‘ দেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে রেখে, আমরা পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি না ’

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৮ মাস আগে

জাহিদ হাসান নাইম।।

‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দদের ভাবনা’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) রাতে কুমিল্লা আল নূর হসপিটালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় ১৩৯ তম পর্বে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক মোহাম্মদ আবু রায়হান, এম এইচ আবির, মুহাম্মদ রাশেদুল হাসান ও সাকিব হোসাইন। এসময় টক-শো তে ছাত্র আন্দোলনসহ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক মাস ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতৃবৃন্দদের ভাবনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে এসেছে। আলোচনার এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আবু রায়হান বলেন, ৭১ সালে আমরা বহু প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করি। ৭১ পরবর্তীতে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যটুকু পূরণ হয় নি। জনগণ নানা শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। সর্বশেষ ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা স্বৈরাচার সরকার ক্ষমতায় এসে এই দেশের মানুষের স্বপ্নগুলোকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিলো। মানুষদের প্রতিটি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো। কোটার আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্র জনতার পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখনই আন্দোলনটা সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রতিটি উপজেলাতেই শেখ হাসিনা বাহারের মতো সন্ত্রাসীদের বসিয়ে রেখেছিলো, যার আক্রোশের শিকার হয় জনগণ। আগষ্টের ৩ তারিখ বাহারের সন্ত্রাসী বাহিনীদের চ্যালেঞ্জ করে আমরা কুমিল্লা শহরে আন্দোলন করেছিলাম। আমরা দেখেছি ওই সন্ত্রাসীরা কিভাবে আমাদের শিক্ষার্থীদের হামলা করেছিলো। স্বৈরাচারী হাসিনার দোসররা বিভিন্ন স্তরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ, তাদেরকে খুঁজে বের করুন। নয়তো তারা একেকবার একেক রূপ নিয়ে ফিরে আসবে। ৫ আগষ্টের পর থেকে একজন ব্যক্তিও রাজনৈতিক হত্যাকা-ের শিকার হয় নি। সবাই উন্মুক্ত হয়ে লেখালেখি করতে পারছে, কথা বলতে পারছে। এভাবে চলতে থাকলে, আমরা যে দেশের স্বপ্ন দেখি, তেমনই একটি দেশ গঠন হবে। শিক্ষকদেরকে হেনস্থা করার অধিকার কোনো সমন্বয়ককে দেওয়া হয় নি, এগুলো আওয়ামী দোসরদের কাজ। আওয়ামী দোসররাই এখন সাংবাদিক, ডাক্তারদের হেনস্থা করছে। তাদেরকে আমরা সাবধান করে দিতে চাই। তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ নয়। সবশেষ, আমরা একটি বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ চাই। ভয়হীন বাংলাদেশে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে পারবে এটাই আমাদের চাওয়া। এম এইচ আবির বলেন, একটা সরকার যখন জনগণের চাওয়া পূর্ণ করতে পারে না, তখন জনগণ আন্দোলনে নামে। শেখ হাসিনা সরকার প্রথমেই আমাদের দাবি মেনে নিলে আন্দোলন এত বড় রূপ নিতো না। কিন্তু, তিনি সেটা না করে বরং ছাত্রদেরকে রাজাকার বলে সম্বোধন করে। এই কারণেই সরকার পতনের পথ আরো তরান্বিত হয়। ১১ জুলাই আমাদের উপর যে হামলা হয়েছিলো, সেটি স্পষ্টতই প্রশাসনের আদেশে হয়েছিলো। আমরা আমাদের ভাইদের উপর যারা হামলা করেছিলো, তাদের বিচার নিশ্চিত করবোই। নতুনভাবে নাগরিক ঐক্য কমিটি নামে যে দল গঠিত হয়েছে, ফ্যাসিবাদী কাঠামো শক্তির বিরুদ্ধে ও জনস্বার্থে কাজ করার জন্য তৈরী করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম, গণপরিষদ গঠন করে গণমতের সাহায্য সংবিধানকে সংস্কার করা। শিক্ষার্থীদের কাজ হবে শিক্ষার্থীসূলভ। শিক্ষার্থীদের কাজ শিক্ষকদের সাথে বেয়াদবি না করা। এক্ষেত্রে আবার, যেসব শিক্ষক আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের প্রকাশ্যে বাঁধা দিয়েছিলো বা স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার দাবি অনুযায়ী প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে। সবশেষে আমি বলবো, দূর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজিমুক্ত রাষ্ট্র দেখতে চাই আমরা। আমরা চাই, রাষ্ট্রকে সংস্কার করে নাগরিকদের বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাবো। মুহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, স্বৈরাচার সরকার ১৮ থেকে শুরু করে ২৪ পর্যন্ত ছাত্রদেরকে দমন করতে চেয়েছিলো। স্বৈরাচার সরকার তার অহমিকা থেকে ছাত্রদের উপর দমন পীড়ন শুরু করেছিলো। ২০১৮ থেকে নয়, বরং ২০০৯ সাল থেকেই এই সরকারের দমন পীড়নের শিকার হয়েছিলো জনগণ। সন্ত্রাসী পুলিশি বাহিনী দিয়ে জনগণের উপর অত্যাচার চালাতো। আবার, কুমিল্লায় যারা আহত হয়েছিলো, তাদের তালিকা আমরা ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি। তাদের উপর যারা হামলা করেছিলো তাদের অবশ্যই বিচার হবে, যা সারা বাংলাদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ছাত্ররা সকল বিষয়ে পা-িত্য অর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ভবিষ্যতে, রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, রাজনীতি হতে হবে প্রজার নীতি। ছাত্ররা যদি সামনে এগিয়ে না আসে তাহলে তা কখনোই সম্ভব হবে না। এই ১৬ বছর, জবাবদিহিতার রাজনীতিও ছিলো না। ছাত্ররা যাতে সেই জবাবদিহিতার রাজনীতি করতে পারে ভবিষ্যতে সেটা নিয়ে কাজ করা হবে। তবে, বর্তমানে ছাত্ররা রাজনীতি করা নিয়ে ভাবছে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয়ে যারা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করছে তারা আমাদের স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু, সেই পরিচয়ে কেউ যদি অনৈতিক কাজ করে তাহলে তাকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিবেন। সে আমাদের সমন্বয়ক হতে পারে না। আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই, যেখানে ছাত্ররা পড়ালেখা শেষ করে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী চাকরী করতে পারবে। যেখানে সকল প্রকার বৈষম্য দূর হবে। সাকিব হোসাইন বলেন, আমাদের চাওয়া ছিলো কোটা সংস্কার, আমরা বাতিল চাই নি কখনোই। সরকার একটা পর্যায়ে গিয়ে সেটি বাতিল ই করে দিয়েছিলেন। এতেই বুঝা যায়, এটা পরিকল্পিত ছিলো। সামান্য কোটা আন্দোলন নিয়ে যেভাবে শিক্ষার্থীরা প্রাণ হারিয়েছিলো, পরবর্তীতে মানুষ ধারণা করেছিলো সরকার পতনে আর কতো না প্রাণ হারাবে। তখন থেকেই ছাত্রদের সাথে জনতারাও এসে জড়ো হয় এবং সরকার পতনের ডাক উঠে। কুমিল্লা থেকেই মূলত ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো। আমাদের উপর কুমিল্লা কোটবাড়ি আনসার ক্যাম্প ‘বর্তমান ছাত্র আন্দোলন চত্তর’ এলাকায় আমাদের উপর পুলিশ হামলা করেছিলো। তার থেকেই এই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আবার, ৫ আগষ্টের পর থেকে আমরা যারা আহত হয়েছিলো, তাদের খোঁজ খবর নিয়ে আমরা তালিকা করেছি। তেমনি ভাবে, যারা ছাত্র আন্দোলনের সত্যিকার অর্থে আমাদের ভাইবোনদেরকে আহত করেছিলো, হামলা করেছিলো তাদের তালিকাও করা হবে। তাদের বিচার এই দেশের মাটিতেই হবে। বর্তমানে আমাদের ছাত্ররা কোনো রাজনীতি করছে না। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে আমরা ছাত্ররা সরকারের সহকারী হয়ে কাজ করছি। যেমন, পুলিশ রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু, পুলিশের উপস্থিতি এখন কম। যার কারণে, এই পরিবেশ দূর করতে ছাত্ররা কিছুক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছি। যারা এখন সমন্বয়ক হতে চায়, তারা সুবিধা আছে বিধায় এখন এটা চায়। যখন সমন্বয়কের প্রয়োজন ছিলো, তখন কেউ এগিয়ে আসে নি। আমরা ভুয়া সমন্বয়ক খুঁজে বের করবো। পাশাপাশি, আমরা যেহেতু বৈষম্যের বিরুদ্ধে কাজ করি, তাই আমরা দেশ থেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদেরও খুঁজে বের করবো। সবশেষ বলতে চাই, আমরা পড়ার টেবিলেই ছিলাম, আমাদেরকে স্বৈরাচারী সরকার বাধ্য করেছে রাস্তায় নামতে। দেশ এখনো সম্পূর্ণভাবে ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয় নি, এখনো যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের মাঝেই আমরা কিভাবে এভাবে সব রেখে পড়াশোনায় ফিরে যাবো। তবে, আমরা চাই এসবের পাশাপাশি পড়ালেখাও চলুক। শিক্ষার বিকল্প নেই। দেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে রেখে আমরা পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি না।