ঢাকার মীরপুর মুক্ত করতে অনেক চড়া মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের – আবুল বাসার

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প-২৫
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ৪ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.আবুল বাসার বলেন, দেশের অবস্থা তখন খুবই খারাপ ছিল। এমনিতেই যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখে আসছি পাকিস্তানীরা আমাদের উপর শোষন করছে। তাদের অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। জগদ্দল পাথরের মতো তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ,যদি কখনো সুযোগ হয় তাহলে নিজের শেষ রক্ত দিয়ে হলেও দেশকে স্বাধীন করতে চেষ্টা করব। এই ভাবনা থেকেই যুদ্ধে যাওয়া। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের এলাকার শরীফুল ইসলাম,আবদুল কাদের,আমির হোসেন ও মো.হানিফসহ আমরা ২৫জন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা দিয়ে কোনাবন সীমান্ত হয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে আমরা ভারতে যাই যুদ্ধ করার জন্য। ভারতে যাওয়ার পর আমাদের প্রথমে ত্রিপুরার কংগ্রেস ভবনে পাঠানো হয়। এখানে একদিন থাকার পর আমাদের দূর্গা চৌধুরী পাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে পাঠানো হয়। এই ক্যাম্পে ৫ দিন থাকার পর একদিন সকালে দেখি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও জেনারেল নাসিম আমাদের ক্যাম্পে হাজির। জনারেল এম এ জি ওসমানী বললেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লোক নেওয়া হবে। তখন আমাদের ক্যাম্পে কয়েকশ’র উপর যুবক ছিল। এর মধ্যে তারা আমাদের ৩০ জনকে বাছাই করে ১১ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফটিকছড়ি আর্মি ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়। সেখানে আমরা প্রশিক্ষন নেই। প্রশিক্ষনের পর আমাদের দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল ৩নং সেক্টরের অধীন। ৩নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন পরবর্তীকালে সেনা প্রধান ও সংসদ সদস্য কে এম সফিউল্লাহ।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
বীরমুক্তিযোদ্ধা মো.আবুল বাসার বলেন,আমি প্রথম যুদ্ধে অংশ নেই সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আখাউড়া। এই যুদ্ধে লে.কর্নেল মঈন সাহেবের নেতৃত্বে আমরা সেনাবাহিনীর ৯০০ সদস্যের একটি শক্তিশালী টিম অংশ নেই। আর পাকিস্তানীরা ছিল প্রায় ২৫০ এর মত সৈনিক। তারা সংখ্যার দিক থেকে আমাদের তুলনায় অনেক কম হলেও অস্ত্র এবং প্রশিক্ষনে তারা ছিল হাজার গুন শক্তিশালী। আমরা ছিলাম আখাউড়া জংশনের ভারত সীমান্তের দিকে আর হানাদার বাহিনী ছিল আমাদের বিপরীত পাশে। একটি কঠিন মুখোমুখি যুদ্ধ হয়। একটানা এখানে ১৫ দিন যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানীরা পরাজিত হয়ে পিছনের দিকে ব্রাক্ষনবাড়িয়ার দিকে চলে যায় এবং তাদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। অপরদিকে আমাদের জেনারেল নাসিম পায়ে মাইন পড়লে মারাত্মক আহত হয়। আমাদের নেতা জেনারেল নাসিম আহত হলে সৈনিকেরা প্রতিশোধপরায়ন হয়ে পড়ে। পরে কমান্ডার লে.কর্নেল মঈনের নির্দেশে আমরা তাদের প্রতিরোধে ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়া গিয়ে এ্যাটাক করি। আমাদের এই যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কমান্ডার সহযোগিতা করে। পরে বিরামহীন আক্রমনে এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ঢাকার দিকে চলে যায়। ফলে এ দিন আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়াও মুক্ত করি।
পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আমরা বাই রোডে আরো কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে ঢাকায় যাই। সেখানে রমনা ও রেইসকোর্স ময়দানে তাবু খাঁটিয়ে অবস্থান করি। এখান থেকে আমরা ঢাকার মিরপুরে বিহারীদের সাথে যুদ্ধ করি। কিন্তু কিছুতেই তাদের দমাতে পারছি না। এরই মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকার রেইসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্য দিয়ে আত্মসমর্পন করলেও মিরপুরের ১২ হাজার বিহারীরা আত্মসমর্পন তো করছেই না বরং তারা পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচেছ। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, হানাদার বাহিনীর অনেকেই আত্মসমর্পন করার পূর্বে তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ এই বিহারী ক্যাম্পে বিহারীদের কাছে দিয়ে গেছে। যার কারণে তাদের ক্যাম্পে প্রচুর অস্ত্র রয়েছে। ফলে ১৭ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের সাথে আমাদের সরাসরি প্রচন্ড যুদ্ধ সংগঠিত হয়। আমরা এই ১৫ দিন তাদের গ্যাস,পানি,বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু বিচ্ছিন্ন করে দেই। ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি রাতে আমাদের ২নং ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানীর পুরো টিম ডু অর ডাই হিসাবে এক সাথে আক্রমনে যাই। আর পিছনে ব্যাকাপ হিসেবে অন্যান্য বাহিনী ছিল। আমাদের সম্মিলিত তীব্র আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে অবশেষে শেষ রাতের দিকে তারা আত্মসমর্পন করে। তবে এ দিন আমরা আমাদের ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরসহ ১২জন শহীদ হন। পরে ঢাকা সেনানিবাসের প্রবেশের প্রধান গেইটি জাহাঙ্গীর গেইট নামকরণ করা হয়।আর এই যুদ্ধে বিহারীদের প্রচুর হতাহত হয়। আত্মসমর্পনের পর আমরা বিহারীদের মোহাম্মদপুরে নিয়ে স্থানান্তর করি।

পরিচয় : মো.আবুল বাসার। পিতা মৃত হাজি আমির হোসেন, মা মৃত সালেহা খাতুন। ১৯৫৬ সালের ১২ আগস্ট তিনি ব্রাক্ষ্মনপাড়া উপজেলার শিদলাই গ্রামের জন্ম গ্রহন করেন। পিতা মাতার ৬ ছেলে ও ২ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়।
দেশে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি শিদলাই হাই স্কুলের মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন।