গত ৬ এপ্রিল ঘোষিত কুমিল্লার সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মী ও তৃণমূলে চরম হতাশা বিরাজ করছে। নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, কমিটিতে ত্যাগী নেতাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়নি। আবার অনেকে গত ১৭ বছর আন্দোলন সংগ্রামে না থেকেও ভালো পদ বাগিয়ে নিয়েছেন।
দুই উপজেলার তৃণমূলের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৭ বছর আন্দোলনে সক্রিয় নেতা-কর্মীদের কমিটিতে মূল্যায়নের যে নির্দেশনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দিয়েছিলেন, তার প্রতিফলন এ দুই উপজেলা কমিটিতে ঘটেনি। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরীর প্রভাবে এমনটা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। এ ক্ষেত্রে চরম প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ,আ’লীগ আমলে ১৩টি মামলার আসামী ও মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে আদালতে আ’লীগ কর্তৃক স্বস্ত্রীক হামলার শিকার হয়ে মারাত্মক আহত হন মাহবুব চৌধুরী।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ বিএনপির আহবায়ক কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন মোঃ মাহবুব আলম চৌধুরী। ইতিপুর্বে তিনি উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্র জীবনে মাহবুব চৌধুরী চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে ছাত্রদলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, উপজেলা যুবদলের সভাপতি ছিলেন।
বিএনপির রাজনীতি করার কারনে নির্যাতন ও কারাবরণ করেছেন বহুবার। স্বৈরাচার সরকারের আমলে ১৩টি মামলা ও মাসের পর মাস কারাগারে ছিলেন। বিএনপি করার কারণে তার স্ত্রীকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়। মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সরকারি চাকুরিতে সুযোগ পায়নি তার সন্তানরা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে রাজপথে ছিলেন মাহবুব আলম চৌধুরী। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি ডিগ্রি কলেজ শাখার যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন একাধিক ছাত্রসংসদ নির্বাচনে। ১৯৮৭ সালে ছাত্রদলের কুমিল্লা সদর উপজেলা আহবায়ক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে ছাত্রদল কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার সভাপতি ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ছাত্রদল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে শিবিরের নির্যাতন ভোগ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৮ সালে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে সুনামের সাথে তৃণমূলকে সু-সংগঠিত করেছেন। দশকের পর দশক থেকে সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির তৃণমূলকে সু-সংগঠিত করে আসা এ নেতাকে কমিটিতে শুধু সদস্য হিসেবে দেখে হতাশা প্রকাশ করে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
২০১৪ সালে যখন কেউ উপজেলা নির্বাচন করতে চাননি তখন দলের নির্দেশে ঝুঁকি আছে জেনেও সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী জানান, সদর দক্ষিণ উপজেলার আহবায়ক কমিটিতে এমন অনেকেই আছেন যারা অতীতে কোন কমিটিতে ছিল না। আন্দোলন সংগ্রামে তাদের কোন ভূামিকা ছিল না। অথচ মাহবুব আলম চৌধুরী এতো বড় ত্যাগী নেতা হয়েও উপজেলা কমিটিতে সম্মানজনক পদ পাননি। তারা জানান, লালমাই উপজেলা কমিটিতেও ঠিক এরকম হয়েছে।
নেতাকর্মীদের দাবি, আমাদের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পস্ট বলে দিয়েছেন যেখানেই যে কমিটি গঠিত হবে তাতে অবশ্যই গত স্বৈরাচার আমলে নির্যাতনের শিকার নেতা-কর্মীরা যাতে গুরুত্ব পায়। অথচ এ দুই উপজেলা কমিটিতে হলো এর উল্টো। কমিটিগুলো গঠনে মনিরুল হক চৌধুরীর প্রভাব কাজ করেছে বলেও অনেকে জানান। এর ফলে অনেক যোগ্যরাও পদ বঞ্চিত হয়েছেন। তৃণমূলে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
ছাত্রদল নেতা মোঃ রাসেল খাঁন বলেন, সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির যে আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে এতে আমাদের দলের জীবন্ত দাফন হয়েছে। কমিটিতে এমন অনেকে রয়েছে যাদেরকে আমরা ৫ আগস্টের আগে কোন আন্দোলন সংগ্রামে দেখিনি। যারা গত ১৭ বছর আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে চলেছে তারা বড় পদ পেয়েছে। আবার ৫ আগস্টের পর যারা মাটির ব্যবসা, মামলা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি শুরু করেছে তাদেরকেও ভালো পদ দেওয়া হয়েছে। অথচ মাহবুব আলম চৌধুরীর মত ত্যাগী নেতারা উপেক্ষিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই হতাশার বিষয়।
সদর দক্ষিণ উপজেলা যুবদলের আহবায়ক সায়েম মজুমদার বলেন, গত ১৭ বছর বিএনপির তৃণমূলের সকল ইউনিট মাহবুব আলম চৌধুরীর অধীনে ছিল। তিনি সবাইকে সুসংগঠিত রেখেছিলেন। সকল আন্দোলনে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ কমিটিতে তিনি কোন সম্মানজনক পদ পাননি। দলে এটার প্রভাব খুব খারাপ ভাবে পড়বে। তোষামোদি ও তেলবাজি করে পদ পাওয়া গেলে আগামীতে আর ত্যাগী নেতা সৃষ্টি হবে না।
সদর দক্ষিণ উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক হারুনুর রশিদ মজুমদার বলেন, মাহবুব আলম চৌধুরীকে কমিটিতে সম্মানজনক পদ দেওয়া হলে দলের জন্য অনেক ভালো হতো।
লালমাই উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক আক্তারুজ্জামান রকেট ও জেলা যুবদল নেতা মো.শাহ আলম অভিন্ন কন্ঠে বলেন, জনাব মনিরুল হক চৌধুরী সাহেব লালমাই উপজেলায় যাদের দিয়ে বিএনপির কমিটি দিয়েছেন তাদের অধিকাংশই গত আন্দোলন সংগ্রামে কোন ভূমিকা ছিল না। আমরা বার বার হামলা ও মামলার শিকার হয়েছি। কারাভোগ করেছি । কিন্তু কমিটিতে যাদের মূল্যায়ন করা হলো তাদের আন্দোলনে কি ভূমিকা ছিল তা জাতি জানতে চায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মাহবুব চৌধুরী বলেন,সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলা বিএনপির কমিটি কার কথায় জেলা নেতৃবৃন্দ দিয়েছেন তা আমি জানি না। দুই উপজেলার নেতাকর্মীদের বক্তব্য মনিরুল হক চৌধুরীর কথায় এ কমিটি দেওয়া হয়েছে। আমার এখন রাজনীতির বয়স ৪০ বছর। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি সদর দক্ষিণ ও লালমাই উপজেলার বিএনপিতে যাদের আহবায়ক ও সদস্য সচিব করেছে তারা গত ১৬ বছর স্বেরাচার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে এক দিন জেল খেটেছে কিংবা মামলার আসামী হয়েছে এমন প্রমান তারা দিতে পারবে না। এমন কি দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়েও তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বৈরাচারের দোসররাও এই কমিটির সদস্য হয়েছেন। এই অবস্থা চললে ভবিষ্যতে আর কেউ দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে না।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম এই কমিটির বিষয়ে বলেন, মাহবুব চৌধুরীকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। মনিরুল হক চৌধুরীও একই কমিটিতে সদস্য। সদস্য কোন ছোট পদ নয়।
কমিটি গঠনে মনিরুল হক চৌধুরীর প্রভাব কাজ করেছে কিনা এ প্রসঙ্গে আশিকুর রহমান মাহমুদ ওয়াসিম বলেন, তিনি একজন সিনিয়র নেতা। আমরা মনিরুল হক চৌধুরীসহ অনেকের সাথে আলোচনা করেই কমিটি দিয়েছি। কমিটিতে মনিরুল হক চৌধুরীর পছন্দের বাইরের অনেকেই রয়েছে। যোগ্য সবাইকে আমরা কমিটিতে রাখার চেষ্টা করেছি।