এশিয়াতে ১৫০ মিলিয়ন লোকের থেলাসেমিয়া ট্রেইট আছে। তাহারা সবাই থেলাসেমিয়া বহনকারী। তাদের অনেকেই বুঝতে পারে না তাদের রোগ সম্পর্কে । কতগুলি নির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে তা বুঝা সম্ভব হয়। থেলাসেমিয়া হচ্ছে একটি বংশানুক্রমিক রোগ যার ফলে রক্তের লোহীত কনিকাসমূহ পরিমিত পরিমান অক্সিজেন সরবরাহ করতে অসক্ষম, অস্থিমজ্জা সাধারণ লোহীত কনিকা প্রস্তুত করে না, স্বল্প অক্সিজেন সরবরাহের কারনে হৃৎপিন্ড এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সমূহ অসমর্থ হয়ে পড়ে, রোগীকে দেখতে ফেকাশে দেখায় বা অবসাদগ্রস্থ মনে হয় এবং চিকিৎসা না করিলে ১ থেকে ৮ বৎসর বয়সের মধ্যে মারা যায়।
স্থ’ূল দৃষ্টিতে থেলাসেমিয়া দু প্রকারঃ
১. থেলাসেমিয়া মাইনর বা ট্রেইটঃ এ সমস্ত লোকজন সচরাচর সাধারণ স্বাস্থ্যের অধিকারী। তাহারা রোগের বহনকারী, তাহারা পরবর্তী বংশানুক্রমে জীন পাচার করতে পারে এবং এক সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশে ৩-৫% জনগন এরুপ রোগ বহনকারী।
২. থেলাসেমিয়া মেজরঃ ইহা একটি কঠিন রক্ত জটিলতা যাদেরকে প্রতি মাসে রক্ত দিতে হয় এবং সব সময় চিকিৎসকের স্মরনাপন্ন হতে হয়। থেলাসেমিয়া বহনকারী অসুখে ভোগে না কিন্তু পরবর্তী বংশানুক্রমে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং থেলাসেমিয়া মাইনরে আক্রান্ত পিতা-মাতার যে কোন একজন রোগ বহনকারী থাকে। কিন্তু থেলাসেমিয়া মেজরের বেলায় আক্রান্তের পিতা-মাতা উভয়েই রোগের বহনকারী থাকে।
পিতা-মাতার একজন বহনকারী হলে পরবর্তী বংশানুক্রমে ৫০% ভাগ শিশু বহনকারী হওয়ার সম্ভবনা থাকে। পিতা-মাতা উভয়েই বহনকারী হলে পরবর্তী বংশানুক্রমে ২৫% ভাগ সম্ভাবনা থাকে, থেলাসেমিয়ায় ভোগার ৫০% ভাগ সম্ভাবনা থাকে, এবং রোগের বহনকারী হওয়ার ২৫% ভাগ সম্ভাবনা থাকে। সাধারণ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার অর্থাৎ যখন পিতা এবং মাতা বহনকারী তাদের সন্তানদের থেলাসেমিয়ায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে চারভাগের একভাগ। সমগ্র জীবনভর আমাদের শরীরে রক্তের লোহীতকনিকা অস্থিমজ্জায় আমাদের পিতা-মাতার জীনবাহিত তথ্যের তৈরী হয়। আমাদের অর্ধেক তথ্য আসে পিতা এবং বাকী অর্ধেক আসে মাতা থেকে। যদি একজনের জীনবাহিত তথ্য সাধারণ এবং অপর জনের তথ্য ত্রুুটিপূর্ণ থাকে তারপরও আমরা সঠিক লোহীত কনিকা প্রস্তুতে সক্ষম হব তবে আমরা থেলাসেমিয়ার বহনকারী হব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন দুইজনেই থেলাসেমিয়া মাইনর/ ট্রেইটে আক্রান্ত হয়ে একটি শিশু জন্ম দেয় যেখানে উভয়েরই অর্ধেক জীনতথ্য থাকে ত্রুুটিপূর্ণ এবং সে সকল পরিবারে প্রসব সম্ভাবনার চারভাগের এক ভাগ শিশু থেলাসেমিয়াতে ভোগার, দুই ভাগের এক ভাগ শিশু রোগ বহনকারী হওয়ার ও চার ভাগের এক ভাগ শিশু স্বাস্থ্যবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্য কথায় ঐ পরিবারের প্রতিটি প্রসবে যদিও সাধারণ শিশু প্রসবের সম্ভাবনা আছে তবুও প্রতিটি প্রসবে থেলাসেমিয়াতে ভুগবে এমন শিশু জন্মের সম্ভাবনা থাকে ২৫% ভাগ।
আমাদের সাধারণ জনতা থেলাসেমিয়া সম্পর্কে একবারেই অজ্ঞ। এ ঘাতকব্যাধি সম্পর্কে ব্যাপক গণ-সচেতনতা সৃষ্টি আশু প্রয়োজন। এক ব্যক্তির থেলাসেমিয়া ট্রেইট থাকলে তাহার অনেক আত্মীয় স্বজনেরও তাহা থাকার কথা। তাই যদি আপনি জানুন কোন ব্যক্তির থেলাসেমিয়া ট্রেইট আছে তবে দয়া করে তার পরিবার পরিজনের সকলেরই পরীক্ষা করে ইহা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া উচিত।
১. থেলাসেমিয়ার চিকিৎসা: রক্ত পরিসঞ্চালন- সাধারণত: ৬ মাস বয়স থেকেই রক্ত দেয়া আরম্ভ করতে হয়। প্রতি কেজি শরীরের ওজনে ১৫ – ২০ মি:লি: পেক্ট সেল (শুধু লোহীত কনিকা) হারে প্রতি চার থেকে পাঁচ সপ্তাহ পর পর রক্ত দিতে হয়। এ রক্ত দানের উদ্দেশ্য হল রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১০ মি:গ্রা:/ডে:লি: পর্যায়ে বা উর্ধে রাখা কেননা এ সময় রোগীর অস্থিমজ্জার হিমোগ্লোবিন উৎপাদন কম হয় এবং শিশুর সুস্থতা, সবলতা ও দেহ বৃদ্ধির হার রক্ষা করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে রক্তপরিসঞ্চালন চলতে থাকলে রোগীর প্লীহা বড় হয়ে যায় বিশেষ করে যখন পেক্ট সেল পরিসঞ্চালনের বার্ষিক প্রয়োজন ২০০-২৫০ মি:লি:/কেজি এর মাত্রা অতিক্রম করে এবং তখনই প্লীহা কেটে দেয়াই হচ্ছে উত্তম চিকিৎসা।
২. আয়রন চিলেশন-৫০০ মি:লিঃ রক্ত ২০০ মি:গ্রা: আয়রন টিসুতে ছড়ায়। এই আয়রন টিসু থেকে কমানোর জন্য ডিসফেরোক্সেমাইন (ডেসফেরল) প্রতি রক্ত সঞ্চালনে ৪০০ মি:গ্রা: আন্ত: শিরায় এবং ৩৫ মি:গ্রা:/কেজি/দিন হারে প্রতি সপ্তাহে পাঁচ রাত চামড়ার নিচে একটি বিশেষ সিরিঞ্জ পাম্পের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রায় ৭ ঘন্টা ব্যাপী রোগীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেয়া হয়। নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন ও প্রতিদিন ডেসফেরল পাম্পের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর জীবন ২০ বৎসর প্রলম্বিত হয় বলে প্রমাণিত। ভিটামিন ও আয়রন চিলেশনে সহায়তা করে। মুখে খাওয়ার একটি আয়রন চিলেটিং এজেন্ট ডিসফেরিওপ্রোন নামে পাওয়া যায় যার কর্মফল ডিসফেরোক্সেমাইনের অনুরুপ কিন্তু এর ব্যবহারে এগ্রানোলসাইটসিস, আর্থারাইটিস ও আর্থালজিয়ার মত জটিলতা সৃষ্টি করে।
৩. ফলিক এসিড যেহেতু এ রাগীর লোহীত কনিকার সৃষ্টিকারী কলাসমূহের অতিরিক্ত বিভাজন হয় সেহেতু ফলিক এসিডের প্রয়োজনীয়তা বেড়ে যায় এবং তাই রোগীকে নিয়মিত ফলিক এসিড খেতে দিতে হবে।
৪. বোন মেরো সংযোজন- ভাগ্যবান থেলাসেমিয়া রোগীদের জন্য উত্তম ব্যবস্থা। একজন কমপেটিবল সিবলিং দাতা পাওয়া গেলে ইহা সম্ভব হয়। দাতা থেলাসেমিয়া মুক্ত সাধারণ অথবা থেলাসেমিয়ার বাহক (কেরিয়ার) হলেও কোন অসুবিধা নাই। বোন মেরো সংযোজন সফলভাবে করা যায়। রোগীর দেহে অধিক রক্ত পরিসঞ্চালন দেয়ার পূর্বেই মেরো সংযোজন করতে হয় অথবা রোগী আয়রন ওভারলোডমুক্ত থাকতে হয়। দাতা এবং গ্রহীতার টিসু মেচিং সহ অনেকগুলি পরীক্ষা করে প্রস্তুতি নিতে হয়। লিভার বায়পসি করে আয়রন লোডের ধারণা নেয়া হয় তার মেরো কোষ সমূহকে ধ্বংস করার জন্য এবং এ সময় লোহিত, শ্বেতকনিকা, ক্লটিং ফেক্টরসমূহ দ্রুত কমতে থাকে। ঠিক ঐ সময়েই দাতার মেরো রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়। দাতাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে এনেসথেসিয়া করে মেরো বের করা হয় এবং পর্যাপ্ত মেরো বের করার পর দাতাকে ওয়ার্ডে আনা হয়। দাতার শুধু ব্যাথা ব্যাতীত অন্য কোন সমস্য থাকে না এবং দ্বিতীয় দিনেই কিছু প্যারাসিটামল ও ভিটামিন দিয়ে দাতাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়। দাতার মেরোকে সযত্মে প্রক্রিয়াকরন করা হয় এবং রোগী গ্রহীতাকে ওয়ার্ডে রক্ত পরিসঞ্চালনের অনুরুপ প্রক্রিয়ায় রক্তনালীর মাধ্যমে প্রবাহিত করে মেরো সংযোজন করা হয়। পরবর্তী দুই থেকে তিন সপ্তাহ গ্রহীতাকে ওয়ার্ডে অপেক্ষা করতে হয়। নতুন রক্তকনিকা তৈরি হওয়া পর্যন্ত। অনেকেই তিন সপ্তাহ পরে আপের জন্য সর্বোচ্চ দু’মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। লিভার বায়োপসিতে অধিক আয়রন লোড থাকলে অনেকক্ষেত্রে ডিসফেরাল কিছু সময়ের জন্য দিতে হয়।
সি.এম.সি ভোলোর এর এক সমীক্ষায় দেখা যায় রক্ত পরিসঞ্চালন ও আয়রন চিলেসনে ভারতীয় মুদ্রায় বার্ষিক খরচ ২ (দুই) লক্ষ টাকা অথচ বোন মেরো সংযোজনের খরচ ভারতীয় মুদ্রায় ৬ (ছয়) লক্ষ টাকা। মালয়েশিয়া ইউনিভাসির্টি হসপিটাল, কুয়ালালামপুর শুধুমাত্র মালয়েশিয়ানদের জন্য ১২ বছরের কমবয়সীদের মেরো সংযোজনে জস-২০,০০০ এবং ১২ বছরের উর্ধের বয়সীদের জন্য জগ-৪০,০০০ অর্থ ব্যয় হয়। আমাদের দেশে অনেকের সহায়তায় মেরো সংযোজনের প্রযুক্তি আনয়ন করেছে যা অগনিত শিশুর জীবনের আয়ুস্কাল বর্ধিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত।
৫. চিলেশনে নতুন সংযোগ- মুখে খাওয়ার উপযোগী চিলেটর ঈএচ৬৫০১৫ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাঝে আছে। ব্যবহারের দেখা গিয়াছে ইহা অনেক বেশি আয়রন নি:সরন করতে পারে কিন্তু কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান। আশা করা যাচ্ছে ইহা ডিসফেরিওপ্রোন থেকে অনেক উপকারী উপাদান হিসেবে আগামী প্রজন্মকে সহায়তা করবে।
৬. জীন থেরাপী- লোহিত কনিকা উৎপাদনকারী রক্তকোষ জন্মদানকারী ষ্টেম সেলে গঠিত গ্লোবীনচেইন তৈরির জীন সংযোজন করা হবে যার আর বেশি দেরি নাই কারণ আগামী বিশ্বে ইহাই হচ্ছে মানবসভ্যতা রক্ষার্থে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ চ্যালেঞ্জ।
প্রতিরোধঃ
থেলাসেমিয়া বহনকারীদের স্ক্রিনীং এর মাধ্যমে বের করতে হবে। থেলাসেমিয়া বহনকারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণ মেনে চলতে হবে। ৮-৯ সপ্তাহের প্রসবকালীন সময় এমনিয়ন সেল বা করিঅনিক ভিলাই উঘঅ পরীক্ষা বা চঈজ পরীক্ষা করে থেলাসেমিয়া আক্রান্ত ভ্রুনকে পরিত্যাগের মাধ্যমে থেলাসেমিক শিশুর জন্মরোধ করা যায়। চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে ব্যাপক গনসচেতনতা ও শিক্ষা বিস্তার ঘটানো। আইনের মাধ্যমে দুজন কেরিয়ারের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করা।
সাবেক অধ্যক্ষ, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ
ও
সদস্য, কেন্দ্রিয় কাউন্সিল, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)