কপ-২৮ জলবায়ু পরিবর্তনে আশাবাদ

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

আরব আমিরাতের দুবাইয়ে হয়ে গেল জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন (কপ -২৮)। এ শীর্ষ সম্মেলনকে ঘিরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল জলাবায়ুর অভিঘাত থেকে পরিত্রাণ পেতে কি খবর আসে। ৩০শে নভেম্বর’২৩ থেকে জলবায়ু বিষয়ক এ সম্মেলন চলেছে ১২ ই ডিসেম্বর’২৩ পর্যন্ত। এবার দৃষ্টি নিবন্ধন করা হয়েছিল চারটি বিশেষ পরিবর্তন এর উপর Ñ ১। জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে বেরিয়ে আসার কার্যক্রম ত্বরাণি¦ত করা ২। জলবায়ু অর্থ ব্যব¯’ার রূপান্তর ৩। জলবায়ুর পরিবর্তন সামলাতে জনগণ ও প্রকৃতির ভূমিকা ৪। আদিবাসী, নারী, ¯’ানীয় সম্প্রদায়, তরুনদের শীর্ষ সম্মেলনে অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা। ১৭৬০ সালে ইউরোপ শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই প্রকৃত অর্থে কার্বন নিঃসরণ শুরু হয়, যা বাতাসের উষ্ণতা ও বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক শতকেই ভূ-তাপমাত্রা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়ে। গবেষকদের ধারণা জলবায়ুর এ পরিবর্তনের প্রভাবে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতা ১ মিটার বেড়ে যাবে। আশঙ্কা হ”েছ একবিংশ শতাব্দী শেষে অন্ততঃ ৪৩ টি দেশ সমুদ্রপৃষ্ঠে হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ডুবে যাবে। অথচ যেসব দেশ এজন্য দায়ী, তারা এখনও নির্বিকার। পরিসংখ্যানে জানা যায়, চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত গোটা বিশে^র ৫৫ শতাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে। অন্যদিকে অনুন্নত দেশগুলোর দায় একেবারেই নগণ্য।
বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে পর্যায়ক্রমে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধের দাবি জোরদার হ”েছ। তবে এমন দাবির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই বলে মন্তব্য করেন চলমান জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৮) প্রেসিডেন্ট সুলতান আহমেদ আল জাবের, কনফারেন্স অব পার্টিজ (কপ) সম্মেলনের প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্য বড় ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য সমালোচনার মুখে আগের অব¯’ান থেকে পিছু হটেছেন সুলতান আহমেদ। পরবর্তীতে বলেন, পর্যায়ক্রমে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার কমিয়ে আনা ‘অনিবার্য’। ৫ই ডিসেম্বর’২৩ এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, জীবাশ্ম জ¦ালানীর মাধ্যমে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ চলতি বছরে নতুন রেকর্ড গড়ছে। এটা অব্যাহত থাকলে সাত বছরের মধ্যে বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ গবেষকরা কপÑ২৮ সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলোকে তেল, কয়লা ও গ্যাস দূষণের বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নেয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। একটি খসড়ায় এ আশাবাদ চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌছার জন্য সবাই উৎসুক। এতে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার সুশৃঙ্খলভাবে এবং ন্যায্য পরিমাণে পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবটি গৃহিত হলে তেল যুগের অবসান ঘটানোর জন্য এটিই হবে প্রথম বৈশি^ক চুক্তি।
৬ই ডিসেম্বর’২৩ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস’ বলেছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাস আগের বছরের নভেম্বরের উষ্ণতার রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। এতে ২০২৩ সালের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পায়নের আগের সময়ের চেয়ে ১.৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকেছে। কোপার্নিকাস সার্ভিসেস’এর উপপ্রধান সামাš’া বার্গেস বলেন, ২০২৩ সালের ছয়টি মাস এবং দুটি মৌসুম উষ্ণতার নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, দুই দিন শিল্পায়ন যুগের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রাসহ নভেম্বরের অস্বাভাবিক বৈশি^ক তাপমাত্রার মানে ২০২৩ সালে স্মরণকালের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। কপ-২৮ সম্মেলনে ২০০টি দেশের প্রতিনিধিরা জড়ো হয়েছেন। বৈশি^ক উষ্ণতা রোধে জীবাশ্ম রোধে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর বিষয়ে প্রস্তাবিত খসড়ার উপর সমঝোতার চেষ্টা চলে। কয়লা, গ্যাস ও তেলের ব্যবহার ছিল সম্মেলনের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
কয়েকটি দেশ চাইছে কপÑ২৮ এর আলোচনায় জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার করা না করা নয়, বরং দূষণ কমিয়ে আনার অগ্রাধিকার দেয়া হোক। তালিকায় জ¦ালানি তেল উত্তোলনকারি ও রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব ও রাশিয়া রয়েছে। জ¦ালানি তেলের রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক সম্প্রতি সদস্য দেশ ও ওপেকপ্লাস জোটের দেশগুলোকে একটি চিঠি দিয়েছে। কপÑ২৮ সম্মেলনের চুক্তিতে জীবাশ্ম নিয়ে কোন কিছু উল্লেখ থাকলে তা প্রত্যাখান করার অনুরোধ করা হয়েছে ওই চিঠিতে। তাই ধারণা করা হ”েছ, জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার বন্ধের ঐক্যমত্যে বিরোধিতা করবে ওপেক সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। ওপেকের মহাসচিব হাইথাম আল গাইস এক বিবৃতিতে বলেন, ওপেক চায় কপ-২৮ সম্মেলনের আলোচনায় দূষণ কমানোর বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হোক। যদিও জ¦ালানি তেল, কয়লা ও গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ¦ালানির কারণে দূষণ বেশি ঘটে, বিবৃতিতে ওপেক মহাসচিব আরও বলেন, বিশে^ হাইড্রোকার্বনসহ সব ধরনের জ¦ালানিতে আরও বেশি বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। জ¦ালানির ব্যবহার বদল আনার কৌশল অবশ্যই যৌক্তিক, স্ব”ছ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক হতে হবে। ওপেকের পক্ষ থেকে এমন চিঠি দেয়ার নজির নেই। এর মধ্য দিয়ে সং¯’াটি প্রথমবারের মত জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় প্রভাব রাখার চেষ্টা করেছে।
কপÑ২৮ সম্মেলনের সভাপতি সুলতান আল জাবের তেলের ব্যবসা বাড়াতে সম্মেলনকে ব্যবহার করছেন বলে আন্তর্জাতিক মহলে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন। তবে এরপরও দু্িট গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের মধ্য দিয়ে এ সম্মেলন শেষের দিকে পৌঁছেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ‘লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড’ (জলবায়ুর ক্ষয়ক্ষতি তহবিল) গঠনের পরই সেখানে ৭০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। গত ১১ই ডিসেম্বর’২৩ বিশে^র জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মূল্যায়ন (জিএসটি) প্রতিবেদনও আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহিত হয়েছে। জার্মান ওয়াচের তথ্য মতে, বাংলাদেশ বিশে^র সপ্তম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতাবৃদ্ধি, বন্যার প্রকোপ, সাইক্লোনের মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, অকাল খরা, উপকূলীয় মাটি ও ভূ-গর্ভ¯’ পানিতে অতিরিক্ত লবনাক্ততা। তার সঙ্গে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি, সুপেয় পানির অভাব, মানুষের বা¯‘চ্যুতি, কাজের অভাব ইত্যাদি আরও প্রকট হ”েছ। এসব সমস্যা সমাধানে জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধি একটি জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আশার কথা হ”েছ, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের বদনাম খুচাতে কপÑ২৮ গুরুতর ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ুর বৈশি^ক শীর্ষ সম্মেলনের ২৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম জীবাশ্ম জ¦ালানির বিষয়টি চুক্তিতে উল্লেখ করা হল সম্মেলনের শেষের দিকে। প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা এ চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন। কয়েকদিনের আলোচনার পর সম্মেলনে অংশ নেয়া দেশগুলো শেষ পর্যন্ত নতুন এ সমঝোতায় পৌঁছাতে হল, যাতে জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে সরে আসতে সব দেশকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে অনেক দেশের দাবী অনুযায়ী একেবারেই বাতিল না করে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে নতুন চুক্তিতে। এ চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেছে আয়োজক দেশ আরব আমিরাতের শিল্প ও প্রযুক্তিমন্ত্রী এবং কপÑ২৮ এর সভাপতি সুলতান আল জাবের। এর আগে গ্লাসগো ও শর্ম আল শেখে কপের আসরে জীবাশ্ম জ¦ালানি থেকে সরে আসার জন্য ‘ফেজআউট’ ও ‘ফেজডাউন’ শব্দগুলো ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক হয়। এ সম্মেলনে সেই বিতর্ক এড়িয়ে চুক্তিতে পৌঁছতে সম্ভব হয়েছে যা জ¦ালানি তেলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক সৌদি আরবও স্বাগত জানিয়েছে।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ