কুমিল্লার বেলতলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ হয়নি ৫২ বছরেও

১০ হাজার নর-নারীকে মাটি চাপা
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৫ মাস আগে

কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনস্থ বেলতলী বধ্যভূমি। প্রায় ৩০ শতাংশ জুড়ে এ বধ্যভূমির সীমানা। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসবে মানুষের হাঁড় কংকাল। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১০ হাজার বাঙ্গালী নারী পুরুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন এবং হত্যা করে মাটি চাপা দেয় এখানে। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও এ বধ্যভূমি রাষ্ট্রীয়ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। করা হয়নি সংরক্ষণ। লাগানো হয়নি স্মৃতি রক্ষার্থে একটি সাইনবোর্ডও। লাকসাম রেলওয়ে জংশনের লাগোয়া দক্ষিণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৈরি ব্যাংকারের পাশে প্রায় দুই হাজার ফুট এলাকা জুড়ে এ বধ্যভূমি। যাতে বতমানে গো-চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। তবে রেলওয়ের লাকসাম চিনকি আস্তানা ডাবল রেললাইন নির্মানকালে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকদের দাবির প্রেক্ষিতে ঠিকাদার কতৃপক্ষ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেয়।
এ বধ্যভূমির ইতিহাস জানা এবং পাকসেনাদের নির্যাতনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীদের অনেকেই এখন বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গবেষনা সুত্রে জানা যায়, পাক বাহিনী দেশের অন্যান্য এলাকার মত ১৯৭১ সালের ১৫ই এপ্রিল লাকসাম এলাকা দখল করে। এরপর পাক বাহিনী লাকসাম রেলজংশনের পশ্চিম দক্ষিণ পাশে অবস্থিত থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে পাক বাহিনী কুমিলস্না ক্যান্টনমেন্টের পর যুদ্ধকালীন ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করে। এ ক্যান্টনমেন্টের অধীনে ছিল লাকসামসহ কুমিল্লার দক্ষিণ এলাকা, চাঁদপুর, ফেনি ও নোয়াখালী অঞ্চল। এসব অঞ্চল থেকে পাক বাহিনী শ’ শ’ যুবক-যুবতীসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ট্রাকে করে তুলে নিয়ে আসত। এদের মধ্যে যুবতীদের উপর যৌন নিপীড়ন শেষে হত্যা করা হতো। এখানে সব বয়সের লোকদের হত্যার পর ধরে আনা লোকদের মাটি চাপা দেয়া হতো। বিশেষ করে ফেনী, নোয়াখালী, চাঁদপুর এবং বরিশাল অঞ্চলের ট্রেনে আসা যাত্রীদের পাক সেনারা ধরে নিয়ে যেত ঐ থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে। সেখানে তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যার পর বেলতলী বধ্য ভূমি তে মাটি চাপা দেয়া হতো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লাকসাম পাইকপাড়া গ্রামের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আবদুস সোবহান, বাইনচাটিয়া গ্রামের সাংবাদিক নুরুল ইসলাম নুরু।
লাকসামের রাজঘাট এলাকার খুরশিদ আলম জানান, আমার বাবা সৈয়দ আনু মিয়া, মা বেলজান বিবি, আমর ছোট ভাই মনু এবং দু:সম্পর্কের দাদা আবদুল জলিলকে ধরে নিয়ে যায় থ্রী-এ সিগারেট ফ্যাক্টরিতে পাক বাহিনী। সেখানে নিয়ে তাদেরকে গুলি করে নিমমভাবে হত্যা করে তাদের কে সম্ভবত বেলতলী বধ্যভূমিতে মাটি চাপা দেয়া হয়েছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাকসাম রেলজংশনে ঝাড়ুদারের কাজে নিয়োজিত উপেন্দ্র মালির সহযোগী ও তার ভাগিনা শ্রীধাম চন্দ্র দাস (৬০) তার দেখা সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে এ প্রতিনিধিকে জানান, ৭১ এর ১৫ এপ্রিল পাক সেনারা লাকসাম আক্রমন করে। পরদিন লাকসাম জংশন প্লাটফরমে কয়েকজন বাঙ্গালীর লাশ বিক্ষিপ্ত পড়েছিল। তৎকালীন রেলওয়ে স্যানেটারি ইন্সপেক্টর আমাকে ডেকে লাশগুলো সরানোর আদেশ দেন। আমি নিজেই লাশগুলো রেলওয়ে জংশনের দক্ষিনে নিয়ে মাটি চাপা দেই। শ্রীধাম আরও জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চাঁদপুর টোবাকো কোম্পানীর কারখানায় স্বচোখে দেখছেন পাক সেনাদের চরম নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ। সেখানে চাকুরী নেয়ার দু’দিন পর দেখলাম পাক সেনারা হত্যা করলো মুক্তি যোদ্ধা আব্দুল খালেকসহ একদল বাঙ্গালীকে। তখন ঐ লাশগুলোকে মাটি চাপা দেয়া হয়। এ বেলতলী ব্যাংকারের পাশেই। তিনি জানান, ঐ সময় সিগারেট ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন কক্ষে হানাদাররা আটকে রেখেছিল শতাধিক বাঙ্গালী মেয়েকে। তাদের ধষনের পর হত্যা করা হতো। তিনি জানান, সারাদিন বেলতলীতে গর্ত খুঁড়ে রাখতাম। পরদিন সকালে সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে লাশগুলো এনে এখানে মাটি চাপা দিতাম। ঐ সময় আমি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের লাশ মাটি চাপা দেবার সময় স্থানটিকে চিহ্নিত করে রাখি। পরে দেশ স্বাধীন হবার পর সে স্থান থেকে তার লাশ তুলে তাদের স্বজনদেরকে বুঝিয়ে দেই।পাক বাহিনীর হাত থেকে নিজের জীবন এবং মা বাবার জীবনের নিরাপত্তার জন্য আমি বাধ্য হয়ে তখন লাশ মাটি চাপা দেয়ার কাজটি করেছি। কত লাশ দু’হাতে মাটি চাপা দিয়েছি তার হিসাব মেলাতে পারছিনা। শ্রীধাম জানান, সে সময়ের কথা গুলো মনে হলে এখনো রাতে ঘুম আসে না।
শ্রীধাম আরও জানান, শুধু বধ্যভূমিতে লাশ মাটি চাপা দেয়া ছাড়াও ট্রেনের শত শত যাত্রীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হতো তাদেরকে সন্ধ্যার পর অনেক সময় মালবাহী ট্রেনের বগি ভর্তি করে তা চাঁদপুর নিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত।এছাড়াও লাকসাম ষ্টেশন প্লাট ফরমের নাম-ঠিকানাবিহীন যাত্রীদের যে লাশগুলো পড়ে থাকতো এবং থ্রী এ সিগারেট ফ্যাক্টরির লাশগুলো বাংকারের পাশে বেলতলাতে কোন মতে ১ ফুট ২ফুট গত করে মাটি চাপা দিতাম। একদিন দুইদিন পরপর এভাবে ২০/২৫টি লাশ একসাথে চাপা দিতাম।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৯৯ সালে ঢাকার একদল সাংবাধিক অনুরোধ করলে শ্রীধাম দাস বেলতলী বধ্যভূমি খুড়ে বের করেন বেশ কটি মাটি চাপা দেয়া মানুষের হাড় গোড় ও কঙ্কাল। এ সময় উদ্ধার করা বেশ ক’টি মাথার খুলি ও কিছু হাড় বতমানে যা ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
মুক্তিযোদ্ধারা আরও জানান, ৯৯ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ লাকসাম থানা কমান্ডারের একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ১৮-০১-৯৯ইং তারিখের সাবিম/শ-উ:১/৯৯-১নং স্মারক মোতাবেক কুমিলস্না জেলা প্রশাসন ২৫-০২-৯৯ইং তারিখে লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা বধ্যভূমির জায়গাটি অধিগ্রহণের নির্দেশ দিলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক আক্কু চৌধুরী ২০০০ সালের দিকে জানিয়েছিলেন, ইন্টারনেশনাল কোয়ালিশন অফ হিষ্টোরিক সাইট মিউজিয়ামস অব কনসেস’ এর সহায়তা ঐ বছর লাকসামের বেলতলী জয়পুরহাট ও বগুড়া এ তিনটি বধ্যভূমি খনন কাজ শুরু হবে। সে সময় বেশ কিছু ক’জন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক এ বধ্যভূমির চিত্র ধারন করে নেন। এরপর কাজ এগুয়নি। এখনোও অযত্ন অবহেলায় মাটি চাপা পড়ে আছে স্বাধীনতাকামী হাজারও বাঙ্গালীর লাশ এ বেলতলী বধ্যভূমিতে।
লাকসামের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বারী মজুমদার জানান, যেভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ধরে এনে এবং ট্রেনের যাত্রীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা শেষে এখানে প্রতিদিন মাটি চাপা দেয়া হতো। হিসাব মতে তার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের কম নয়।