জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৭

অধ্যাপক ডা: মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১ বছর আগে

গোটা বিশ্বের ১৯৬টি দেশের আনুমানিক ৪৫ হাজার প্রতিনিধি জলবায়ু সংকট থেকে উত্তরনের জন্য ৬ই নভেম্বর’২২ থেকে একত্রিত হয়েছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মিশরের শর্ম আল-শেখে। শর্ম-আল শেখে’র অর্থ হচ্ছে “জ্ঞানীদের উপসাগর” জলবায়ু পরিবর্তন গোটা বিশ্বকেই সংকটে ফেলেছে। ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৭) প্রথম সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এই প্রথম সপ্তাহে ছিল নীরব প্রতিবাদ, জোড়ালো উক্তি ও সামান্য নগদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা । অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ক্রমবর্ধমান জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহের চাপ নিয়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা এ শতাব্দীর মধ্যে যাতে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস না বাড়ে, অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল, বিশ্বব্যাংক সংস্কার , আফ্রিকার গ্যাস উত্তোলন ও অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি তহবিলের ব্যাপারে আলোচনাই ছিল সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু। গতবছর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত কপ-২৬ থেকে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে প্রাক-শিল্পস্তরের চেয়ে দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সম্মতি এসেছিল। কার্বন নি:সরন কমানোর এ পর্যন্ত দেওয়া প্রতিশ্রুতি লক্ষ্যপুরনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিপদ আহ্বানকারী ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণায়নের দিকে যাচ্ছে আমাদের গ্রহ।
বিশ্বব্যাপী এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ বাড়বে। এ দশকের শেষ নাগাদ প্রায় ৫০০ মেগাটন এলএনজি উৎপাদন হতে পারে। যা রাশিয়া থেকে ইউরোপে আমদানি করা সরবরাহের প্রায় পাঁচগুন এবং রাশিয়ার মোট গ্যাস রপ্তানীর প্রায় দ্বিগুন। গ্যাস উত্তোলনের এ উন্মাদনা জলবায়ু বিপর্যয়কে ত্বরান্বিত করবে বলেই সবার ধারনা। বিশ্বে গ্যাসের দাম এখন উর্ধমুখী। এ কারনে গ্যাস মজুত সম্পন্ন আফ্রিকার দিকে সকল পূঁজিপতিদের নজর। কিন্তু তেল বা গ্যাস উত্তোলনে ঐ মহাদেশের লোকদের উপকার হবে কম। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো লাভবান হলেও জলবায়ু সংকটের কারনে দরিদ্রগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
উন্নয়নশীল দেগশসমূহে বিনিয়োগ বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কার্বন ট্রেডিং স্কিম চালুর প্রস্তাব করেছে। সমালোচকরা জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় এ পরিকল্পনার কার্যকারিতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। এর ফলে মানবাধিকার ক্ষুন্ন হতে পারে বলে অনেকে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এ নিয়ে সম্মেলনে নীরব প্রতিবাদ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু দূত জন কেরি বলেছেন, নতুন উদ্যোগটি বেজোস আর্থ ফান্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বে তৈরি হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা অর্থ সংগ্রহের জন্য চেষ্টা করছেন। জন কেরি বলেন, নতুন উদ্যোগটি নবায়নযোগ্য জ্বালানীর সক্ষমতা রূপান্তরে প্রয়োজনীয় ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে সাহায্য করবে। তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন, অতীতের ভূলগুলি কার্বন বাজারের সুনামকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শক্তিশালী সুরক্ষা নিশ্চিত করে শুধু উন্নত মানের ক্রেডিট ব্যবহার করা হবে।
গ্লাসগো-শর্ম আল-শেখ কর্মপরিকল্পনার অধীনে অভিযোজন সংক্রান্ত বৈশ্বিক লক্ষ্যের (জিজিএ) একটি কাঠামো তৈরির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আহ্বান জানিয়েছে। অগ্রগতি কিছু হবে কিন্তু অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন দ্বিগুন করার লক্ষ্য এ বছরে পুরন হবে না। ধনী দেশগুলোর লুন্ঠন ও শোষনের শিকার দরিদ্র দেশগুলো চরম জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে তারা অসহায়। কারন তাদের অর্থসংস্থান নাই। ধনীদেশগুলোই জলবায়ু সংকট সৃষ্টি কররেছ। কিন্তু তুলনামূলকভাবে খুব কম মাত্রায় কার্বন নি:সরনকারী দরিদ্র দেশগুলো বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন অর্থের। সম্মেলনে উপস্থাপিত একটি নতুন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হলে (জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে) ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে। দরিদ্র দেশগুলোকে গ্রিনহাউস গ্যাস নি:সরন কমাতে এবং চরম আবহাওয়ার প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করার জন্য ২০২০ সাল থেকে বছরে ১০০ বিলিয়ন দেয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা পুরন হয়নি। ধনী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরনে যত সময় ধরে ব্যর্থ হতে থাকবে, উন্নত দেশগুলোর উপর উন্নয়নশীল বিশ্বের আস্থা তত কমতে থাকবে। জলবায়ু অর্থায়নের উন্নত দেশগুলি যে অর্থ দেয় তার বেশির ভাগই মধ্যম আয়ের দেশগুলোর নি:সরন কমানোর প্রকল্পে ব্যয়িত হয়। ফলে সবচে কম কার্বন নি:সরনকারী দরিদ্র দেশগুলো সবচে কম সহায়তা পেয়েছে। বিপর্যয়ের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপায়গুলোর জন্য এসব দেশগুলোর সহায়তার বেশি দরকার। যেমন দরকার নতুন করে বনায়ন বাড়ানো, আগাম সতর্কবার্তা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা তৈরি করা। বর্তমানে এসব খাতে তথ্য অভিযোজনের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের মাত্র এক পঞ্চমাংশ দেয়া হচ্ছে। গত বছর প্রতিশ্রুতি ছিল এটি দ্বিগুন করা হবে।
“অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি” জলবায়ু সংকটের বিধ্বংসী প্রভাবকে বুঝায়। বিষয়টি বছরের পর বছর তথাকথিত টেকনিক্যাল আলোচনায় আবদ্ধ করে রাখা হয়। অবশেষে অপূরণীয়ক্ষতি ও এর অর্থায়নের বিষয়টি অনিবার্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলতে পারেন যে, খাদ্য, জীবনযাত্রা ও জ্বালানী সংকটের মধ্যে এ ধরনের অর্থায়ন অসম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে কাজ করা গ্রুপ দ্যা লস এন্ড ড্যামেজ কোলাবরেশনের নতুন একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২২ সালের প্রথমার্ধে মাত্র ছয়টি জীবাশ্ম জ্বালানী কোম্পানী উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চরম আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কিত ইভেন্টগুলোর খরচ বহন করার জন্য যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছে। অন্য এক হিসাবে তৈল কোম্পানীগুলি প্রতিদিন ১ বিলিয়ন ডলার লাভ করে। জাতিসংঘের মহাসচিব অন্তোনিও গুতেরেস লস এন্ড ড্যামেজ বা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূর্যোগ থেকে সৃষ্ট ক্ষতি বাবদ অর্থ দেয়ার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানীর বড় কোম্পানীগুলোকে “উইন্ডফল ট্যাক্স” আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি থাকলেও সবচে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রতিনিধিদের তুলনায় তেল ও গ্যাস কোম্পানীগুলোর লবিষ্ট ছিল বেশি। শার্ম আল-শেখের সম্মেলনে তেল ও গ্যাস শিল্পের ৬৩৬ জন প্রতিনিধি রয়েছেন। যা আগের বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি। গ্লাসগোতে এ সংখ্যা ছিল ৫০৩। দুষণকারী লবিষ্টদের নীতিনির্ধারন প্রক্রিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন অধিকার দেয়া হলে জলবায়ু সংকট অর্থপূর্ণভাবে সামলানো যাবে না।
বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে নাই। এটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিষ্ঠান। তবে অনেকেই এর সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন বিশ্বব্যাংক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় মনযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং একুশ শতকের জন্য উপযুক্ত নয়। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন কিন্তু সম্মেলন শেষে তাঁর পদ নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। যদি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সংস্কার হয়, তবে এটি হবে শার্ম আল-শেখের সম্মেলনের সবচে বড় অর্জন। চীনের জলবায়ু বিষয়ক দূত শি ঝেনহুয়া যুক্তরাষ্ট্রের দূত জন কেরির সঙ্গে আলোচনা পরবর্তী সাক্ষাতকারে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনার বাধাগুলো দূর করার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষায় “যুক্তরাষ্ট্র দরজা বন্ধ করে দিয়েছে এবং চীন এটি খোলার চেষ্টা করছে।” কূটনৈতিক স্থবিরতা জলবায়ু আলোচনায়ও ছায়া ফেলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব একটি অভিন্ন কৌশল বাস্তবায়ন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে আহ্বান জানান। তিনি সহযোগীতা নয় ধংস দুটির একটিকে বেছে নিতে বলেন।
সম্মেলন শেষ হওয়ার পূর্বেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি কার্যকর জলবায়ু চুক্তির সই করার আহ্বান জানান কপ-২৭ এর প্রেসিডেন্ট সামেহ হাসান শাউক্রি। গত ১৪ই নভেম্বর তিনি এ বিষয়ে জলবায়ু আলোচকদের সতর্ক করে বলেন, বিশ্ববাসী দেখছে, দ্রুত একটি কার্যকর চুক্তিতে পৌছাতে হবে। সম্মেলন শেষ হওয়ার আগেই একটি সমন্বিত, উচ্চাভিলাষী ও ভারসাম্য মূলক ফলাফল বের করে আনতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর জরুরী প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তা দানের জন্য কপ-২৭ সম্মেলনে একটি বিশেষ স্কীম/তহবিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। “গ্লোবাল শিল্ড অ্যাগেইনষ্ট ক্লাইমেট রিস্কস” নামের এই তহবিলের আওতায় ২০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ সরবরাহ করা হবে। জি-৭ এর সদস্যসহ কয়েকটি দেশ এ উদ্যোগে অর্থ দেবে।