কুমিল্লায় ডাকাতই নাকি ডাকাত সন্দেহে হত্যা

সোহাইবুল ইসলাম সোহাগ ।।
প্রকাশ: ১ বছর আগে

কুমিল্লায় গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনাটি সারাদেশেজুড়ে এখন আলোচিত-সমালোচিত।দেশে গুজবের নামে গণপিটুনিতে নিরীহ মানুষ হত্যা আর এ ধরনের পাগলকাণ্ডে সর্বশেষ সংযোগ হলো কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দারোরা ইউনিয়নের পালাসুতা গ্রামে।

গ্রামটিতে বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার পর মসজিদে মসজিদে ডাকাত আতঙ্কে মাইকিং করা হয়।এছাড়াও এলাকায় ওয়াজ মাহফিলেও একই ঘোষণা দেওয়া হয়।পরে তা পুরো দারোরা ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে।গ্রামে গ্রামে প্রত্যেক ঘরবাড়ি থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় অবস্থান করে স্থানীয়রা।

এমন ঘোষণা শোনার পর ডাকাত সন্দেহে একই সময় তিন যুবককে আটক করে মারধর করে স্থানীয়রা।এতে ঘটনাস্থলে উপজেলার কাজিয়াতল গ্রামের আব্দুস ছালামের ছেলে নুরু মিয়া(২৮) ও একই উপজেলার পালাসুতা গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ইসমাইল হোসেন(২৭) মৃত্যু বরন করেন।নিহত দুইজনই সম্পর্কে শালা-দুলাভাই।অপরজন সদর দক্ষিন উপজেলার বিজয়পুর ইউনিয়নের রাজারখোলা গ্রামের রিক্সা চালক সেলিম মিয়ার ছেলে কোরআনে হাফেজ শাহজাহান (৩৮)। এখন শাহজাহান আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

অনেকেই বলছে এই ঘটনার পিছনের রাজনীনৈতিক ছত্র-ছায়া রয়েছে।আবার কেউ বলছে,এ গণপিটুনির পিছনে বড় রহস্য আছে। এলাকায় ডাকাতি হচ্ছে এমন ঘটনাকে পুঁজি করে বড় ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতে কাজ করছে পুলিশের একাধিক টিম।

তবে নিহত নুরু মিয়া ও ইসমাইলের পরিবারের দাবি,পূর্ব শত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে ঐ গ্রামে ডেকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল।

একটি সূত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, এ গ্রামের স্থানীয় একজন সাবেক চেয়ারম্যান তাদেরকে মুরাদনগরে আসার জন্য বলে।ওই আসার মূল বাক্য ছিলো মাদকের আড্ডা বা পার্টি দেওয়া।ওই পার্টির কথা বলে নেওয়ার স্থানে চেয়ারম্যানের কিছু লোক অবস্থান করে।একটু পরেই তাদেরকে ধাওয়া দে কিছু লোক।তাৎক্ষণিক ভাবে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত এলাকাবাসীকে তারা সদুত্তর দিতে না পারায় এতেই সন্দেহ হয় এলাকাবাসীর।

প্রথমে কয়েজন লোক মিলে তিনজনকে আটক করে।এরপর ঘটনাস্থলে লোকজন বাড়তে শুরু করে।পরে ৩ জনের মধ্যে ২জনকে লাঠিসোটা দিয়ে বর্বরোচিত গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।আরেকজন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে পালাসুতা গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রেফতারের আতঙ্কে পুরো এলাকাজুড়ে পুরুষশূন্য।এই গণপিটুনিতে দুজন লোক মারা যাওয়ার বিষয় মুখ খুলতে কেউ চাচ্ছে না।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মহিলা বলেন, শীতের মৌসুমী এলে আমাদের এলাকায় ডাকাতি হয়।কয়েকদিন আগেই এ গ্রামে কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। তাই ডাকাতি ঠেকাতে এলাকাবাসী রাতে পালা করে পাহারা দিয়ে আসছিলো।

তবে নিহত ইসমাইল মা মনোয়ারা বেগম অভিযোগ করে বলেন,আমার ছেলেকে মিথ্যা অভিযোগে দোষী করা হয়েছে। অন্য কারো চুরি করা জিনিসের দোষ তার ছেলের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার ছেলে চুরি করার কোন রেকর্ড নাই, আমার ছেলেকে তারা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

আহত শাহজাহানের বাবা রিক্সাচালক সেলিম মিয়া বলেন,আমার ছেলে কখনও চুরি করে নাই।সে রাজমিস্ত্রী কাজ করে যা পায় তা দিয়ে সংসার চালায়।তার বউটাও গর্ভাবস্থায় থাকায় সংসারের খরচ বাপ পুতে মিল্লা চালাতে হচ্ছে।আমার ছেলে ওইদিন তার বন্ধুর সাথে ওর শশুরবাড়িতে বেড়াইতে গেছে।এরপর ওই ঘরে এলাকার মানুষ যাইয়া হামলা করে।আমি এর সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার চাই।এখন আমার ছেলের ঐষধ কেনার টাকাও নাই।সরকার আমার ছেলেরে চিকিৎসার খরচ দিলে আমার ছেলেটারে বাঁচাবো যাবে।না হয় চিকিৎসার অভাবে আমার ছেলেটা খারাপের দিকে যাইতে থাকবে।

কুমিল্লায় সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি রোকিয়া বেগম শেফালী বলেন,মানবাধিকার দেশে নানা কারণে দিনকে দিন মানুষ প্রতিহিংসা পরায়ণ হচ্ছে।শুধু তাই নয় অপরাধের চেয়ে অপরাধীদের প্রতি বাড়ছে ঘৃণার মাত্রা। বিচারকাজে ভরসা কমায় মানুষ নিজেই যেন বিচার হাতে তুলে নিয়েছেন।এ যেন এক ভয়ঙ্কর পাগলকাণ্ড।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামে শুক্রবার বিকালে মুরাদনগর উপজেলা প্রশাসন থেকে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে,গুজব ছড়িয়ে ও গণপিটুনি দিয়ে হত্যার ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ।যারা নিশ্চিত না হয়ে মাইকে ঘোষনা দিয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।

মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুজ্জামান তালুকদার বলেন, নিহত নুরু মিয়ার শ্বশুরবাড়ি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে দুইরকম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ সুনির্দিষ্টভাবে কোথায় ও কার বাড়িতে ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো এমন কোনো তথ্য দিতে পারেনি।তাদের অতীত কর্মকাণ্ড যাচাই করা হচ্ছে। নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মর্গে) পাঠানো হয়েছে।তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কুমিল্লা পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান বলেন, আহত ব্যক্তি সহ সন্দেহভাজন ১ জন কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কিছু জানা যায়নি।তারা কেন এখানে এসেছে,তাদের পরিচয় সম্পর্কে তদন্ত সাপেক্ষে খুব দ্রুতই জানা যাবে।