কুমিল্লায় রোবটিক্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ হাজার ছাড়িয়েছে -মোহাম্মদ কামরুল হাসান

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক হিসাবে সুধীজনের সঙ্গে ৯ মার্চ ২০২১ তারিখে প্রথম মতবিনিময় সভায় লক্ষ্যমাত্রা স্থীর করি শিক্ষাঙ্গনে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব এর ছোঁয়া লাগানোর। কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, থ্রিডি প্রিন্টিং এবং বিজ্ঞানমুখী শিক্ষায় উৎসাহিত করা। প্রতিটি উপজেলায় বিজ্ঞান বিষয়ক সেমিনার, কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। খোঁজা হচ্ছিলো এই বিষয়ের দক্ষ প্রশিক্ষক।
পরিচয় হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। কেউবা পদার্থবিজ্ঞানে, কেউ কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করছিলো। তাদেরকে নিয়েই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থিত লাইব্রেরীতে শুরু হয় স্বপ্নযাত্রা। স্বপ্ন দেখানো শুরু হয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের। প্রথম ব্যাচে কুমিল্লা জিলা স্কুল, নবাব ফয়জুন্নেছা স্কুল, কালেক্টরেট স্কুল সহ ১৬টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়। রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং, থ্রিডি প্রিন্টিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় একঝাঁক স্বপ্নবাজ তরুণ তরুণী তৈরি করার।

স্বপ্নযাত্রার শুরুতে প্রকটভাবে অনুভূত হয় এ সংক্রান্ত সরঞ্জামাদির অভাব, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রচ্ছন্ন অনাগ্রহ, বাড়তি বোঝা মনে করা, অভিভাবকদের অনাগ্রহ ইত্যাদি প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে সিলেবাস প্রণয়ন, ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের উৎসাহিত করা, কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করা, বিশেষ করে শিক্ষা কর্মকর্তাদের একাজে সম্পৃক্ত করা- এভাবে এগিয়ে চলে রোবটিক্স সংক্রান্ত ওরিয়েন্টেশন, প্রশিক্ষণ। বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সৃজিত হয় ফ্যাবল্যাব। ফ্যাবল্যাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অত্যন্ত নিবেদিত প্রাণ এক ঝাঁক উদ্ভাবন অনুরাগী তরুণ রোবট বানানোয় মগ্ন থাকে। তাদের সাথে যুক্ত হয় নবম শ্রেণি পড়–য়া মেধাবী ছাত্র মোনায়েম। সে ল্যাবে কাজ করে সকাল সন্ধ্যা। স্বপ্নে বিভোর সে ড্রোন বানাবে, রোবট বানাবে যা জেলা প্রশাসনকে বিমোহিত করে। ইতোমধ্যে তার ড্রোন নির্মিত হয়েছে। এভাবেই ধাপে ধাপে আজ কুমিল্লায় রোবটিক্স শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ হাজারের অধিক। এ থেকেই পরিকল্পনা করা যে এই বিষয়টিকে লিখিত রূপ দেয়া প্রয়োজন।
আজকে লেখার উদ্দেশ্য হলো আমাদের যে সন্তানেরা যাত্রা শুরু করেছে সেই রোবটিক্স সম্পর্কে অবহিত করা।

প্রথমে আসা যাক রোবট কি?
রোবটিক্সঃ
টেকনোলজির যে শাখায় রোবটের নকশা, গঠন ও কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা হয় সেই শাখাকে রোবটিক্স বলে। রোবটিক্স শব্দটির উৎপত্তি রোবট শব্দ থেকে। শব্দটি পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয় চেক লেখক ও নাট্যকার কারেল কাপেক এর একটি নাটক হতে যেটি ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়। রোবট শব্দটি মূলত এসেছে গ্রিক শব্দ হতে যার অর্থ হলো শ্রমিক। আজকের দিনে রোবটিক্স হলো দ্রুত বর্ধনশীল একটি ক্ষেত্র। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সাথে সাথে গবেষণা নকশা এবং নতুন নতুন রোবট তৈরির ফলে বিভিন্ন ধরণের ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে রোবট ব্যবহৃত হয়। ঘরোয়া, বাণিজ্যিক বা সামরিক কাজেই হোক না কেন সব কাজেই রোবটকে ব্যবহার করা যায়।
রোবট অত্যন্ত দ্রুত, ক্লান্তিহীন ও নিখোঁজ কর্মক্ষম একটি যন্ত্র। এটা মূলত একটি সুনিয়ন্ত্রিত কম্পিউটার পদ্ধতি। রোবটের সাহায্যে যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করা যায় এবং শিল্প কারখানায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন করা যায়। প্রত্যেকটি নতুন কাজ করার জন্য যে নির্দেশনা তৈরি করতে হয় তাতে হাজার হাজার কম্পিউটার প্রোগ্রাম কোড ব্যবহার করতে হয়। জাপানের মোবাতা কোম্পানির ‘মুবাতা বয়’, সনি কর্পোরেশনের ‘আইবো’ অথবা হোন্ডা কোম্পানির ‘আসিমো’ ইত্যাদি প্রায় মানুষের মতোই বিশেষ বিশেষ কাজ করতে পারে [তথ্যসূত্রঃhttps://thecrushschool.com/concept-of-robotics/

রোবটিক্স এর ইতিহাসঃ

সর্বপ্রথম চেক স্লাভিয়ান নাট্যকার Karel Čapek  ১৯২০ সালে রোবট শব্দটি ব্যবহার করেন। তবে রোবটিক্স এর উৎপত্তি হয় প্রাচীন বিশ্বেই। আর আধুনিক রোবটের সূত্রপাত হয় শিল্প বিপ্লবের পর থেকে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ব্রিডল নিউরোলোজিক্যাল ইন্সটিটিউটের উইলিয়াম গ্রে ওয়াল্টার দ্বারা ১৯৪৮ সালে জটিল আচরণের প্রথম ইলেক্ট্রনিক স্বায়ত্তশাসিত রোবট তৈরি হয়। ১৯৫৪ সালে জর্জ ডিভোল উদ্ভাবন করেন প্রথম ডিজিটাল এবং প্রোগ্রামযোগ্য রোবট। আর ২০০০ সালে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিক শিল্প রোবটগুলো নির্মাণ করা হয়। ২০০৪ সালে কার্নেল ইউনিভার্সিটি প্রথম একটি রোবট প্রকাশ করে যা স্ব-প্রতিক্রিয়ায় সক্ষম ছিল। এটিই বিশ্বের প্রথম রোবট যা নিজেই নিজের কপি করতে সক্ষম ছিল। সবশেষে যে রোবটটির কথা না বললেই নয় সেটি হলো সোফিয়া। সৌদি আরব কর্তৃক নির্মিত এই রোবটটি ২৫ অক্টোবর ২০১৭ সালে চালু করা হয়। এটিই প্রথম রোবট যা কোন দেশের জাতীয়তা বা নাগরিকত্ব লাভ করে।

রোবটিক্সের সূত্রাবলিঃ

বোস্টন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর লেখক প্রফেসর আইজ্যাক এজিমভ ১৯৪১ এবং ১৯৪২ সালের দিকে রোবটিক্সের উপর তিনটি সূত্র প্রণয়ণ করেন। সূত্রগুলি হলো- একটি রোবট কোন মানুষের ক্ষতি করতে পারে না এবং নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কোন মানুষকে ক্ষতি করতে দেয় না।
একটি রোবটকে অবশ্যই মানুষের দেয়া আদেশগুলি মান্য করতে হবে। তবে এমন আদেশ নয়, যা প্রথম সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হয়; এবং কোন রোবটকে অবশ্যই তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না এরকম সুরক্ষা প্রথম বা দ্বিতীয় সূত্রের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়  তথ্যসূত্রঃ https://forum.projanmo.com/topic41967.html]|

রোবটিক্স এর গুরুত্ব ও ব্যবহার রোবট আজ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, কলকারখানা, স্পেস টেকনোলজি, গবেষণাগারসহ নানাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রোবট মানুষের বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

রোবটের বহুবিধ ব্যবহারকে নিম্নরূপে চিহ্নিত করা যায়ঃ

রুটিন মাফিক ঘরের প্রাত্যহিক কাজকর্মে, যানবাহন ও গাড়ির কারখানায়, বিভিন্ন শিল্প কারখানায় জটিল, কঠোর, শ্রমসাধ্য ও বিপজ্জনক কাজে, কম্পিউটার আপডেট ম্যানুফ্যাকচারিং, ইলেকট্রনিক্স এর আইসি, কম্পিউটারের মাদারবোর্ড এর সার্কিট বোর্ড তৈরিতে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে সার্জারির কাজে, পারমাণবিক কেন্দ্রে তেজস্ক্রিয় পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে, সামরিক ক্ষেত্রে বোমা নিষ্ক্রিয় করতে, ল্যান্ডমাইন শনাক্ত করতে, বিস্ফোরক নিয়ন্ত্রণে, ডুবে যাওয়া জাহাজের অনুসন্ধানে, খনি অনুসন্ধানে; মিলিটারি অপারেশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে; এবং মহাকাশ গবেষণায় মানুষের পরিবর্তে মহাকাশে অভিযানে; সম্প্রতি মঙ্গল গ্রহে যুক্তরাষ্ট্রের নাসা কর্তৃক কিউরিসিটি নামক একটি রোবট পাঠানো হয়েছে যেটি মঙ্গলের পরিবেশ, প্রকৃতি ইত্যাদি হতে তথ্য নিয়ে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে।

রোবট ব্যবহারের সুবিধাঃ

রোবট নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে সক্ষম। এর দ্বারা তৈরি পণ্যের গুণগত মান খুব ভালো এবং সূক্ষমতা বেশি; গতি বেশি এবং আউটপুট বেশি পাওয়া যায়; এবং বিপজ্জনক ক্ষেত্রে রোবটের সাহায্যে কাজ করা অনেক বেশি নিরাপদ।

রোবট ব্যবহারের অসুবিধাঃ

রোবট মানুষের মতো পরিস্থিতি বিবেচনা ও চিন্তাভাবনা করে নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম নয়; নতুন বা জটিল পরিস্থিতিতে নিজে নিজে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না; রোবটকে সচল রাখতে অধিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় যা ব্যয় বহুল; এবং রোবটের মধ্যে কোন সৃজনশীলতা নেই এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না। তবে যেকোনো সমস্যায় নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করার জন্য রোবটকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর ফলে রোবট অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের কর্মপদ্ধতি বদলাতে সক্ষম হবে। রোবটিক্স কার্যক্রম সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় রোবটিক্স কৌশল ২০২০ (National Strategy for robotics 2020) প্রণয়ন করেছে।

কুমিল্লায় রোবটিক্সঃ

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য। এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি বিষয় সমূহকে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে জনপ্রিয় করে তুলতে জেলা প্রশাসন, কুমিল্লা ছয় মাসের অধিক সময় ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) এর সমন্বয়ে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ কার্যক্রম আজ জেলাব্যাপী দৃশ্যমান। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তাবৃন্দ। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ এবং মেধাবী তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা মূলত প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। কর্মকর্তাদের উজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে কর্মশালা, সেমিনার, প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়। গঠন করা হয় রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং ক্লাব।

এ ক্লাব সমূহের উদ্দেশ্য হলো:

কুমিল্লা জেলার শিক্ষার্থীদেরকে বিজ্ঞান বিষয়ক ও মননশীল বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আগ্রহী করে তোলা; অন্তভর্ূূক্তিমূলক উদ্ভাবনী বিকাশে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী প্লাটফর্ম গড়ে তোলা; চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলা; স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রোগ্রামিং, রোবটিক্স ও আইওটি প্রজেক্ট নির্মাণের মানসিকতা তৈরি করা; উদ্ভাবনী জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করার সক্ষমতা গড়ে তোলা; এবং তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মহাযাত্রায় গর্বিত অংশীদার হওয়া।

ক্লাবের কার্যক্রমকে সফলভাবে পরিচালনা করতে নির্মাণ করা হয় রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং বিষয়ক ওয়েবসাইট roboticscumilla.org| । রোবটিক্সকে জনপ্রিয় করে তুলতে একটি লোগো (logo) নির্ধারণ করা হয়েছে। লোগোতে- দ্বারা – Øviv Towards 4IR (চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে); দ্বারা ‡_); Øviv CUMILLA ROBOTICS & PROGRAMMING CLUB  এবং এর ফন্ট দ্বারা প্রযুক্তির আবহকে বুঝানো হয়েছে; দ্বারা ড্রোনের পাখাকে বুঝানো হয়েছে; এরূপ প্রতিটি বর্ধিত ক্যাবল দ্বারা সার্কিট বুঝানো হয়েছে; এবং দ্বারা ক্লাবটি ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত বুঝানো হয়েছে।

এ ওয়েবসাইটে বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রাপ্ত এ সংক্রান্ত কর্মসূচি, সিলেবাস এবং প্রশিক্ষণের তথ্যাদি শেয়ার করা হয়। জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত বেসিক প্রোগ্রামিং, আরড্যুইনো প্রোগ্রামিং, ফান উইথ প্রোগ্রামিং, ইলেক্ট্রনিক্সসহ নানাবিধ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি এই ল্যাবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং বিষয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কুমিল্লা জেলার আনাচে কানাচে রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং এর ধারণা পৌঁছে দিতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ওরিয়েন্টেশন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা হয়েছে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও রোবট বানানোর কৌশল। ইতোমধ্যে জেলার ১৭ টি উপজেলায় ৩৪ টি প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে ৩৪৫৬ জন প্রশিক্ষণার্থীকে রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং এর মৌলিক ধারণা প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ কোর্সের পাশাপাশি ৪৩ টি ওরিয়েন্টেশন কোর্স পরিচালিত হয়েছে। এসব ওরিয়েন্টেশন কোর্সে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে আগত ১১০ জন দক্ষ প্রশিক্ষক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।

প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে কালেক্টরেট ফ্যাবল্যাব। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরা প্রোগ্রামিংলব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে নানা ধরনের উদ্ভাবনমূলক কাজ করে যাচ্ছে ফ্যাবল্যাবটিতে। এখানে শিক্ষার্থীদেরকে প্রোগামিং এর মাধ্যমে হাতে-কলমে যন্ত্রপাতি সন্নিবেশ করে মেশিন সেন্সরিং ও রোবটিক্স শেখানো হচ্ছে। এছাড়া গণিত, বিজ্ঞান ও আইসিটি বিষয়ে পাঠ্যবইয়ে উল্লিখিত বিষয়ের ব্যবহারিক দিক ও শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। কুমিল্লায় প্রথমবারের মতো রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং এর জন্য একজন খন্ডকালীন শিক্ষক কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশে স্কুল পর্যায়ে সম্ভবত প্রথম শিক্ষক।

১০ এপ্রিল বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (ইউঙঝঘ) কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের আয়োজনে কুমিল্লা জিলা স্কুলে দিনব্যাপী রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং ও গণিত বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করে। এতে ১৫টি স্কুলের ৬ষ্ঠ-১০ম শ্রেণির ২০০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। কর্মশালায় ইউঙঝঘ তাদের তৈরি আলফা-১ প্রো রোবট নিয়ে আসেন। সেখানে হাতে কলমে রোবট তৈরির কৌশল বাতলে দেওয়া হয়। তাছাড়া প্রোগ্রামিং এর লজিক, সিনট্যাক্স ইত্যাদি বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মৌলিক ধারণা প্রদান করা হয়। দিনব্যাপী এ কার্যক্রমে রোবটিক্স, প্রোগ্রামিং ইত্যাদি বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা জিজ্ঞাসার উত্তর প্রদান করা হয়। ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এ আয়োজন অত্যন্ত প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

গত ১১ এপ্রিল ২০২২ তারিখে কুমিল্লা জিলা স্কুলে অনুষ্ঠিত রোবটিক্স এবং প্রোগ্রামিং বিষয়ক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। প্রশিক্ষণ শেষে জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেইজ এবং রোবটিক্স ওয়েবসাইট (ৎড়নড়ঃরপংপঁসরষষধ.ড়ৎম) এ শিক্ষার্থীরা তাদের উচ্ছ্বসিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির সাইফ আল ফাহাদ, অষ্টম শ্রেণির সামিউল ইসলাম, দশম শ্রেণির আহনাফ আবিদ; নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর দশম শ্রেণির নাফিসা তাসনিম, ফাহমিদা ফারজানা আয়মান, শাহরিয়া তাসনিম, জয়িতা বণিক; কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুলের দশম শ্রেণির হৃদয় পাল, দীপ ভৌমিক; বুড়িচং আনন্দ পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির জামিলুর রহমান নাফিম জেলা প্রশাসনের ফেসবুক পেইজে তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।

কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুলের হৃদয় পাল মন্তব্য করে, “আমাদেরকে শেখানো হয়েছে, কিভাবে সহজেই নিমেষের মধ্যে প্রোগ্রাম লিখে একটা ছোটখাটো গেম তৈরি করে ফেলা যায়। তাছাড়া আমাদেরকে ড্রোনের বেসিক প্রোগ্রামসহ কিভাবে স্বয়ংক্রিয় ড্রোনের প্রোগ্রাম লিখতে হয় তা শেখানো হয়েছে। দেখানো হয়েছে কিভাবে একটি স্বয়ংক্রিয় রোবট পরিচালনা করা হয় এবং কিভাবে তার প্রোগ্রাম লিখতে হয়। দিনটি আমার কাছে খুবই উপভোগ্য ও শিক্ষণীয় ছিল”।

নবাব ফয়জুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এর ফাহমিদা ফারজানা আয়মান বলে, “কর্মশালার মাধ্যমে নিজে মজার গেমস তৈরি করা শিখেছি, যা প্রোগ্রামিং এর প্রতি আমার আগ্রহ ও ভালোবাসা আরও বৃদ্ধি করেছে। পাশাপাশি ড্রোন তৈরির প্রোগ্রাম লিখা, ড্রোন পরিচালনা, তার সাথে রোবট চালনার প্রাথমিক ধারণা পেয়েছি।

প্রশিক্ষক ভাইয়ারা সব কিছুই প্রাকটিক্যালি আমাদের দেখিয়েছেন, যা আমাদের মৌলিক ধারণা আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে”। উক্ত বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী জয়িতা বণিক ক্ষুদে বার্তায় লিখেছে, “একদল স্বপ্নবাজ কিশোর-কিশোরী তৈরীর লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক স্যারের এই উদ্যোগ। আমি উচ্ছ্বসিত কারণ স্যার বলেছেন গোটা এপ্রিল-মে মাস জুড়েই এরকম নানা ওয়ার্কশপ, সেমিনার, রোবটিক্স এবং প্রোগ্রামিংয়ের বিভিন্ন ক্লাসের আয়োজন করা হবে”।

জিলা স্কুলের আহনাফ আবিদ এর মতে, “আমরা আজ ড্রোনের বিভিন্ন অংশ, ড্রোনের কাজ, ড্রোন উড়ার পেছনের ফিজিক্স জেনে নতুন এক জগতে উড়াল দিলাম। জেলা প্রশাসক স্যার আমাদেরকে এমআইটি, হার্ভাডে পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছেন। রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং এর সাথে তাঁর গভীর প্রণয়। কুমিল্লার শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্যারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং রোবটিক্স এর প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে”।

কুমিল্লার স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা আজ প্রোগ্রামিং শিখে নিজেদের আইডিয়াকে কাজে লাগিয়ে কোডিং করছে। বানিয়ে ফেলছে হেক্সাকপ্টার ড্রোন, রিমোটচালিত রোবট কার। আর কুমিল্লা রোবটিক্স ও প্রোগ্রামিং ক্লাব এসব ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের স্বপ্নের এই বীজকে অঙ্কুরোদগমে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের এ উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায়। তাহলেই আজকের এই স্বপ্নবাজ ক্ষুদে বিজ্ঞানীরা সুষ্ঠু পরিচর্যার মাধ্যমে আগামীতে হয়ে উঠবে মাইক্রোসফটের সত্য নাদেলা বা গুগলের সুন্দর পিচাই।

লেখক : জেলা প্রশাসক , কুমিল্লা।