ইডেন থেকে ইবি, এ লজ্জা কোথায় রাখি?- শাহাজাদা এমরান

সময়ের কথা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের কথা। ছয় মাসও হয়নি। দেশের স্বনামধন্য নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইডেন মহিলা কলেজে সেদিন দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের উপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
রুমে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন করেছিল। ছবি তুলেছিল বিবস্ত্র করে। কলেজের তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভা ও সাধারণ সম্পাদক রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক সম্পাদক সামিয়া আক্তার ওরফে বৈশাখী তৎসময়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেত্রীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, এই ছাত্রলীগের দুই নেত্রী ছাত্রীদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করায়।
তাদের কথামত দেহ ব্যবসা না করলে শুরু করে নির্মম নির্যাতন ইত্যাদি। এই ঘটনা তৎকালীন সময়ে দেশ ব্যাপী তুমুল ন্যাক্কারজনক আলোচিত ও সমালোচিত হয়। দেশময় রব উঠে ছি:ছি: শদ্ধের।

কতিপয় কয়েকজন ছাত্রলীগের নেত্রীর জন্য সে সময় ইডেনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী,অভিভাবক ও শিক্ষকগণ লজ্জায় মুৃখ লুকাতে চেষ্টা করেছিলেন। কারণ, দেশের অন্যতম সেরা এক মহিলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ছাত্রী আরেক ছাত্রীকে দিয়ে দেহ ব্যবসা করায়, পবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করে।
বেশ কিছুদিন গণমাধ্যম গুলোতে তোলপাড় হওয়ার পর এক সময় অন্য দশটা ঘটনার মতই এটিও মিলিয়ে যায় দক্ষিণা বাতাসে।

ইডেন কলেজের সেই লজ্জাজনক ও ঘৃনিত ঘটনার ছয় মাসও অতিবাহিত হয়নি। এরই মধ্যে এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো দেশের আরেকটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
দেশের সাধারণ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তুলনামুলক ভাবে কিছুটা শান্ত হবে,শালিন হবে, ঈমান ও আকিদা নিয়ে বেশী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু না। আমাদের ছাত্রলীগের ছাত্রী বোনদের আচার আচরণ দেখে মনে হলো, ইডেন কলেজের দলীয় ছাত্রী নেত্রীদের সাথে তারা প্রতিযোগিতা করে নেমেছে যে, কারা কত বেশী নোংরামী,নষ্টামী ও ভাদ্রামী করতে পারে,দেখাবে।
ভাবতে খুব অবাক লাগে যে, এই জন্যই কি বাবা মা এত কষ্ট করে তার মেয়েকে দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠায় পবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অপবিত্র করার জন্য। আহা ! বড়ই আফসোস লাগে আমাদের দলীয় লেজুরবৃত্তিকারী কতিথ এ ছাত্র রাজনীতির জন্য।

জানা যায়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের গণরুমে ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে গত ১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার দিবাগত রাতে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী। নির্যাতনের পর তাকে বিবস্ত্র করে ছবি উঠিয়ে রেখে বলেছে, প্রশাসন জানলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়া হবে।

ভুক্তভোগী ঐ ছাত্রীর বরাতে গণমাধ্যম গুলো জানায়, ইবি শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা তাকে নির্যাতন চালিয়েছেন। নির্যাতনের সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এই ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
ওই ছাত্রী ১৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অপর অভিযুক্ত তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের।

ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যে আরো জানা যায়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার ইবির প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য পাবনার মেয়ে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে ওঠেন। পরদিন ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার তাবাসসুম নামের এক ছাত্রলীগ নেত্রী তাঁর কক্ষে দেখা করতে যেতে বলেন। কিন্তু অসুস্থ থাকায় যথাসময়ে দেখা করেননি ভুক্তভোগী ছাত্রী।
১১ ফেব্রুয়ারি শনিবার দিবাগত রাতে ঐ ছাত্রী দেখা করেন ছাত্রলীগের ঐ নেত্রীর সাথে। অনুমতি না নিয়ে গণরুমে উঠার কারণ জিজ্ঞেস করেই তাঁর ওপর চড়াও হন তাঁরা। পরে ছাত্রলীগের অপর নেত্রী তাবাসসুমের কক্ষে গেলে ভয়ভীতি দেখান এবং হল থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেন। তাঁরা বলতে থাকেন, তাঁদের না জানিয়ে কেন তিনি হলে উঠেছেন। সেখানে কথায় কথায় এলোপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকেন।

আপনারা আমাকে কেন মারছেন, নির্যাতিত ছাত্রী এ কথা বলতে গেলে সানজিদা ও তাবাসসুম আমার মুখ চেপে ধরেন এবং সজোরে থাপ্পড় মারতে থাকেন। তাঁরা বলতে থাকেন, “চিনিস আমাদের, আমরা কত খারাপ? আমরা তোর কী করতে পারি জানিস তুই? কোনো আইডিয়া আছে আমাদের সম্পর্কে তোর?” পা ধরে মাফ চাইতে গেলে লাথি মারেন।

আর অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। বুকের ওপর হাত দিয়ে জোরে থাবা মারেন এবং গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখেন। একপর্যায়ে তাঁরা একটা ময়লা গ্লাস তাঁকে দিয়ে চেটে পরিষ্কার করিয়ে নেন এবং সেটার ভিডিও ধারণ করেন। তারপর তারা বলতে থাকেন, “জামা খোল”, জামা খুলতে না চাইলে তাঁরা আবার মারধর শুরু করেন এবং জোর করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেন।’
এক পর্যায়ে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা বলেন, ‘তুই যদি প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ দিস, তাহলে তোকে মেরে কুত্তা দিয়ে খাওয়াব, যা বলেছি তা মনে থাকে যেন!’ নির্যাতন শেষে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে অন্য একটি গণরুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
গেল বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকা ইডেন কলেজে ঘৃনিত ঐ ঘটনাটি সারা দেশে যে ভাবে নিন্দার ঝড় বইছিল তখন অনেকেই মনে করেছিল, ছাত্রলীগের ছাত্রী নেত্রীরা মনে হয় ইডেন থেকে শিক্ষা নেবে। এই ধরনের ঘটনার আর পূনরাবৃত্তি করবে না।

শত ভাগ ভালো না হলেও নোংরামীটা কমাবে। কিন্তু কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে শুধু মাত্র তাদের না বলে গণরুমে উঠার অপরাধে নির্মম নির্যাতন করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি,শরীরের সকল কাপড় খুলে ছবি তুলে ভিডিও করে রেখেছে। আচ্ছা, আমি জানতে চাই, ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা এবং তাবাসসুমরা কি মেয়ে না। একজন মেয়ে হয়ে কিভাবে পবিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অপর মেয়েকে বিবস্ত্র করে, স্পর্শকাতর জায়গায় থাবা দেয়। ছি.ছি.ছি। এর শেষ কোথায় ?

এখনতো দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কোন ছাত্রসংগঠনগুলো নেই। হল গুলোতে সহঅবস্থান তো আজ কল্পনা করাও অসম্ভব। তারপরেও কেন ছাত্রলীগ এমন করছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের কতিপয় ছাত্রীরা নেত্রীরা কেন আজ সভ্যতা ,ভব্যতা ভুলে নিজের নারীত্বের অহংকারকে বিসর্জন দিচ্ছে।
কেন এক ছাত্রলীগ নেত্রী অপর ছাত্রলীগ নেত্রীকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করে, বিবস্ত্র করে ছবি ভিডিও করে। তারা কি একবার ভেবে দেখেছে যে, একই এমন নোংরা কাজটি যদি অপরজন তার সাথে করে তখন তার কেমন লাগবে।
আমি অবশ্যই বলছি না যে, ছাত্রলীগের সকল নেত্রীরাই এরকম। মাত্র কতিপয় কয়েকজন ছাত্রী নেত্রীর জন্য দেশের সবচেয়ে প্রাচীনতম ছাত্রসংগঠন, স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ কেন এর দায় নিবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা ছাত্রলীগ হয়তো মিডিয়ার গরম গরম ভাব থাকা অবস্থায় দায়সারা গোছের কিছু ব্যবস্থা নিবে।

কিন্তু এই দায়সারা গোছের ব্যবস্থা দিয়ে মাথা ব্যাথা যাবে না। মাথা ব্যাথাটি ইতিমধ্যে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে ক্যানসারে রুপ নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমি মাথা কেটে নেওয়ার কথা বলছি না।
তবে এমন চিকিৎসা করাতে হবে যাতে একই ব্যাথার পূনরাবৃত্তি না হয়।
সরাসরি বলেই লেখাটি শেষ করছি। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী মাননীয় প্রধান মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভানেত্রীকে বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে বলব, দুষ্ট গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল অনেক ভালো ও নিরাপদ।

একজন নারী হয়ে যে সকল ছাত্রী অপর নারীর চরিত্র হরণ করে বিবস্ত্র করে তাদের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখান প্লিজ। ছাত্রলীগ একটি বিশাল মহা সমুদ্র। এই মহাসমুদ্র থেকে কয়েক বালতি পানি সরে গেলে সমুদ্রের বিশালতা কোন ভাবেই কমবে না বৈ বাড়বে।

আমরা আর ছাত্রলীগের ছাত্রীদের এই কলংকজনক খবরের শিরোনাম দেখতে চাই না, চাই না।