প্রতি বছর ঈদযাত্রায় যাত্রীদের বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সবচেয়ে ব্যস্ততম সড়ক এবং ঈদে এ চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একসঙ্গে অনেক যানবাহন চলাচল করার ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সুযোগ নিয়ে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত যাত্রীবাহী যানবাহনে ছিনতাই ও ডাকাতি করে থাকে। রাতে এ শঙ্কা আরও বেড়ে যায়, যখন মলম পার্টি, পান ও শরবত পার্টির সদস্যরা যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
সম্প্রতি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দাউদকান্দি থেকে চৌদ্দগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ অংশে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা ঈদযাত্রায় যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের ডাকাতির হটস্পট খ্যাত কাঁচপুর থেকে মেঘনা টোলপ্লাজা পর্যন্ত প্রায়ই ঘটছে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা। আগস্ট পরবর্তী সময়ে রাত হলেই এ মহাসড়ক দিয়ে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকদের প্রায়ই পড়তে হচ্ছে ডাকাত ও ছিনতাইকারীর কবলে। ফলে এবারের ঈদযাত্রা নিয়ে এ মহাসড়কে চলাচলকারী যাত্রী ও চালকদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। পটপরিবর্তনের সাত মাসে এখানে বহু ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে, দেশের অন্যতম ব্যস্ত এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজারের বেশি যানবাহন চলাচল করে। তবে বছরের দুই ঈদকে কেন্দ্র করে এ মহাসড়কে পরিবহনের চাপ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। এই সময়টায় ছিনতাইকারী ও ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মানুষের সর্বস্ব লুটে নেওয়ার ঘটনা বাড়ে। তাই এবারের ঈদযাত্রা নিয়ে যানবাহন চালকরা বেশ আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।
গত সাত মাসে মহাসড়কের কাঁচপুর থেকে মেঘনা টোলপ্লাজা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনায় মানুষের মনে ভীতির জন্ম দিয়েছে। যার কারণে এ অংশকে অপরাধের হটস্পট হিসেবে গণ্য করেন পরিবহন চালকরা।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জে ৫ আগস্টের পর ঘটে যাওয়া ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মধ্যে ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে সাংগঠনিক কাজে ঢাকা থেকে বান্দরবানের লামায় যাওয়ার পথে সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া অংশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের মাইক্রোবাস আটকে দেয় একদল ছিনতাইকারী। তখন সমন্বয়কদের ওপর হামলা করে তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় অপরাধীরা।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি আবু হানিফ ও রাজিব ভূঁইয়া নামের দুই প্রবাসী ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার পথে মহাসড়কের বন্দর এলাকার কেওঢালা এলাকায় ডাকাতদের কবলে পড়েন। তাদের সব কিছু নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ভোরে মহাসড়কের সোনারগাঁ পিরোজপুর ইউনিয়নের আষাড়িয়ারচর এলাকার সাধু পেপার মিলের সামনে সিরাজুল ইসলাম নামের এক কুয়েত প্রবাসী ডাকাতির শিকার হন। সেই রাতে ভুক্তভোগীকে বহনকারী গাড়িতে হামলা চালিয়ে পাসপোর্টসহ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের মালামাল লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ওই রাতেই অসুস্থ বোনকে চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থেকে আসা এক নারী ও তার দেবর ছিনতাইয়ের শিকার হন। সেই রাতে হাসপাতালের কাজ শেষে নিজের খালাতো ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার পথে সোনারগাঁয়ের পৌর এলাকার দৈলেরবাগে একদল ছিনতাইকারী ওই নারী ও তার দেবরকে আটকে তাদের সঙ্গে থাকা নগদ অর্থ ও স্বর্ণের চেইন নিয়ে যায়।
সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ দুপুরে মহাসড়কের সোনারগাঁয়ের দড়িকান্দি ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে দিনদুপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের মাইক্রোবাস থামিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ডাকাতি করা হয়।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানা পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাইওয়েতে ডাকাতির ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে। এবারের ঈদযাত্রায় ডাকাতি ও ছিনতাই রোধে এরই মধ্যে পুলিশের অতিরিক্ত ফোর্স কাজ করছে। তেমন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না বলেও আশা করেন তারা।
উপজেলার কাঁচপুর, মদনপুর ও মোগরাপাড়া বাসস্ট্যান্ডের টিকিট কাউন্টারের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত যাত্রীর চাপ তেমন পড়েনি, তবে ২৫ রোজার পর থেকে দম ফেলার সময় পাবেন না। প্রশাসনের তৎপরতায় ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রা স্বস্তির হওয়া সম্ভব। যাত্রী এবং চালকদের নিরাপত্তায় প্রশাসনকে মহাসড়কে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করেন তারা।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াহিদ মোরশেদ বলেন, ঈদযাত্রায় যাত্রীদের নিরাপত্তায় এখন থেকেই আমাদের টহল টিম বাড়িয়ে দিয়েছি। দুদিন পর থেকে আমাদের টহল টিম আরও বাড়বে। আমরা মহাসড়কে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সর্বদা সতর্ক অবস্থানে আছি। আশা করি এবারের ঈদযাত্রায় কোনো ভোগান্তি হবে না।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ সার্কেল) আসিফ ইমাম বলেন, এবারের ঈদযাত্রায় ঘরমুখী সাধারণ মানুষ যেন স্বস্তি ও নিরাপদে যেতে পারে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত পাঁচটি টহল টিম দেওয়া হয়েছে। ২৬ মার্চের প্রোগ্রাম শেষ হলেই আমরা আরও টহল টিম বাড়াব। মহাসড়কে ডাকাতি-ছিনতাই রোধে আমরা বাড়তি সিসিটিভির ব্যবস্থা করেছি। মহাসড়কজুড়ে ঈদের আগে ও পরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে।
এদিকে সম্প্রতি কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত ডাকাতির ঘটনা বেড়েছিল, ফলে মহাসড়ক আতঙ্কে পরিণত হয়েছিল। তবে কুমিল্লা জেলা পুলিশ ডাকাতদের তালিকা করে তিনটি সক্রিয় ডাকাত গ্রুপ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে একটি গ্রুপ গ্রেপ্তার হওয়ায় ডাকাতির ঘটনা কিছুটা কমেছে। তবে হাইওয়ে পুলিশের ঢিলেঢালা টহল সিস্টেমের কারণে কিছুদিন এ ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছিল; কিন্তু এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।
হাইওয়ে পুলিশ কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ২৬টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে ১২টি পয়েন্ট বিশেষভাবে ঝুঁকিপ্রবণ, যেমন-দাউদকান্দির বলদাখাল বাসস্ট্যান্ড, গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড, চান্দিনা বাসস্ট্যান্ড, আলেখারচর, ক্যান্টনমেন্ট মোড়, ফৌজদারহাট ইউটার্ন ইত্যাদি। কম ঝুঁকিপ্রবণ স্পটগুলোর মধ্যে শহীদনগর, আমিরাবাদ, মাধাইয়া বাসস্ট্যান্ডসহ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট রয়েছে।
কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা কালবেলাকে বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে মহাসড়কের পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চলছে। পাশাপাশি যানজটমুক্ত রাখতে হাইওয়ে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিক সমন্বয় সভা চলছে।’
এ ছাড়া সড়ক ঘেঁষে অবৈধ স্থাপনা, যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা এবং গাড়ি পার্কিংয়ের কারণে যানজটের ভোগান্তি বাড়ে। এর ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট হয় যাত্রীদের এবং চালকদের। তবে এবার ঈদে লম্বা ছুটির কারণে যানজট কিছুটা কম হবে। তবে হাইওয়ে পুলিশ যাত্রী নিরাপত্তা এবং যানজট নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. খাইরুল আলম বলেছেন, ‘ঈদযাত্রায় বিড়ম্বনা কমাতে হাইওয়ে পুলিশ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে একাধিক সভা করে সমন্বয় বাড়ানো হয়েছে। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামার বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।’
কুমিল্লা অঞ্চলে হাইওয়ে পুলিশের কাছে ২২টি চেকপোস্ট, ৭২টি টহল টিম, ২২টি যানবাহন চেকিং টিম, ৩৮টি ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ টিম, ১৩টি বাসস্ট্যান্ড চেকিং টিম, ২২টি সার্বক্ষণিক রেকার টিম, ২৩টি অ্যাম্বুলেন্স, ২২টি কুইক রেসপন্স টিম এবং ৬টি অস্থায়ী কন্ট্রোলরুম থাকবে। এসব পদক্ষেপের কারণে ঈদযাত্রায় যাত্রীদের দুর্ভোগ কমবে এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে বলে আশা করছে হাইওয়ে পুলিশ।