নিহত ইমুর হাতের নখের ডগার ‘স্কিন ডাস্ট’ই বের করে দিল আসল ধর্ষক ও খুনিকে

অবশেষে বরুড়ার শিশু ইমু ধর্ষণ ও হত্যার রহস্য উদঘাটন
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

শিশুর দুই আঙুলের নখের ডগায় ‘আণুবীক্ষণিক আলামত’। সেটা ফরেনসিক সদস্যদের চোখ এড়ায়নি। ধরা পড়ল ম্যাগনিফাইং গ্লাসে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এটি ‘স্কিন ডাস্ট’। সাধারণত কাউকে প্রবল প্রতিরোধের চেষ্টা করলে খামচির পর এই ধরনের ক্ষুদ্রকণা নখের ভেতরে আটকে যায়। অবশেষে ভিকটিমের পায়জামায় ঘাতকের শুক্রাণু ও ১০ বছরের এক শিশুর নখের ভেতরে থাকা এমন আলামতের ডিএনএ পরীক্ষার পরই এক খুনির ব্যাপারে নির্ভুল তথ্য-উপাত্ত পেল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

কুমিল্লার বরুড়ায় গত ডিসেম্বরে নাদিয়া সুলতানা ইমুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। শিশুটির গলায় ছিল ওড়না পেঁচানো; পায়জামা ছিল রক্তাক্ত। ওই সময় ম্যাগনিফাইং গ্লাসের মাধ্যমে সিআইডির ফরেনসিক দলের সদস্যরা শিশুটির নখের ভেতরে সামান্য ‘স্কিন ডাস্ট’-এর অস্তিত্ব পান। আট মাস পর ওই আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা শেষে একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির প্রোফাইল মিলল। ঘটনার পর ওই ব্যক্তিকে ঘিরে সন্দেহ ছিল ইমুর পরিবারেরও। এখন নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইমুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে জসীম উদ্দিন (২২)।

সিআইডির ডিএনএ বিশ্লেষক আশরাফুল আলম বলেন, শিশুটির নখের ভেতরে যে আলামত মেলে; এর ডিএনএ পরীক্ষার পর দেখা গেছে, সেটি এক পুরুষের। তখন আমরা নিশ্চিত হই, শিশুটির সঙ্গে বাইরের কারও সংস্পর্শ ঘটেছে। এ ছাড়া শিশুটির পায়জামায় শুক্রাণু পাওয়া গেছে। ঘটনার পর সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে যার কথা পরিবার বলেছিল, তার কাছ থেকে রক্ত সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। এতে শিশুটির নখ ও পায়জামায় পাওয়া আলামতের সঙ্গে জসীম নামে ওই ব্যক্তির নমুনা শতভাগ মিলেছে। আশরাফুল আলম বলেন, যেসব চাঞ্চল্যকর ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াও অন্য আলামতের অকাট্য প্রমাণ থাকে না, সেখানে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন ন্যায়বিচার নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানভিত্তিক এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষাই আধুনিক বিশ্বে তদন্তের সবচেয়ে কার্যকর অনুষঙ্গ।

ইমুর মা মনজুমা বেগম জানান, দুই মেয়েকে নিয়ে তাঁর কষ্টের সংসার। স্বামী আলাদা সংসার পেতে এখন কক্সবাজারে থাকে। মনজুমা বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করে দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বরুড়ার স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত ছোট মেয়ে ইমু। আর বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। পরীক্ষা শেষে ১২ ডিসেম্বর বরুড়ায় খালার বাড়ি বেড়াতে যায় ছোট মেয়ে। মনজুমাদের বাড়ি থেকে তাঁর বোনের বাসার দূরত্ব আধা কিলোমিটারের মতো। খালার বাড়িতে যাওয়ার এক দিন পর ১৪ ডিসেম্বর সকালে ইমুর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। আশপাশে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওই এলাকার ভূঁইয়াবাড়ির উত্তর পাশে আবদুল লতিফের বাঁশবাগানের ভেতরে তার লাশ পাওয়া যায়। এরপর সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা খবর পেয়ে আলামত সংগ্রহ করেন।

মনজুমা আরও জানান, ঘটনার দিন অনেক খোঁজাখুঁজির সময় তাঁর বোনের প্রতিবেশী অটোরিকশাচালক জসীমও এসে সমবেদনা জানায়। তার ফেসবুকে শিশুটির ছবি পোস্ট করে খোঁজ চেয়েছিল সে। ইমুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নানা জায়গায় খোঁজাখুঁজিতে অংশ নেয় জসীম। যদিও ঘটনার পরপরই এলাকার কেউ কেউ বলছিলেন, জসীমের পেছনে পেছনে ইমুকে যেতে দেখেছেন তাঁরা। কেউ কেউ জসীমের কাছে ওই শিশুর পরিচয় জানতে চাইলে ‘খালাতো বোন’ দাবি করেন।

পুলিশ ও নিহতের স্বজনরা জানান, কিছু কেনাকাটা করতে ঘটনার দিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তার বোনের ছেলে রবিউল আলম। ফিরতে দেরি দেখে রবিউলকে খুঁজতে ইমুকে বাড়ির সামনে দোকানে পাঠান মনজুমার বোন। তখন শিশুটির ওপর নজর পড়ে জসীমের। খালাতো ভাইয়ের সন্ধানের ব্যাপারে জসীমের কাছে জানতে চায় ইমু। তখন জসীম জানায়, তার সঙ্গে সামনে এগোলেই রবিউলকে পাওয়া যাবে। এভাবে টোপ দিয়ে স্থানীয় একটি বাঁশবাগানে নেওয়া হয়। সেখানে তার ওপর বর্বর আচরণ করে জসীম। বাঁচতে শিশুটি জসীমকে কয়েকটি খামচি মারে। এ ঘটনা বাড়ি গিয়ে খালা ও মাকে জানিয়ে দেবে– এটা বলার পর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ইমুর মৃত্যু নিশ্চিত করে জসীম।

মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, ঘটনার পর সন্দেহভাজন হিসেবে জসীমকে গ্রেপ্তারের পর এলোমেলো বক্তব্য দিতে থাকে। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার পর সব রহস্যের জট খুলে গেল। তবে আট মাসেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়া যায়নি। এ কারণে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এলেই দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

ডিএনএ পরীক্ষায় খুনি ও ধর্ষকের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সামনে আসার খবরের ব্যাপারে জানতে চাইলে ইমুর মা মনজুমা বলেন, ‘মেয়েটিকে এত কষ্ট দিয়ে হত্যার পর ঘাতক কত নাটক করেছিল! ওর নিজেরও ছোট্ট একটি মেয়ে আছে। কীভাবে আমার মেয়ের সঙ্গে জঘন্য কাজ করতে পারল। দুই মেয়েকে নিয়ে কত আশা ছিল! কত স্বপ্ন ছিল! সব শেষ করে দিল।’