অরক্ষিত কুমিল্লার ৩৫ টি বধ্যভূমি

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞের জ্বলন্ত সাক্ষী হয়ে আছে কুমিল্লার প্রায় ৫০টি বধ্যভূমি। এ মাঝে অরক্ষিত রয়েছে প্রায় ৩৫ টি বধ্যভূমি। এ জেলায় মুক্তিযোদ্ধা,জেলা প্রশাসক,পুলিশ সুপারসহ নানা পেশার হাজার হাজার মানুষকে সর্বত্র নারকীয় তান্ডবের মাধ্যমে গণকবর দেয় পাক বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরেও এসব গণকবর ও বধ্যভূমির অধিকাংশ এখনও শনাক্ত কিংবা সংরক্ষণ করা হয়নি। অবহেলা-অনাদরে অধিকাংশ বধ্যভূমির স্থান ঝোপ-জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। অনেকটিরই চিহ্ন ও নেই, জানা নেই শহীদদের সংখ্যাও ।
তবে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিস বলছে,৩২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে,সেখানে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। বাকিগুলো সরকারি সহযোগিতা পেলে চিহ্নিত করা হবে। এছাড়া জেলাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ তরুণ-তরুণীর কাছে।
স্বাধীনতার ৫১ বছরে আবিষ্কৃত এ জেলার গণকবর ও বধ্যভূমির মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার রসুলপুর বধ্যভূমি, রামমালা বধ্যভূমি,সদর দক্ষিণের জগতপুর গণকবর, চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা গণকবর, নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি, দেবিদ্বার বধ্যভূমি, লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি ও কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি ইত্যাদি।
রবিবার শহরে বাইরে বিভিন্ন এলাকা গিয়ে দেখা যায়, কিছু বধ্যভূমিতে স্মৃতিফলক লাগানো হয়েছে,কোনটায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সংরক্ষণ করা গণকবর আর বধ্যভূমিগুলোর বেশিরভাগই এখন বেহাল অবস্থায়। এছাড়া অনেক বধ্যভূমিগুলো স্থানীয়রা দখল করে কৃষি কাজে ব্যবহার করছে। অবকাঠামোগত দিক থেকে কোনটার অবস্থা একেবারেই নাজুক। আবার অরক্ষিত অবস্থায় থাকা বেশ কয়েকটি বধ্যভূমি পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে।
তেমনি একটি জেলার সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউনিয়নের রসুলপুল গ্রামের রেলস্টেশন পাশে অবস্থিত রসুলপুল বধ্যভূমি। এ বধ্যভূমি কৃষি কাজে ব্যবহার করছেন শিল্পী নামের স্থানীয় এক নারী,বধ্যভূমিতে ছড়িয়ে আছে খড়ের মেলা। এছাড়া এ বধ্যভূমিতে লাগানো সাইনবোর্ডটাও ঢেকে আছে খড়ের কারণে ।
জানতে চাইলে শিল্পী বেগম বলেন,এখানে মাদকের আসর বসে প্রতিদিন। ডিসেম্বর মাস আসলে দুই-একজন লোক শহর থেকে আসে। সারা বছর তো কারোর কোন খবর দেখি না । এখন আন্নেরা খবর নিয়া কি করবেন।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমি : ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক পূর্বদেশ’এর এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমিতে বাঙালি অফিসার, সৈনিক, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ, মসজিদের ইমাম কেউ রক্ষা পায়নি। এখানে ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অমানুষিক নির্যাতনের পর এই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টেই হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এ বধ্যভূমিতে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে সাত হাজার নর কঙ্কাল পাওয়া যায়।’
লাকসাম রেলস্টেশন বধ্যভূমি:
এটি কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে কেবিন বরাবর পূর্ব দিকে এ বধ্যভূমিটির অবস্থান। কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশ,বৃহত্তর নোয়াখালী এবং চাঁদপুরের বাঙালি যুবক-যুবতী, বৃদ্ধা, শিশুদের এখানে এনে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। জীবিত মানুষদের হাত-পা বেঁধে গুলি করা হতো। এরপর লাথি দিয়ে ফেলা হতো গর্তে। গুলি খাওয়ার পরেও যারা জীবিত থাকতেন, তাঁদেরও মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এখানে বিভিন্ন জেলা থেকে ১০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ মাটি চাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
মুদাফফরগঞ্জ বধ্যভূমি:
কুমিল্লার মুদাফফরগঞ্জের একদল রাজাকার ও পাকিস্তানি বাহিনী ৩৭ জন লোককে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই থেমে থাকেনি, তারা একটি বাড়ি থেকে চারজন বালিকাকে ধরে নিয়ে গণধর্ষণ করে। তিন-চার দিন পর তাঁদের মৃতদেহ পাশের একটি খালে ভাসতে দেখা যায়।
হাড়ং গণকবর:
কুমিল্লার চান্দিনার হাড়ং গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ির পাশে তাঁর এক খণ্ড জমি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা গণকবর হিসেবে ব্যবহার করত। হত্যার পর এখানে মাটিচাপা দিত। আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার মাকেও এখানে হত্যার পর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা এখানে মাটিচাপা দেয়। জানা যায়, ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে গণকবর দেওয়া হয়।
আমড়াতলি গণকবর:
১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার আমড়াতলির ধনঞ্জয় খন্দকার বাড়ির ২৬ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। খন্দকারবাড়ি ছাড়াও অন্যান্য স্থানে হত্যা করা হয় আরও ১০ জনকে। হত্যার পর আমড়াতলিতে গণকবর দেওয়া হয়।
বেতিয়ারা গণকবর
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। ১৯৭১ সালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীরযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেওয়া হয়। বেতিয়ারার শহীদদের কবরটি এখন আগের জায়গায় নেই। মহাসড়কের চার লেনের কাজ হওয়ায় বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি:
৭১ সালের ২৪ জুলাই পাকিস্তানি হায়েনারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ২৩ জন নিরীহ বাঙালিকে দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিতে ধরে আনে হানাদার বাহিনী। পথিমধ্যে ৩ জন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বাকি ২০ জনকে চোখ বেঁধে ব্রাশ ফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে গর্ত খুঁড়ে এখানে মাটি চাপা দেয়।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি:
নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমির তিনটি কবরে সমাহিত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
রসুলপুর বধ্যভূমি:
কুমিল্লা জেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রসুলপুর রেলস্টেশন। ১৯৭১ সালে এ স্টেশন ছিল পাকাহানার বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হায়নারা ৫ শতাধিক নিরীহ নারী-পুরুষ ও মুক্তিযুদ্ধাদের হত্যা করে স্টেশনের অদুরে একটি টিলাতে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। পরে এটিকে বধ্যভূমি হিসেবে স্বীকৃত দেয়া হয়। ২০০৫ সালে বধ্যভূমিটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
রামমালা বধ্যভূমি
নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভিতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায় তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ, আনসারদের হত্যা করে। পরে গর্ত করে গণকবর রচনা করে যায় হানাদার বাহিনী। স্থানীয় সূত্র মতে, এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ’ লোকের সমাধি।
কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি: এটি কুমিল্লা সদরের পাচঁথুবী ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় এলাকায় এ বধ্যভূমিটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এ এলাকায় বসবাসরত শিশু-নারী, কৃষকসহ ৩৭ জনসাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করে ঘাতক হানাদাররা। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১৬ জুন জায়গাটি চিহ্নিত করে এখানে একটি স্মৃতিফলক করা হয়। যদি এটি চিহ্নিত হওয়ার পর থেকে আর কোনো সংস্কার হয়নি।
কোটেশ্বর যুদ্ধ স্মৃতি:
ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কোটেশ্বরে হানাদার বাহিনীর এক সদস্যকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। এর পর মরিয়া হয়ে উঠে পাক হানাদার বাহিনী। হামলা চালায় ওই গ্রামের নীরিহ জনতার উপর। হত্যা করে বেশ কয়েকজনকে। পরবর্তীকালে স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা এ.এন.এম ওয়াহিদুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মহানমুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই স্থানটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০১০ সালে ২৭ মার্চ তৎকালীন প্রশাসক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব ওমর ফারুকের উদ্যোগে কোটেশ্বর গ্রামের ত্রিমুহনায় ‘প্রতিরোধ’ নামে একটি স্মৃতি ভষ্কর্য প্রতিষ্ঠা করে জেলাপরিষদ। যথাযথ যত্নের অভাবে এর সৌন্দর্য ম্লান হতে চলেছে।
জগতপুর গণকবর:
এদিকে এটি একটি অমিমাংসিত ইস্যু হয়েই রয়ে গেছে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার জগতপুর গণকবর। ১৯৭১ সালের ওই দিনে একটি যাত্রীবাহী বাসে হামলার ঘটনায় বেশকিছু লোক নিহত হয়। ওইসব বেওয়ারিশ মরদেহ পরিচয় নিয়ে রয়েছে ভিন্ন মত। স্বাধীনতার এত বছর পরও জগতপুর গণকবরের মরদেহের পরিচয় নিয়ে ধোয়াশা কাটেনি। কারও কারও মতে ওই বাসে রাজাকাররা পালাচ্ছিল। আবার অনেকের দাবি বাসে ব্যবসায়ীসহ মুক্তিকামী মানুষ ছিল। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখনো অমিমাংসিতই রয়ে গেলো।
চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমি: কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে প্রতিদিন অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করা হতো। স্থানীয় মানুষজন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে চলে এখানে হত্যাযজ্ঞ।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সহযোগিতা বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু করছি। সর্বশেষ শহরের রামমালা বধ্যভূমি কাজ চলমান রয়েছে। সরকারি সহযোগিতা পেলে সকল বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সংরক্ষণ ও সীমানা প্রাচীর দেওয়া হবে।