বাবা চার আনা দিয়ে বললেন, গাজী হয়ে বাড়ি ফিরবি : গোলাম হোসেন চৌধুরী

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -৬
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. গোলাম হোসেন চৌধুরী বলেছেন, চৌদ্দগ্রাম থানার আনসার কমান্ডার ফুফাত ভাই মফিজুর রহমান পাটোয়ারির অনুপ্রেরণায় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করি। বাবা-মা যুদ্ধে যেতে নিষেধ করতে পারে এই ভাবনা থেকে তাদের না বলেই যখন ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই, তখন বাতিসা বাজারে বাবার সাথে আচমকা দেখা হয়ে যায়। সন্ধ্যের সময় কোথায় যাচ্ছি বাবার জিজ্ঞাসার জবাবে ভয়ে মাথা নিচু করে বলি, বাবা দেশকে স্বাধীন করার জন্য, শত্রু মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি। তখন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা পাঞ্জাবির পকেট থেকে চার আনা পয়সা বের করে চোখের পানি ফেলে দিয়ে বললেন, দেশের জন্য যুদ্ধে যাবি এ কথা আগে জানালিনা কেন। যা, দরকার হলে এই চারআনা দিয়ে কিছু খাবি। দেশ স্বাধীন করে গাজী হয়ে বাড়ি ফিরবি।
আনসার কমান্ডার ফুফাত ভাই মফিজুর রহমান পাটোয়ারির নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে স্থানীয় মজিবুল হক মজুমদার, নুরুল ইসলাম, আবদুল মালেকসহ ৫০ জনের একটি দলের সাথে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কাঠালিয়া ক্যাম্পে চলে যাই প্রশিক্ষনের জন্য।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু :
যেহেতু আমরা খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছি,সেহেতু ভারতে গিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়নি। মফিজুর রহমান পাটোয়ারি ভাই যেভাবে বলেছেন ঠিক সেই ভাবেই সরাসরি কাঠালিয়া ক্যাম্পে গিয়ে উঠি। ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ( নামটি এই মুহুর্তে মনে নেই) সাথে পরিচয় দিয়েই ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত হয়ে যাই। তখন কাঁঠালিয়া ক্যাম্পের পুরো দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেস ওয়ার্ক হাওলাদার,মেজর পান্ডে শিং,এবং মেজর হরফে শিং। তারা আমাদের প্রশিক্ষন দেন। এই ক্যাম্পে আমরা তিনশজন তিন সপ্তাহের প্রশিক্ষন নেই। এলএমজি,রাইফেল,গ্রেনেড ও বোমা বিস্ফোরণ বিষয়সহ নানা বিষয়ে প্রশিক্ষন নেই।
প্রশিক্ষন শেষে ক্যাপ্টেন মাহবুবের (পরবর্তী পর্যায়ে জেনারেল মঞ্জু হত্যায় তিনিও নিহত হন) নেতৃত্বে আমাদেরকে নিয়ে একটি যুদ্ধা বাহিনী গঠন করা হলো। আমাদের এই বাহিনীতে প্রায় ১৫০জন সদস্য ছিল। প্রশিক্ষনের সময় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষন দিলেও এলএমজি চালানো প্রশিক্ষনটা আমি বেশ ভালো করি। এবং পরবর্তী পর্যায়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে এলএমজি চালানোতে আমি সফলতা দেখাই। যা আমাদের দেশের সেনা অফিসাররা ও ভারতীয় সেনা অফিসাররাও বেশ প্রশংসা করেছে। তখন আমাদের ২নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশারফ আর সেকেন্ড কমান্ডার ছিলেন মেজর হায়দার।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রথম যুদ্ধের ঘটনাটি বলতে গিয়ে বীরমুক্তিযোদ্ধা গোলাম হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি প্রথম সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেই কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কটক বাজারে। জুনের শেষ দিকের এই যুদ্ধে গোমতী নদীর পশ্চিম পাড়ের গাজি আইলে আমরা মুক্তিযুদ্ধারা ডিফেন্স করি। আমাদের সাথে ছিলেন বিভিন্ন পর্যায়ের সেনা,মুজাহিদ,বিডিআর,পুলিশ,আনসার ও এফএফসহ প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মুক্তিযোদ্ধা। আর কটকবাজারের হযরত শাহজালাল (রাহ.) এর মাজারের পূর্ব দিকে ছিল মুক্তিবাহিনীর আরেকটি ডিফেন্স আর পশ্চিম দিকে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর ডিফেন্স। উভয় দিকে আমাদের ডিফেন্সটি ছিল অত্যান্ত শক্ত এবং শক্তিশালী। এই যুদ্ধে স্টুডেন্ট প্লাটুনের নেতৃত্ব দেন ইকবাল আহমেদ বাচ্চু, বর্তমান কুমিল্লা জেলা ইউনিটের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল এবং মজিবুল হক মজুমদার। ভোর ৫টার দিকে পাকিস্তান বাহিনী আমাদের ডিফেন্সর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ক্ষ্যান্ত না থেকে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তখন আমরাও উভয় ডিফেন্স থেকে পাল্টা হামলা করি। এই যুদ্ধে আমি একটি এলএমজি নিয়ে সারাসরি যুদ্ধে অংশ নেই। এটি ছিল একটি ভয়াভহ যুদ্ধ । প্রথম যুদ্ধেই যে এমন একটি বড় যুদ্ধের মধ্যে পড়ব ভাবতেই পারিনি। যাই হোক এই যুদ্ধে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ পাকিস্তানী বাহিনী নিহত হয়। আর আমাদের শহিদ হয় ৩ জন। এর মধ্যে রয়েছে আমার ওস্তাদ নোয়াখালীর ল্যান্স নায়েক আবদুল কাদের মোল্লা, হাবিলদার জুম্মাখান এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইমতিয়াজ উদ্দিন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার সেরা সম্মুখ যুদ্ধ কোনটি জানতে চাইলে মো. গোলাম হোসেন চৌধুরী এক কথায় বলেন চৌয়ারা বাজার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণন করতে গিয়ে তিনি বলেন, কমান্ডার ইকবাল আহমেদ বাচ্চু,সফিউল আহমেদ বাবুল ও মজিবুল হক মজুমদারসহ আমরা ৪৫জন মুক্তিযোদ্ধা চৌয়ারা বাজার যুদ্ধে অংশ নেই। চৌয়ারা বাজারের দক্ষিণ দিকের গ্রামটি এখন নাম মনে করতে পারছি না। ঐ গ্রামে আমরা এক রাত ছিলাম। এই খবর পাকিস্তান বাহিনী পেয়ে সকালে পুরো গ্রামটি গ্রুপ ভিত্তিক খোঁজ করে। আমরা রাতে যে বাড়িতে ছিলাম ঐ বাড়ির ৫ জন লোককে তারা হত্যা করে পার্শ্ববর্তী পুকুরে ফেলে দেয় এবং বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। সারা গ্রাম আক্রমন করে গ্রাম সংলগ্ন জমিতে গিয়ে তারা একত্রিত হয়। তাদের ধারণা ছিল এখানে এখন আর কোন মুক্তিযোদ্ধা নেই। রাস্তা সংলগ্ন একটু দূরে একটি কুয়া ছিল আর কুয়ার সাথে ছিল একটি তুলা গাছ। আমি ,আবদুস সোবহান,মানিক মিয়া এবং কুদ্দুছ ভূইয়া ঐ কুয়ার কাছে তুলাগাছের নিচে বসে সব কিছূ দেখছিলাম। যখন দেখলাম পুরো গ্রামে অত্যাচার করে ৫জন সাধারণ মানুষকে মেরে তারা তৃপ্তসহকারে আড্ডা দিচ্ছে আর কোন দিকে তাকাচ্ছে না,ঠিক তখনি আমরা সুযোগ বুঝে তাদের কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই এক সাথে ফায়ার করা শুরু করি। আর আমাদের দক্ষিণ এবং উত্তরে তো আমাদের বাকী সহযোগীরা ছিলই। এই ফায়ারে আমার এক হাতে ৬জনসহ মোট ১২ জন পাক হানাদার বাহিনী নিহত হয়। সেদিন যদি আমাদের ফায়ার সামান্য লক্ষভ্রষ্ট্র হতো তাহলে কিন্তু আমরা তিনজনসহ পাশে থাকা অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও শহীদ হয়ে যেতাম। আল্লাহর রহমতে সে দিন আমরা বিজয়ী হই ফলে বেঁচে যাই।তবে এ কথা ঠিক এলাকার সাধারন মানুষ যদি আমাদের সহযোগিতা না করত তাহলে চৌয়ারা থেকে সেদিন আমরা ৪৫ জনের সবাই পাক বাহিনীর হাতে মারা যেতাম। এর পর একটানা ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদর্শ সদর উপজেলা, সদর দক্ষিণ উপজেলা ,বুড়িচং এবং ব্রাক্ষণপাড়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে এবং ডিফেন্সে অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহন করি। পরে ৭ ডিসেম্বর আমরা চৌদ্দগ্রাম থানার নিয়ন্ত্রন নেই।

পরিচয় : মো. গোলাম হোসেন চৌধুরী। পিতা মৃত মোশারফ হেসেন চৌধুরী,মাতা কদরের নেছা। ৬ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিশা ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে তিনি ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই জন্ম গ্রহণ করেন। বসন্তপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েই তার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কেটেছে। নানা দূ:খ দূর্দশার কারণে পরবর্তীতে আর বিদ্যালয়ের গন্ডিতে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি এই বীর যোদ্ধার। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসী ভুমিকার কারণে বন্ধুরা তার নাম দিয়েছিল এলএমজি ম্যান।১৯৯৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সেলিনা চৌধুরীর সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ২ ছেলে ও ১ মেয়ের গর্বিত জনক।