জলবায়ু পরিবর্তনে গরম অনুভূতি ও বিপদে মানুষ——অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

অনেক দিনের গ্রীষ্মের তাপে অষ্ট্রেলিয়ার বিশ্বখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ (প্রবাল প্রাচীর) ৯১ শতাংশ বিবর্ন হয়ে গেছে। সরকারী নজরদারীর প্রতিবেদনে প্রবালের ক্ষতি সম্পর্কে জানা গেছে প্রবাল প্রাচীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কারণ এবারই প্রথম লা নিনা আবহাওয়া চক্র চলাকালীন সময়ে প্রবাল বিবর্ণ হয়েছে। সাধারনত: লা নীনা আবহাওয়া চক্রের সময় কম থাকে বলে ধরা হয়। মার্চের প্রকাশিত ‘দ্যা রিফ স্ন্যাপশট’ নামের একটি প্রতিবেদনে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের চতুর্থ ‘ম্যাস ব্লিচিং বা ব্যাপক হারে বিবর্ণ হওয়ার ঘটনাটি জানানো হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পরিকল্পনাকারী শীর্ষ গবেষকরা বলেছেন, তেল ও গ্যাসের মত জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো এবং বনাঞ্চল ধ্বংশের কারনে বায়ুমন্ডলে যথেষ্ট পরিমান গ্রীনহাউস গ্যাস জমা হয়েছে। এটি বন্যা, খরা, দাবানল এবং গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ঝড়ের সংখ্যা ও মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে ইম্পেরিয়েল কলেজ অব লন্ডনের গ্রানথাম ইনিষ্টিটিউটের বিজ্ঞানী ফ্রিডেরিক অটো বলেন ‘অত্যন্ত গরমের বেলায় জলবায়ু পরিবর্তনে যে একটি বড় পটপরিবর্তন হয় তাতে কোন সন্দেহ নাই।’ এছাড়া মার্চ ও এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘটিত তাপপ্রবাহ এরই মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। অক্সফোর্ড গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ‘এখন বিশ্বের প্রতিটি তাপপ্রবাহই শক্তিশালী এবং এগুলো মানুষ্য সৃষ্টির কারনেই হওয়ার আশঙ্কা বেশী।
মাত্রাতিরিক্ত গরম বাংলঅদেশেও এবার ছড়াচ্ছে । ১৫ই এপ্রিল রাজশাহীর তাপমাত্রা ছিল ৪১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। দীর্ঘ ৮ বছর পর তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রী পার হল। পূর্বে ২০১৪ সালে ২৫ শে এপ্রিল এ তাপমাত্রা ৪১.২ ছিল। ১৯৭২ এর ১৮ই মে ছিল ৪৫.১ ডিগ্রী যা এখনও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশ আবহাওয়া দপ্তর বলেছে ১০০ বছরে দেশের গত তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রী বেড়েছে। দেশের ৯টি জেলার তাপমাত্রা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যশোরে সবচেয়ে বেশিদিন প্রচন্ড গরম থাকে। গড়ে ৭৫ দিন এ জেলায় তাপমাত্রা বেশী থাকে, রাজশাহীতে তাহা ৬৭ দিন এবং ইশ্বরদিতে ৫৮ দিন। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে ঢাকায় বছরে ৩৬ দিন তাপমাত্রা বেশি থাকে। বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশকে পরিকল্পিত উপায়ে ভূমির ব্যবহার করতে হবে। যেখানে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জলাভূমি বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। উল্লেখ্য, যশোরে বেশিদিন তাপমাত্রা বেশি থাকার কারণ হিসেবে সুন্দরবনের বিস্তৃতি কমে যাওয়া এবং ভৈরব ও মুক্তশ্বেরী নদীর মৃতপ্রায় দশাকে দায়ী করা হয়। সুন্দরবন একসময় যশোরের একটি অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিম্বজুড়েই তাপমাত্রা দিনের পর দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনরোধে এখনও পিছিয়ে রয়েছে বিশ্ব। গবেষকদের বিশ্লেষণ বলছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনরোধে বাস্তবিক পদক্ষেপ না নিলে ২০৩৭ সাল নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর ২০৫১ সাল নাগাদ ২ ডিগ্রী বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষ যে ঝুঁকিতে পড়তে পারে সে উপলব্ধি না থাকার কারনে এবং জানার পরেও অধিক মুনাফার লোভে এমন কাজ করে থাকে যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব কাজ বিপর্যয়ের মুখে ফেলছে বিশ্বকে, ফলে বাড়ছে দূর্যোগের সংখ্যা, জাতিসংঘের দূর্যোগ ঝুঁকি কমানোর দপ্তর (ইউএনডিআরআর) এক প্রতিবেদনে এ বার্তাটি দেয়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গত দুইদশকে প্রতি বছর ৩৫০ থেকে ৫০০ টি মধ্যম থেকে ভয়াবহ দূর্যোগের শিকার হয়েছে বিশ্বাবসী। যা পূর্বের ৩ দশকের গড় দূর্যোগের পাঁচ গুনেরও বেশি, এসব দুর্যোগ বিশ্বে ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আগামী দিনগুলোতে দূর্যোগ আরও বাড়তে পারে। বিবৃতিতে ইউএনডিআরআর বিশ্বজুড়ে দূর্যোগ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় কারন হিসেবে দূর্যোগের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষে উপলব্ধিগত সমস্যাকে দেখানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয় অনেকেই মনে করেন, তারা সহজেই দূর্যোগ জয় করতে পারবেন। অনেক সময় সাংগঠনিক কিংবা রাষ্টীয় নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও এমন মানসিকতা দেখা যায় বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে এসব সিদ্ধান্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূর্যোগের ঝুঁকির দিকটিতে মনযোগ না দিয়ে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে অগ্রাধিকার দেয়ায় তা অনেক সময় ঝুঁকিতে থাকা মানবকুলের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। এদিকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির জেরে আশঙ্কা বাড়ছে একের পর এক মহামারীর। বিশ্বের তাপমাত্রা যে হারে বেড়ে যাচ্ছে তাতে বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন। তারা বলেছেন, পরের মহামারীটা হতে পারে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্তন্যপায়ী প্রাণীর স্থান পরিবর্তনজনিত কারনে। গবেষণা থেকে তাঁহারা বলেছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে বন্য প্রাণীরা আরো বেশী লোকালয়ের দিকে চলে আসতে পারে। আরও বেশী মানুষের সংস্পর্শে এলে বন্য প্রাণীর দেহের ভাইরাস সহজেই মানুষের দেহে চলে আসতে পারে।
পরিবেশে একই সঙ্গে উষ্ণতা ও আদ্রতা বেশি থাকা মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এমন গরম আবহাওয়ায় শরীরে ঘাম হয়। ঘাম শুকিয়ে শরীর দ্রুত শীতল হওয়ার সুযোগ কমে যায়। অতি উষ্ণ ও আদ্র আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নীচে কাজ করা কৃষক ও শ্রমিকদের শরীরে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। তাদের উৎপাদনক্ষমতা কমে যায়। তারা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা মৃত্যুর ঝুঁকিও তৈরি করে। বিৃবতিতে অতি উষ্ণ আবহাওয়ার কারনে কর্ম ঘন্টার ক্ষতির হিসাবও তুলে ধরা হয়। গরমের কারনে বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রম ঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। এর আর্থিক মূল্য ২৮ থেকে ৩১ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। মাথাপিছু শ্রমঘন্টা নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ৫ নম্বরে। বলা হয় বাংলাদশে বছরে ক্ষতির পরিমান ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রম ঘন্টা। মাথাপিছু হিসেবে ক্ষতির পরিমান দাঁড়ায় ২৫৪ শ্রম ঘন্টা। ক্ষতি পড়ছে শ্রমিকের বিশেষ করে রিক্সা চালক, কৃষি ও নির্মাণ খাতে ক্ষতি বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনগুলিতে শ্রম ঘন্টার ক্ষতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকগণ।
গরম বেড়ে গেলেই বেড়ে যায় ডায়রিয়ার প্রকোপ। সাধারণ ডায়রিয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশে তীব্র ডায়রিয়াও দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে গরম বাড়লে কিছু জীবানু কার্যকর হয়। আবার শীতকালে সে জীবানুগলি দূর্বল হয়ে পড়ে । প্রকৃতিতে গরম মোকাবেলা একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। তবে ব্যক্তিপর্যায়ে আমরা বৃক্ষরোপন করে, গাছ কম কেটে পরিবেশ বিপর্যয় রক্ষা করতে পারি। বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারলে ডায়রিয়া- কলেরার মত জীবানু থেকে বেঁচে থাকতে পারি। বাংলাদেশে গরমের কারনে শুধু যে ডায়রিয়া হচ্ছে তা নয়। দূষিত পানি পান করে হেপাটাইটিসএ আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ এবং আগের সার্স, ইবোলা, জিকা দেখিয়েছে যে কিভাবে এই ভাইরাসগুলো মানব দেহে চলে আসে। কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াও প্রতি বছর বাংলাদেশের ফরিদপুর ও আশেপাশের জেলাগুলোতে শীতে নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। তবে পার্থক্য হল নিপাহ আরও প্রাণঘাতী এবং বাদুড়ের সংস্পর্শে আসা কাঁচা খেজুর রস ও বাদুড়ে খাওয়া ফল খেলে হয়ে থাকে। আর কোভিড-১৯ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় এরকম একটি যোগসূত্র দেখানো হয়েছে যে, কিভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে প্রাণীর বাসস্থান পরিবর্তন করিতে বাধ্য হচ্ছে। তাপমাত্রা আরও বেশী বৃদ্ধি পেলে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বাসস্থান স্থানান্তর আরও বেশী ঘটবে। এই স্থানান্তরে বড় শিকারী প্রাণীদের দ্বারা ছোট প্রাণী শিকারে পরিণত হবে। বন্যপ্রাণীর দেহের অসংখ্য ভাইরাস চার দিকে ছড়িয়ে পড়বে এবং আক্রান্ত হবে মানুষ।

সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ

সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা অঞ্চল