নগর ভবন কাজ চালু রাখবে, নয়তো বন্ধ করে দিবে।
কুসিকের প্রকৌশল বিভাগের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন প্রায় ৫০০টি ভবন নকশা বহির্ভূত। বিনা অনুমতিতে নির্মিত হচ্ছে ১৯৫টি বহুতল ভবন। এছাড়াও অতি পুরাতন এবং ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৯৫টি ভবন। নগরীর ১৯টি ভবনে লাল নোটিশ লাগানো হয়। নোটিশে লেখা হয়-‘ভবনটি নকশা বহির্ভূত।

নগরীর ২৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আজাদ বলেন, রাস্তায় ইট, বিলু, কংক্রিট রেখে দেয়। এসবের কারণে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। সিটি কর্পোরেশনের রাস্তায় মালামাল রাখা হয়, কতৃপক্ষ বিষয়টিতে নজর দেয় না।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সভাপতি রোকেয়া বেগম সেফালী বলেন, নির্মাণ কাজে অবহেলা মানে মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করা। বিষয়টিতে সিটি কর্পোরেশনের গুরুত্ব দিতে হবে। নয়তো নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকুক। মানুষের জীবনের দাম আছে।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী জি.পি. চৌধুরী বলেন, আমাদের এখনও অর্গানোগ্রাম হয়নি। যার কারণে সঠিক তদারকি করা হচ্ছে না। আমাদের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নেই, ফলে আমরা অভিযান পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসনের উপর নির্ভর। যখন কোন অভিযোগ আসে, আমরা নোটিশ করি।

নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার বাসিন্দা আদম সফিউল্লাহ বলেন, আমার প্রতিবেশী আবু তাহের নয়ন ইমারত আইন না মেনে, নকশা অনুমোদন ভাবে  ৯ তলা ভবন নিমার্ণ করছে। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন লিখিত অভিযোদ দিলে কোন স্থায়ী সমাধান পাইনি। অভিযোগ কোন দিলাম আমাকে গুম করার হুমকি দিয়েছে।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত পাপলা ভবনের ক্রয় সূত্রে জমির মালিক আবু তাহের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার নিকট আত্মীয় মো. সোহেলের ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়।

 

পরিবেশ অধিদপ্তর এর উপ পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজীব বলেন, পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায় না। অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিছু অভিযোগ পেয়েছি, সাথেসাথে নোটিশ করা হয়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছি, বহুতল ভবন তদারকি করার জন্য একটি পৃথক কমিটি। তারা বিষয়টি দেখবাল করবে।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু: মুশফিকুর রহমান বলেন, সোমবার যে স্কুল ছাত্র নিহত হয়েছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। বহুতল ভবনের অনুমোদন ও দেখবাল করা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। সিটি কর্পোরেশন যখন যে সহযোগীতা চাইবে আমরা প্রস্তুত আছি।