নেত্রকোনার ৫৭ নদী অস্তিত্ব সংকটে

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ১০ মাস আগে

অস্তিত্ব হারাতে বসেছে নেত্রকোনার কংস, ধনু, মগড়া, সোমেশ্বরীসহ ছোটবড় ৫৭টি নদী। নাব্যতা হারিয়ে কিছু কিছু নদী পরিণত হয়েছে মরা খালে। কোনো কোনো নদী ধু ধু বালুচর। নিয়মিত খননের অভাবে এসব নদীতে জেগে উঠেছে চর। নদীর নব্যতা হারানোতে জেলেরা হারিয়েছে কর্মসংস্থান।

অন্যদিকে, নদীতে পানি না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ। পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশও পড়েছে হুমকির মুখে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কংস, ধনুসহ কয়েকটি নদী খনন কাজ চলছে। বাকিগুলোও খননের জন্য সার্ভে সম্পন্ন হয়েছে।

সোমবার (১২ জুন) ১৮৯৭ সালে এক ভূমিকম্পের পর জেলার বড় বড় কয়েকটি নদী বিলুপ্তির পথ ধরে। বর্তমানে নেত্রকোনার ছোটবড় ৫৭টি নদী অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা বালি ও পলিতে ভরাট হওয়া নদীগুলো এখন মৃত প্রায়। খননের অভাবে জেলার কংস, সুমেশ্বরী, মগড়া, ধনুসহ প্রায় সব কটা নদীতে চলছে ধানসহ বিভিন্ন মৌসুমি শাকসবজির আবাদ। এক সময়ের খরস্রোতা নদী এখন পরিণত হয়েছে ফসলের মাঠে।

সোমেশ্বরী: ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি হয়। অবশ্য এক সময় সমগ্র নদীটি সিমসাং নামে পরিচিত ছিল। ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অঞ্চল দখল করে নেওয়ার পর থেকেই নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। গারো পাহাড় অঞ্চলে গারো সমাজ সচেতন হওয়ার পর থেকে তারা আবারো সোমেশ্বরী নামের পরিবর্তে সিমসাং ডাকতে শুরু করেছে।

নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদী মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং মিশন ও পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাণীখং পাহাড়ের পাশ বেয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর শিবগঞ্জ বাজারের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী নদী বরাবর পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। কলমাকান্দা, মধ্যনগর হয়ে ধনু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সোমেশ্বরী। সোমেশ্বরীর মূলধারা ও উৎসস্থলে এখন বিলুপ্ত প্রায়।

এখন বর্ষা মৌসুমেও নদীতে পানি প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ি ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয়ভাবে শিবগঞ্জ ঢালা নামে খ্যাত। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। এ স্রোতধারাটি চিতলির হাওর হয়ে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে কংস নদী সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে পাহাড়ি ঢলে আতরাখালী নামে সোমেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদীটির সৃষ্টি হয়। সুসং দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে আতরাখালী।

কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আতরাখালী নদী এখন মরে গেছে। আরও ভাটিতে সোমেশ্বরীর শাখা নদীর সৃষ্টি হয়েছে গুনাই, বালিয়া ও খারপাই। তবে, সোমেশ্বরী নদীর পাঁচটি বালু মহাল এখন ইজারা দেওয়া হয়। প্রতি বছর এসব বালুঘাট থেকে প্রায় একশো কোটি টাকা রাজস্ব পায় সরকার। এছাড়া এই নদীর নুড়ি পাথর থেকেও প্রতি বছর সরকার কোটি টাকার রাজস্ব পায়।

কংস নদী: ভারতের তুরা পাহাড়ে বিভিন্ন ঝর্ণা থেকে কংস নদীর উৎপত্তি। শেরপুরের হাতিবাগার এলাকা দিয়ে কংস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উৎপত্তিস্থল থেকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী পর্যন্ত ওই নদীটির নাম ভূগাই। নালিতাবাড়ীর ৫ মাইল ভাটিতে এসে দিংঘানা, চেল্লাখালী, দেওদিয়া মারিসি, মলিজি নামে উপনদী গুলো ভূগাইয়ের মিলিত হয়েছে। ভূগাই সে স্থানে বেশ খরস্রোতা হলে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ফুলপুরের কাছাকাছি এসে খড়িয়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

খড়িয়া ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার পর থেকে ভূগাই নদীটি কংস নামে খ্যাত। মেঘালয় থেকে শিববাড়ীর পাশ দিয়ে নিতাই নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সদর হয়ে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার শঙ্করপুরের কাছে নিতাই কংস নদীতে মিলিত হয়েছে। এতে কংস তার পূর্ব পথের গতির চেয়ে অনেকাংশে বেড়ে গেছে। নেত্রকোনা জেলার ভেতরে পূর্বধলা উপজেলায় কংসের দৈঘ্য ৯ মাইল। দুর্গাপুর, ধৌবাউড়া ও পূর্বধলা উপজেলার সীমানা বরাবর ২০ মাইল। নেত্রকোনা সদর উপজেলায় ৬ মাইল।

নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা সীমানা বেয়ে ৭ মাইল। বারহাট্টা উপজেলায় কংসের দৈঘ্য ১১ মাইল। বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ সীমানা বেয়ে ৬ মাইল। মোহনগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার সীমানা বরাবর ১৯ মাইল প্রবাহিত হয়ে ঘোরাউৎরা নদীতে মিলিত হয়েছে।

নেত্রকোনা জেলার ভেতর অনেক শাখা নদী কংস নদী থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলার সীমানোয় কংস থেকে একটি শাখা নদী দক্ষিণ দিকে ছুটে গিয়ে ধলাই নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। যা কালিহর নদী নামে পরিচিত। কালিহরের শাখা নদী খানিগাঙ। এক সময় খানিগাঙ বেশ খরস্রোতা ছিল। এখন মরাগাঙ। এর মধ্যে জারিয়া বাজারের পূর্বদিক দিয়ে শলাখালী শাখা নদীটি বেরিয়ে ধলামূলগাঁও ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে লাউয়ারী নামে ত্রিমোহনীতে এসে মগড়া নদীতে পতিত হয়েছে।

নেত্রকোণার পূর্ব ইউনিয়ন ঠাকুরাকোণা বাজারের পাশ দিয়ে বরাবর দক্ষিণ দিক দিয়ে আটপাড়া উপজেলার পাশে এসে মগড়া নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এ নদীটিতে তেমন পানি প্রবাহ থাকে না। বর্ষায় এখনো বেশ খরস্রোতা হয়।

ধনু নদী: কোনো স্থানে এ নদী বৌলাই কোনো স্থানে ঘোরাউৎরা নামে পরিচিত। এটি মেঘনা নদীর অন্যতম উপ নদী। এর উৎপত্তিস্থল ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। মেঘালয়ের যাদুকাটা ও ধোমালিয়া এ দুটি নদী একত্রিত হয়ে ধনু নদীর মূল প্রবাহের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এসে এর একাংশ সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর হয়ে দক্ষিণে চলতে শুরু করেছে।

তাহিরপুরে সোমেশ্বরী এসে ধনু নদীতে পতিত হয়েছে। এ নদীটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এ নদীটির প্রথমে ধনু, মধ্যভাগ বৌলাই, শেষাংশ ঘোরাউৎরা নামে মেঘনায় পতিত হয়। ধনুও বেশ খরস্রোতা একটি নদী। জেলার প্রায় সবকটি নদীই এ নদীতে পতিত হয়ে ভাটিতে মিশে গেছে।

মগড়া নদী: ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে মগড়ার উৎপত্তি। সেনেরচর নামক স্থান থেকে খড়িয়া নদী বেয়ে সারাসরি মগড়া নদীর প্রবাহ।সে প্রবাহ ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বুড়বুড়িয়া বিলে এসে পতিত হয়েছে। বুড়বুড়িয়া বিল থেকে বেরিয়ে গজারিয়া ও রাংসা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফুলপুরের ঢাকুয়া নামক স্থানের ভেতর দিয়ে সরাসরি পূর্বদিকে ধলাই নামে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার পূর্বধলা উপজেলার হোগলা বাজারের পাশ দিয়ে পূর্বধলা সদরের ভেতর দিয়ে ত্রিমোহনী এলাকায় এসে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে।

ত্রিমোহনীতে এসে ধলাইয়ের সঙ্গে উত্তর দিক থেকে এসে লাউয়ারী নদী মিলিত হয়েছে। সে স্থান থেকে মগড়া নামে পরিচিত। সেখান থেকে প্রথমে পাঁচ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাট থেকে সরাসরি পূর্ব দিকে আকাঁবাকা হয়ে নেত্রকোনা শহরের পাশ দিয়ে আটপাড়া উপজেলার দিকে চলে গেছে। পশ্চিম দিক থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাটের কাছে মগড়ার সঙ্গে ধলাই নামের একটি স্রোতধারা মিলিত হয়েছে।

নেত্রকোনা জেলার ঠাকুরাকোণা থেকে কংস নদী একটি শাখা নদী আটপাড়ায় মগড়ার মিলিত হয়েছে। গৌরীপুর দিক থেকে ছুটে আসা পাটকুড়া নদীটি বসুর বাজার এলাকায় এসে মগড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সাউডুলি, মগড়া ও পাটকুড়ার মিলিত স্রোতে কেন্দুয়ার গুগবাজার কাছে এসে যোগ হয়েছে। সেখানে বর্ষায় স্রোতেপ্রবাহ আনুপাতিক হারে বেশি থাকে। গুগবাজার হয়ে সে নদীটি মদন হয়ে ধনু নদীতে পতিত হয়েছে।

নেত্রকোনা জেলায় মগড়া নদীর গতিপথ সব চেয়ে বেশি। এ নদীটি কোথাও ধলাই নামে কোথাও মগড়া নামে খ্যাত। এ জেলার চারশ বর্গ মাইল এলাকা দিয়ে মগড়া নদীর প্রবাহ রয়েছে। মগড়া কংস নদী ৮/১০ মাইল ব্যবধানে প্রায় ৪০ মাইল সমান্তরালভাবে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি ফসল। এ ছাড়াও কৃষি ও ব্যবসা বাণিজ্য চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

বারহাট্টা উপজেলার চল্লিশকাহনীয়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন ফকির জানান, কংস মগড়া ধনু নদীতে আজকাল পানি নেই বললেই চলে। যেভাবে নদীগুলো ভরে যাচ্ছে তাতে আগামী এক দশকে অস্থিত্ব বিলীন হবে সবকটা নদীর। জেলার প্রতিটি নদী খনন করা প্রয়োজন।

নেত্রকোনা সদর উপজেলার কুমারপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিন বলেন, নওয়াপাড়ার খালটি এখন স্থানীয়রা দখল করে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছে। কেউ দেখছে না। এ কারণে বিলের পানি সময়মতো নামছে না। বোরো মৌসুমে সঠিক সময়ে ধান রোপন করা যায় না। ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

নেত্রকোনা সদর লক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার কামাল মিয়া বলেন, লক্ষ্মীপুর এলাকার মগড়া নদীর বুকে এখন প্রতি বছর বোরোর চাষাবাদ হয়। বাদাম, লাউ কুমরাসহ নানান জাতের শাকসবজিও হচ্ছে। এখন আর একে কেউ নদী বলবে না। ফসলের মাঠ হয়ে গেছে।

সদর উপজেলার বোবাহালা গ্রামের রাজ্জাক মিয়া বলেন, আমার বয়স ৫০ বছর। আমি ছোটকালে দেখেছি দুর্গাপুর থেকে বয়ে আসা সোমেশ্বরী নদী দিয়ে ধান ও পাটের বড় বড় নৌকা ও কার্গো এক কথায় নদী পথে বিভিন্ন হাট বাজার ও বন্দর পর্যন্ত যাতায়াতে একমাত্র মাধ্যম ছিল। এখন খেলার মাঠ হয়ে গেছে।

কলমাকান্দা উপজেলার কৈলাটি ইউনিয়নের সেওড়াগঞ্জ গ্রামের সিরাজ মিয়া জানান, দুর্গারের খোরস্রাতো সোমেশ্বরী নদীতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এমনকি বিখ্যাত সুস্বাদু মহাশোল মাছ পাওয়া যেতো। প্রবাহমান কংস ও সোমেশ্বরী নদী তীরবর্তী এলাকার কৃষক নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহার করে হাজার হাজার হেক্টর জমি চাষাবাদ করতো।

তিনি বলেন, এ নদ-নদী বালি ও পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদী নাব্যতা হারিয়েছে, মাছের অবাধ বিচরণ বন্ধ হয়ে গেছে, সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে, নদী ভরাট হবার কারণে অকালে বন্যায় ফসল বিনষ্ট সহ প্রাকৃতিক বিপর্ষয় নেমে এসেছে।

নেত্রকোনার জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান বলেন, ধনু, কংস খননের কাজ চলছে। এরই মধ্যে নেত্রকোনার দুইশো ঊনষাট কিলোমিটার নদী খননের জন্য সার্ভে করা হয়েছে। নদীর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে।