শীতে রোগবালাই ও উষ্ণতা রক্ষায় সাবধান

অধ্যাপক ডাঃ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৪ মাস আগে

ঘন কুয়াশার কারণে ১২ই ডিসেম্বর’২৩ সকালে নীলফামারীর সৈয়দপুর বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামায় দেরি হয়। তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের বা তার নীচে নামলে তাকে আবহাওয়াবিদরা শৈত্য প্রবাহ আখ্যায়িত করে। ঐ দিন নওগাঁর বদলগাছিতে তাপমাত্রা ছিল ১১.৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড, যা শৈত্যপ্রবাহের কাছাকাছি। চলতি মৌসুমে এটাই রেকর্ডকৃত সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ঐসব এলাকায় স্বল্প আয়ের মানুষ সমস্যা জর্জরিত তীব্র শীতে রিকশা চালানোসহ দিনমজুুররা ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগবালাইয়ে আক্রান্ত হচ্ছে। বদলগাছির কাছাকাছি চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ছিল ১২.২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। ঢাকায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৬.৬ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন তাপমাত্রা আরও কমে শৈত্যপ্রবাহ শুরু হতে পারে। সাধারণ গরমের তুলনায় শীত একটি আরামদায়ক ঋতু। তবে এ সময় বেশকিছু বাড়তি রোগবালাই দেখা যায়। শীতে বাতাস ভারী, সে কারণে বিভিন্ন ভাইরাস বাতাসের নীচের স্তরে নেমে যায়। শারীরিক সমস্যা ও সেটার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা এ সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
উষ্ণতা রক্ষায় খাবার

ডায়েটের মধ্যে কিছু বিশেষ খাবার অন্তর্ভূক্ত থাকা দরকার যা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলে। শীতে সুস্থ থাকার খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়Ñ

১। দুধ-দই Ñ গিট ব্যথা, হাত-পা কামড়ানিতে দুধ বা দইয়ের কোন বিকল্প নাই।
২। ফাইবার যুক্ত খাবার Ñ আপেল, বাদাম, ওটস, শস্যদানা ইত্যাদি খাবার ওজন ও কোলেস্টরেল কমাতে সাহায্য করে।
৩। ভিটামিন সি যুক্ত সাইট্রাস ফল Ñ লেবু, কমলালেবু ও মাল্টা জাতীয় ফল যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ খাবার এন্টি অক্সিডেন্ট রূপে কাজ করে।
৪। পালং শাক Ñ পুষ্টিতে ভরপুর ও এন্টি অক্সিডেন্ট
৫। স্যুপ Ñ শরীর গরম রাখতে স্যুপের বিকল্প নাই। বিভিন্ন সবজি ও মুরগীর স্যুপ উল্লেখযোগ্য
৬। ডিম Ñ ডিমে রয়েছে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল যা শরীরকে কর্মক্ষম ও সুস্থ রাখে
৭। মাছ, মাংস প্রোটিন জাতীয় খাবার Ñ পর্যাপ্ত প্রোটিন এ সময় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সপ্তাহে দুদিন সামুদ্রিক মাছ অত্যন্ত উপকারী।

৮। ভেষজ মসলা Ñ তুলসী পাতা, পুদিনা পাতা, আদা, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনি ইত্যাদি খাদ্য উপাদান রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ রাখে। আদা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় বলে কথিত আছে।
৯। ধনে পাতা Ñ রোগ প্রতিরোধে উত্তম
১০। রসুন Ñ হৃদরোগ উচ্চরক্ত চাপ, উচ্চ কোলেস্টরেলে উপকারী
১১। হলুদ Ñ তন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, শীতে গীট ব্যথা, অঙ্গ-পতঙ্গ ব্যথায় উপকারী
১২। খেজুর Ñ ১ টি ২টি খেজুর খাদ্য তালিকায় থাকা ভাল
১৩। মুলা জাতীয় সবজি Ñ বিট, মিষ্টি আলু, গাজর, শালগম খারাপ কোলেষ্টরেল কমায়
১৪। পানি Ñ পিপাসা না পেলেও শরীরে পানির চাহিদা থাকে
বাত ব্যথায় করণীয়
আর্থ্রাইটিসে আক্রান্তদের এ সময় খুব সাবধানে থাকতে হয়। তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে বিভিন্ন জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায় এবং হাড়ব্যথা শুরু হয় বয়স্কদের উঠতে বসতে অসুবিধা হয়। কিছু নিয়ম কানুন মানলে কষ্ট থেকে আরাম পাওয়া যায় বলে অনেকে বিশেজ্ঞই মনে করেন।
১। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা Ñ শীতকালে পানির পিপাসা কম অনুভূত হয় তাই পরিমিত পানি পান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়
২। শরীরের উষ্ণতা রক্ষা করুন Ñ গরম কাপড়ে সমগ্র শরীর ঢাকা রাখুন
৩। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
৪। কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল সম্পন্ন করুন।
৫। ভিটামিন ‘ডি’ এর অভাবে অষ্টিওপোরসিস হয়ে যেতে পারে। গোসলের পূর্বে গায়ে তেল মেখে রোদ পোহালেই ডি এর অভাব থাকে না।
৬। গ্রীন টি খান Ñ প্রদাহজনিত সমস্যা দূরে রাখে।
গর্ভবতীদের চলাচল যেমন হবে
শীতে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই শীতে গর্ভবতীদের সুস্থ থাকা জরুরী। গর্ভবতীরা এমনি এক বিশেষ অবস্থায় থাকে যে, তাদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয় যেন বেশি ঠান্ডা লেগে তাদের নিউমোনিয়া না হয়। যাদের হাঁপানি থাকে তাদের এ সময় আরও হাঁপানির টান বেড়ে যায়। একটু আলসে ভাব এসে পড়ে তাই গর্ভবতীর হাঁটাহাঁটিতে যেন ব্যতিক্রম না ঘটে সেটিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শীতে গর্ভবতী মা নিরাপদ থাকতে দরকার Ñ
১। সুষম খাদ্য খাওয়া
২। ত্বকের যত্ন নিতে হবে কুসুম গরম পানিতে চার পাঁচ মিনিটে গোসল করে গ্লিসারিন সমৃদ্ধ সাবান ব্যবহার করুন। ত্বক ভেজা থাকতে মুখ, হাত, পা ও শরীরে ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন। রাতে ঘুমানোর আগে একবার মাখুন। মাথায় অলিভ অয়েল মাখুন। ঠোঁটে ভেসলিন লাগান।
৩। পরিমিত পানি পান করতে হবে
৪। সর্দি কাশির চিকিৎসা নিন Ñ দুই তিনদিনের বেশি সর্দি কাশি হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। দুই তিনদিন আদা, গরগরা ও বাসক পাতার রস খাওয়া যায়।
৫। ব্যায়াম করতে হবে এবং মনকে শান্ত রাখার জন্য মেডিটেশন করা যায়
৬। যেকোন হাসপাতালে নিরাপদ মাতৃত্ব সেবা গ্রহণ করা যায়।

শিশুর সুরক্ষায় যা করতে হবে

সর্দি-কাশি, হাঁচি, গলাব্যথা বা গলা বসে গেলে সেটা কোল্ড এলার্জি কিনা, সাধারণ ঠান্ডা কিনা, সিসনেল ইনফ্লুয়েঞ্জা কিনা, এভাবে আলাদা করে বলা সবসময় খুব সহজ নয়। পার্থক্যগুলো বুঝতে চেষ্টা করলে সুস্থ রাখাটা সহজ হয়।
১। কোল্ড এলার্জি Ñ শীতকালে আদ্রতা কম থাকে, আবহাওয়া শুল্ক ও বাতাস ঠান্ডা থাকে। এ কারণে সর্দি-কাশি, হাঁচি ইত্যাদি দেখা দেয়। প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা বাতাস অনেকের জন্য এলার্জেন হিসাবে কাজ করে, এ জন্য সৃষ্ট উপসর্গকে কোল্ড এলার্জি বলা হয়। ঠান্ডা বাতাস থেকে রক্ষার মুখবন্ধনি বা মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। শ^াসকষ্ট নিরসনে সালবিউটামল ইনহেলার ব্যবহার করা যেতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ভাল থাকার জন্য মন্টিলুকাস খেতে হয়।
২। সাধারণ ঠান্ডা বা কমন কোল্ড Ñ আক্রান্ত শিশুর নাক দিয়ে আনবরত পানি পরবে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে বা হালকা জ¦র জ¦র অনুভূত হবে। অরুচি বা খেতে অনিচ্ছা এবং সামান্য গলাব্যথা থাকতে পারে। নাক বন্ধ থাকলে নাকের ড্রপ, ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে নরমাল স্যালাইন ড্রপ ব্যবহার করা ভাল। মধু মিশ্রিত কুসুম গরম পানি ও স্যুপ খাওয়ালে উপশম হতে পারে। এন্টিহিষ্টামিনও ব্যবহার করা যায়।
৩। এলর্জিক রাইনাইটিস Ñ৩০% পরবর্তীতে এজমা হয়, সাধারণত নাক চুলকানো ও সর্দি, চোখ-মুখ বা ত্বকের চুলকানি, হাঁচি ও নাক বন্ধ বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে; ক্লান্তি বা অবসাদ বোধ হয়। অ্যালার্জির কারণে এজমা, কনজাঙ্কটিভাইটিস, গলাব্যথা, সাইনোসাইটিস, একজিমা, কানপাকা, গ্রন্থিফুলে যেতে পারে।
৪। অ্যাজমা বা হাঁপানি Ñঅনেক দিন ধরে সংবেদনশীলতা ও শ^াসতন্ত্রের প্রদাহজনিত কারণে ঘনঘন হাঁচি, কাশি এবং স্বাভাবিকভাবে শ^াস ফেলতে কষ্ট হওয়াকে হাঁপানি বলে। শীতকালে বেশি হয় শ^াসকষ্টের উৎস ও এলার্জির কারণ যেমন Ñধূলাবালি, ঠান্ডা বাতাস, সিগারেটের ধোঁয়া, তেলাপোকা ও পোলেন গ্রানুউলস পরিত্যাগ করাই প্রতিরোধের উপায়।
৫। সিজনেল ফ্লু বা ইনফ্য়েঞ্জা Ñইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের তীব্র শ^াস-প্রশ^াসে সংক্রমন। এ,বি,সি এবং ডি ৪ ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আছে। এ এবং বি ভাইরাস দুটি মৌসুমী মহামারীর কারণ। হঠাৎ জ¦র, কাশি, মাথাব্যথা ও অসুস্থতা বোধ, গলাব্যথা, নাকে সর্দি, কাঁশি হতে পারে, যা প্রায় দু’সপ্তাহ চলতে পারে। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
৬। ব্রংকিওলাইটিস Ñশীতকালে বেশি হয়, শ^াসকষ্ট ও সর্দি-কাশিতে ভোগে। ২ মাস থেকে ২০ বছর বয়সী শিশুরা ভোগে। রেসপাইরেটরি সিনসাইটিয়েল ভাইরাস, রাইনো ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে সংক্রমন ঘটে। প্রান্তিক শ^াসনালীগুলোতে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ফুলে যায়, মিউকাস নামক পদার্থ দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে স্বাভাবিক শ^াস প্রশ^াসে বাধার সৃষ্টি করে। সর্দি-কাশির পর শ^াসকষ্ট হয়ে বুকের পাজড় ডেবে যায় শিশু ঘন ঘন শ^াস প্রশ^াস গ্রহণ করে। শ^াস নেয়ার সময় সাইসাই শব্দ বা বাঁশীর আওয়াজ শুনা যায়, দুধ টানতে কষ্ট হয়, অসুস্থ মনে হয় না, ঔষধ থাকে না। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ