কুবির ভিসির প্রত্যাশা ও আমার ৩৫ বছর আগের স্বপ্ন – শাহাজাদা এমরান

সময়ের কথা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

সোমবার (১৩ মার্চ-২০২৩) কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের (কুবি) ভিসি ড. এ এফ এম আব্দুল মঈন স্যারের সাথে আমরা চারজন সাংবাদিক সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ব্যস্ততার মধ্যে থেকেও আমাদের সময় দিলেন। কুবির সাংবাদিক সমিতির অনুষ্ঠানে এক সাথে বসে মঞ্চে বক্তৃতা করা এবং শোনার স্মৃতি হয়তো তিনি ভুলেননি। আর দৈনিক আমাদের কুমিল্লায় সর্বশেষ কয়েকটি নিউজ ওনার বিপক্ষে যায়। যদিও আমাদের কুমিল্লা সংবাদ করার ক্ষেত্রে সব সময় বস্তুনিষ্ঠতা ধরে রেখেই নিউজ করে থাকে। তাই সহকর্মী সোহাগ যখন ভিসি মহোদয়ের হাতে আমাদের কুমিল্লার একটি কপি দিলেন তখন লক্ষ্য করলাম তিনি ক্ষনিক সময়ের মধ্যেই একবার পত্রিকার দিকে আর একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। তখন বললাম, স্যার এটা আমিই চালাচ্ছি, আপনার অনেক নিউজ ছাপা হয়েছে। মাথা নেড়ে বললেন ,দেখেছি, আমি জানি।

যাইহোক ভিসি মহোদয় নিজেই কথা শুরু করলেন বিশ^বিদ্যালয়ের চলমান অস্থিরতা নিয়ে। পরবর্তী সভায় যোগ দেওয়ার জন্য স্যারের পিএস বারবার তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু স্যার কথা চালিয়েই যাচ্ছিলেন। কিছুটা ক্ষোভ, কিছুটা আবেগ, কিছুটা হতাশার সাথে আশার কথাও শোনালেন। লক্ষ্য করলাম এক পর্যায়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে গভীর হতাশার সুরে বললেন, দেখেন, বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র ভিসি যিনি কিনা ভিসি হওয়ার আগে দেশের বাহিরের বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা করে আসছি। সেখানে অনেক উচ্চ বেতনের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে দেশে এসেছি দেশমাতৃকার সেবা করার জন্য। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে কুবির ভিসি করার পর অনেক বড় আশা নিয়ে যোগ দিয়েছি কুবিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাব বলে। কিন্তু আমাদের দেশের হতাশাজনক ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি আমাকে বারবার বাধাগ্রস্থ করছে। তারপরেও এখন পর্যন্ত অন্যায়ের সাথে আপোষ করিনি। এই পর্যন্ত যে নিয়োগগুলো হয়েছে একটি নিয়োগেও অসুদাপায় অবলম্বন নিজে করিনি এবং অন্যকেও করতে দেইনি। ফলে যারা এতদিন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছে তারা আমার বিপক্ষে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আপনি বিশ^বিদ্যালয়ে নিজের লোকদের নিয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে প্রতিবেদকের এ কথার জবাবে কুবি ভিসি সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ওবামা যাদের নিয়ে কাজ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কি তাদের নিয়ে কাজ করবেন ? তাহলে কি তার সরকার চলবে। সবাই সবার বিশ^স্ত লোকদের দায়িত্ব দিয়ে কাজ করাবেন। যাতে তার কাজটা শত ভাগ আদায় হয়। ঠিক তেমনি একটি বিশ^বিদ্যালয় শান্তিপূর্ণভাবে চালাতে হলে প্রক্টর হতে হবে ভিসির খুবই আস্থাভাজন। প্রক্টর ঠিকভাবে কাজ না করলে শান্তিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে থাকবে না, ক্যাম্পাসে লাশ পড়বে। আমি আমার আস্থাভাজন প্রক্টর নিয়েছি বলেই তো ঐ দিন এতবড় ঘটনার পরেও লাশ পড়েনি।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আগে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা উচিত প্রতিবেদকের এই কথাতেও সহমত পোষন করে কুবি ভিসি বলেন, আমি দীর্ঘ দিন দেশের বাহিরে নামকরা বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা করেছি। কোথায়ও দেখিনি শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়াশুনার বাহিরে আর কোন কিছু চিন্তা করতে। বিদেশে দেখেছি শিক্ষকরা ক্লাশ রুমে ক্লাশ নিতেন আর বাকি সময় গবেষনা করতেন কি করে আগামী দিন শিক্ষার্থীদের আরো ভালো করে ক্লাশ করানো যায়। শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতি যে কুবিকে অস্থির করে তুলছে তা বলতেও দ্বিধা করেননি কুবি ভিসি। দু:খ ও গভীর হতাশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, প্রতিদিন আমি যদি এই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্থ থাকি তাহলে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে কাজ করব কখন ? কুবি ভিসি ড. আব্দুল মঈন আক্ষেপ করে বলেন, সারা জীবন শুনে আসছি ছাত্ররা পরীক্ষা পিছানোর জন্য আন্দোলন করে। আর কুবির ছাত্ররা পরীক্ষা সেমিস্টার কয়েকদিন এগিয়ে আনার জন্য মিছিল করার অপরাধে তাদেরকে ভাইভায় জিরো দেওয়া হয়েছে। এই কাজটা কিন্তু আমরা শিক্ষকরাই করেছি।

কুবির ভিসি মহোদয় অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে থেকে কথাগুলো বললেও আমি খুব মনোযোগসহকারে শুনছিলাম কথা গুলো। তিনি যখন এক পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন তখন ক্ষনিকের জন্য হলেও আজ থেকে ৩৫ বছর আগের একটি ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে আসছিল। তখন আমি নারায়নগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার বৈদ্যের বাজার এন এ এম পাইলট হাই স্কুলের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র। তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলন দেশে। এরই মধ্যে আওয়ামীলীগ বিএনপিসহ দেশের প্রথম শ্রেণীর সকল রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্যে দিয়ে চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে শিক্ষকরাও আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে কর্মসূচি দিচ্ছিল। তখন আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন (দু:খিত এই মুহুর্তে স্যারের নামটি মনে আসছে না) আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের বড় নেতা। স্যার থাকতেন আনন্দ বাজার সংলগ্ন টেঙ্গারচর গ্রামে। স্যারের কাছে আমি প্রাইভেট পড়তাম। সুতরাং স্যারের রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে একদিকে আমার প্রাইভেট পড়ায় বিঘœ ঘটতো অপর দিকে স্যার আমাদের ৮ম শ্রেণীতে বাংলা ক্লাশ নিতেন। তাই স্কুলে অনুপস্থিতির কারণে আমাদের বাংলা ক্লাশও বন্ধ থাকত। তাই আমি স্যারের এই রাজনীতি নিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত হতাম। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতাম না। ব্যক্তি হিসেবে স্যার খুব ভাালো মানুষ ছিলেন। কিছু বুঝে না বুঝে একদিন স্যারকে বললাম, স্যার, আপনারা যারা স্যার তারা রাজনীতি না করলে হয় না? স্যার চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর সমস্যা কি? স্যারের ভয়ার্ত চোখ রাঙ্গানিতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। পরে আমতা আমতা করে বললাম, স্যার কোন সমস্যা নেই। এমনিতেই বলছি। সেই দিন থেকে শিক্ষকদের সরাসরি রাজনীতি করা নিয়ে বিশেষ করে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকগণের রাজনীতি করা নিয়ে আমার মধ্যে এক নেতিবাচক ধারণা হয়ে বেড়ে উঠছে। পরবর্তী পর্যায়ে কলেজ জীবন এবং এরপর পেশাগত জীবনে এসে দেখেছি শিক্ষকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করার অভিশাপের দিকগুলো।

আজ ছাত্র রাজনীতির যে কুফল সারা দেশে বিরাজমান তার মুলে রয়েছে ঘুণে ধরা শিক্ষক রাজনীতি। কারণ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বিএনপিপন্থী শিক্ষকগণ যেমন ছাত্রদলের বাহিরে যেতে পারবে না ঠিক তেমনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকরাও ছাত্রলীগের অবাধ্য হতে পারবে না। আবার এই শিক্ষকরাই নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য দুই ভাগ হয়ে অনুগত ছাত্র সংগঠনকেও দুই ভাগ করে দেয়। কলেজ কিংবা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যেমন হালুয়া রুটির আশায় নিজেদের কায়েমী হীন স্বার্থ হাসিল করার জন্য তাদেরই প্রতিদ্ব^ন্দ্বী শিক্ষক সহকর্মীদর উপর ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে ক্ষনিক সময়ের জন্য তৃপ্তির ঢেকুর দেয়। আবার সুবিধাভোগী শিক্ষক নামধারী তথা কথিত ঐ শিক্ষক নেতাদের প্রশ্রয়ে ঐ ছাত্ররা যখন বেপরোয়া হয়ে উঠে এক সময় নিজের (শিক্ষক) কাঁধে চড়ে বসে তখন আর তাদের ভালো লাগে না। তখন ছাত্র রাজনীতির দূষিত বাতাস নিয়ে তারা কথা বলেন। ছাত্র রাজনীতির অতীত গৌরব জাতিকে স্মরণ করে দেন।

সুতরাং শিক্ষক রাজনীতির কুফল নিয়ে কুবি ভিসি মহোদয় যখন কথা বলতেছিলেন তখন ৩৫ বছর আগের নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে মনে মনে বলি, স্যার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার কথা বলছেন আপনি বিদেশে পড়ে এবং পড়াইয়ে। দেশে এসে ভিসি হয়েছেন। আর আমি অধম, নাখান্দা, স্বল্প শিক্ষিত ও কম জানা দেশের এই ক্ষুদ্র নাগরিকটি আজ থেকে ৩৫ বছর আগেই এই শিক্ষক রাজনীতির কুফল অনুধাবন করে এটি বন্ধের একক একাকিত্ব আন্দোলন করে আসছি। গত ২৯ বছরের পেশাগত জীবনে এই হীন শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে বহু কলাম লিখেছি এবং আল্লাহর রহমতে এখনো লিখছি।

কুমিল্লা বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি ড. মঈন স্যার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধের যে প্রত্যাশা করছেন আমি চাই সারা দেশে এটি সামাজিক প্রত্যাশায় পরিণত হোক। আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হোক আদর্শ শিক্ষকদের উর্বর ভুমি হিসেবে। শিক্ষক রাজনীতির কালো ধোয়া যেন আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর না পড়ে সেটিই আজ বড় প্রত্যাশা দেশ তথা জাতির।