বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং টিভি সিরিয়ালের বর্তমান হালচাল- মোঃ তারিকুল আলম (উজ্জ্বল)

একটি মনো: সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৭ মাস আগে

আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে মহান জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটি দিন আমার পাঠ অধ্যয়ন শুরু হত জীবনের প্রারম্ভিক প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা পুলিশ লাইন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ও কুমিল্লা জিলা স্কুলে। সেই থেকে হাটি-হাটি, পা-পা করে অতিবাহিত হয়ে গেল অনেকটা বছর। সেদিনগুলো অবশ্য আজকের দিনগুলোর মত একরাশ বাস্তবতার আবেশে এতটুকু নিরেট ছিল না তবে এটা সত্য যে মহান জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় গভীর দেশাত্ববোধ এবং প্রেমবোধ আমাকে একটু হলেও আন্দোলিত করতো। প্রতি দিন বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া পথ চলা, বাবার মত সমব্যক্তিত্ব পরম প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মুখ থেকে ধ্বণিত হওয়া অনুপম বাণী- ‘তোমরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ সত্যি আমাকে উজ্জ্বীবিত করতো এবং সেই থেকেই আমি একটু একটু করে ভাবতে এবং স্বপ্নের জাল বুনন করতে শুরু করি যা আজো অব্যাহত আছে। আজ আমরা বড়ই মর্মাহত এবং ব্যথিত এটা ভেবে যে আমাদের শিশু-কিশোর এবং যুবসমাজ যেন আজ এক অদৃশ্য কালো আধাঁরের নিচে প্রতিনিয়তই হারিয়ে যাচ্ছে। তারা যেন তাদের সত্ত্বা, মননশীলতা, সৃজনশীলতা এবং নৈতিকতাকে শেষ করে দিচ্ছে এবং তাদের মধ্যে এক অস্থিরতার জন্ম নিচ্ছে, পাশাপাশি তাদের দেশপ্রেম ও মমত্ববোধ হ্রাস পাচ্ছে।  আমি বরাবরই আশাবাদী মানুষ তাই আমার প্রবন্ধকে কেউ নৈরাশ্যবাদী হিসেবে শামিল করবেন না।
আজ আমাকে লিখতে হচ্ছে তরুন সমাজের প্রতিনিধি হয়ে যারা আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ তথা ভিশন ২০৪১ বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ কে মোকাবিলা করতে চাইছেকিন্তু তারা মাঝ পথেই যেন তাদের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারের মধ্যে স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সমূহ অন্যতম। অপরদিকে আধুনিক কালে বাংলাদেশে বিনোদনের অন্যতম খোরাক যোগাচ্ছে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত টিভি সিরিয়াল। বর্তমান সোশ্যালমিডিয়া, স্মার্টফোন ও টিভি সিরিয়াল একই সুত্রে গাথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তরুন ছেলে-মেয়ে ও কর্মহীন মানুষ (প্রবাস ফেরত, প্রবাসির পরিবার, কর্মহীন দিনমজুর) তার নিত্যদিনের কাজকর্মকে তোয়াক্কা না করে বরং এই সকল অনুষ্ঠান দেখতে বেশি ব্যস্ত ও আগ্রহী হয়ে উঠছে। যে মোবাইল প্রযুক্তির ওপর ভর করে তরুনদের এগিয়ে যাবার কথা বরং সে প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারনে তাদের নৈতিকতাকেই তারা গ্রাস করে নিচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টের, বেদনার আর হতাশার কিছুই হতে পারে না। মোবাইল প্রযুক্তি অবশ্যই আমাদের জন্য আশীর্বাদ। মোবাইল প্রযুক্তির কল্যানেই আজ আমরা পরস্পর এত কাছে এসেছি এবং আমাদের জীবনের চলার পথ হয়ে উঠেছে আরো গতিময় ও সহজতর। কিন্তু যদি এর অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি করে দেয় মোবাইল প্রযুক্তি পরিচালনাকারী এজেন্সীসমূহ তাহলে সেটা আর আশীর্বাদ হয় না, তা তৈরি করে এক মাহবিপর্যয়। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা, টেলিভিশনের পর্দা খুলতেই ভেসে আসছে রমরমা সব বিজ্ঞাপন। যেমন রাত ১২টা পর্যন্ত সকাল ৫টা পর্যন্ত অমুক অমুক অপারেটরে এতটা এফএনএফ নাম্বারে নাম মাত্র রেটে কথা বলতে পারা, কিছু অপারেটরে সবচেয়ে সস্তায় বেশি কথা বলার সুযোগ যত বেশি, কথা তত বেশি বোনাস; সিমের সাথে টক টাইম ফ্রি, এতটাকা রিচার্জ করে এই মাসে দ্বিগুন, তিনগুন, চৌগুন টাকা ফ্রি… আরো কত কি!
অপারেটগুলোর এতসব চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে অপরিপক্ক টিন-এইজড বালক-বালিকা যারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন এবং ইতিবাচক/নেতিবাচক কর্মকান্ড চিহ্নিত করতে পুরোপুরি সমর্থ নয় তারা বলির পাঠা হচ্ছে। খুব আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে বিভিন্ন অফারে যারা কথা বলছে তারা তাদের মূল্যবান সময়টাতে ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক তথা অযথা বিষয়কে অবলম্বন করে মোবাইল ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করে কথা বলছে এবং তাদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর তথা টিন-এইজড বালক-বালিকা। যে সময় তাদের ঘুমানোর কথা, সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে লেখা-পড়ায় বসবে- এ চিন্তা করার কথা তা না করে বরং তারা শুধুমাত্র স্বাস্থ্যহানি করে, রোগাক্রান্ত হয়ে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে এবং তারা প্রতিনিয়তই পিছিয়ে পড়ছে তাদের সৃজনশীলতা থেকে। তারা যেন ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে তাদের স্বকীয়তা ও চিন্তাশীলতা। অনেক ছেলে মেয়ে স্মার্টফোনে আসক্তির কারনে গভীর রাত্রীতে ঘুমিয়ে সকালবেলা অনেক দেরিতে ঘুম থেকে উঠছে যার ফলে তার জীবনীশক্তি বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে শিকাগো নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ^বিদ্যালয়ের ফিনবার্গ স্কুল অব মেডিসিনের ডিরেক্টর ড. ফিলিস জি. সি.এন.এন. টিভিকে(২০২২) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন “যারা রাতে দেরিতে ঘুমোতে যায় এবং সকালে দেরীতে ঘুম থেকে উঠে তাদের মেটাবলিক ও কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি অনেক গুন বেশি থাকে। শারীরিক ও মানসিক ভাবে তারা অসুস্থ থাকে, স্বাভাবিক শারীর বৃত্তীয় কর্মকান্ড ব্যাহত হয়, যার প্রভাবে স্ট্রোক, স্ট্রেস, ডিপ্রেশন ও এনজাইটি নামক মনস্তাত্ত্বিক রোগে তারা আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং তাদের শরীরের ওজন বেড়ে অল্প বয়সে তারা ডায়াবেটিক ও স্থুলতার মত সমস্যায় পতিত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাতজাগা ও দেরিতে ঘুম থেকে উঠা ক্যানসারের ঝুঁকি অনেকগুন বাড়ায়।” স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে রাত জাগার কারনে তরুন সমাজ ও মিডিয়া আসক্ত ব্যক্তিরা উল্লেখযোগ্য যে সমস্যাগুলোতে পতিত হচ্ছে তা হলঃ ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া ও রোগের সংক্রমন বৃদ্ধি পাওয়া, যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, অনিদ্রা, অমনোযোগিতা ও খিট খিটে মেজাজ, দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা, স্কীন ডিজিজ, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া (ডিমেনশিয়া) মনঃস্তাত্ত্বিক ডিসওঅর্ডার যেমন: সিজোফ্রেনিয়া, হ্যালুসিনেশন ইত্যাদি। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ঘুম ও জীবনযাপন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি ও চিন্তা শক্তি হ্রাসসহ তাকে অমানবিক রোবোটিক মানুষে পরিণত করছে।
অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলস্বরুপ তারা ধীরে ধীরে তাদের সৃষ্টিশীলতাকে ক্রমেই ম্লান ও ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেসব টিন-এইজড বালক-বালিকা অল্প বয়সে, কাচাঁ হাতে অপরিপক্ক মনে স্মার্ট মোবাইল সেট ব্যবহার করছে তাদের আবার একাধিক কমপক্ষে ৫-৭টি সিম থাকে! আর অল্প পয়সাতে এতগুলো সিম দিয়ে কথা বললে তো কম করে হলেও অনেক টাকা রিচার্জ করতে হয় যা আর্থিক অপচয় বাড়াচ্ছে। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা স্মার্টফোন পেয়ে হয়তোবা তাদের বাবা-মায়ের উপর খুব খুশি থাকে কিন্তু তারা কী শুধু ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে? না, এই সুযোগে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে তারা অযাচিত অথচ আপত্তিকরভাবে মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলে তারপর সংঘবদ্ধভাবে সে ছবি নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে শুধু তাই নয় এর চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর চিত্র এই যে, হাতে উন্নত প্রযুক্তির মোবাইল ফোন পাওয়ায় অনেক ছাত্র ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে বিভিন্ন ধনের পর্ণোগ্রাফি মোবাইলের মেমোরীতে ধারণ করে পরে তারা সংঘবদ্ধভাবে তা উপভোগ করে। আর কিশোররা এক বন্ধুর এমন আচরণ ও কর্মকান্ড দ্বারা প্রভাবিত ও উৎসাহিত হয়ে আরো বেশি ও সংক্রান্ত কর্মকান্ড করতে প্রত্যয়ী হচ্ছে যাকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে Edwin Sutherland (1939) Gi Differential Association Theory এর আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়। শিশু-কিশোর ও যুবকেরা একজনের আচরণ দ্বারা অন্যজন যেমন প্রভাবিত হচ্ছে তেমনি করে মোবাইল প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ার কারণে তারা সহজে একে অন্যের আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমে (যেমন: গোপন কারো ছবি তোলা, পর্ণোগ্রাফি উপভোগ করা, সংঘবদ্ধভাবে সংঘর্ষ, ঠেঁকবাজি, কিশোরগ্যাং ইত্যাদি) জড়িত হয়ে পড়ছে যা প্রতিনিয়তই তাদের নৈতিকতাকে অবদমিত করছে। তাছাড়া Facebook, YouTube, Tiktok I Twitter তো তাদের পিছে আঠার মতো লেগেই আছে যা টিন-এইজডদের মহামূল্যবান সময়ের বেশির ভাগ সময় গ্রাস করে নিচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, আজ পর্যন্ত মোবাইল ফোন ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর ব্যক্তিবর্গ কী এই বিষয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে!বা আমাদের পরিবারগুলো কতটুকু সচেতন যে তারা তাদের সন্তানকে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে কি!। যার ফলে অযাচিত স্মার্টফোনের ব্যবহার ও স্পর্শকাতর সময়কালীন মোবাইল কলরেট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে?প্রযুক্তির আশীর্বাদ যখন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের ভাবতে হচ্ছে অনাগত ভবিষ্যতদের সামনে পথ চলার অন্তরায়ের আশঙ্কা নিয়ে।
এখন আলোকপাত করা যাক নাটক নির্মানের ব্যাপারে। বর্তমানে নাটকের আবহ, চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য আসলে কেমন? খুব কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে এর আবহ খুবই বিতর্কিত ও ভয়াবহ। এখন আমাদের দেশে অনেক প্রাইভেট চ্যানেল। মানুষের জীবনকে আরো তরান্বিত করতে এ চ্যানেলগুলোর অসামান্য অবদান মোটেও খাটো করার মত নয়। কথা বলছি চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন ধরণ ও সাইজের নাটক প্রসঙ্গে। আজ মানুষ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রচারিত নাটক দেখলে চরম বিব্রতবোধ করে এবং এক বুক ঘৃণাবোধ থেকে উচ্চারণ করে… ছি! ছি! ছি! এ কী দেখছি? শুধু তাই নয় অনেকের মত আমিও আশঙ্কাগ্রস্থ এই ভেবে… এসব তথাকথিত নাটক নির্মাতা পদ নামধারীরা আমাদের ভবিষ্যত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীদের নৈতিক অবক্ষয়ের আর কত নাম্বার স্টেজ অতিক্রম করাবে? সত্যি কথা বলতেও আমার লজ্জা হচ্ছে- এসব নাটক নির্মাতারা আজ অভিনেতা-অভিনেন্ত্রীদের (বিশেষত কিশোর-কিশোরী) ছোট-খাট পোশাক পড়িয়ে নাটক তৈরির নির্লজ্জ হীন খেলায় যেন মেতে উঠেছে। যখন দেখি ১৫-২৪ বছর বয়সী কিশোরী/যুবতীরা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, থ্রি পিচ, ফ্রগ ইত্যাদি পড়ে নাটকে অভিনয় করছে তখন লজ্জায় আমাদের মাথা নত হয়ে যায়। এতে অসংখ্য সংস্কৃতিমনা দর্শক কী সন্তানের সামনে এসব নাটক দেখতে বিব্রতবোধ করছে না? আর এসব অভিনয় দেখে, অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করে, পোশাক-আশাক নকল করে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম তাদের লাইফ স্টাইল আর এসব অীভনয় দেখে, অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করে, পোশাক-আশাক নকল করে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম তাদের লাইফ স্টাইল নির্ধারণ করছে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক এবং কলামিস্ট অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বর্তমান সময়ে নাটকে ব্যবহৃত ভাষা এবং এফএম রেডিওতে প্রচারিত অনুষ্ঠানের উপস্থাপকদের উচ্চারিত ভাষাকে ‘খিচুড়ি ভাষা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন কোন এক সাক্ষাৎকারে। এসব নির্লজ্জ নাটক নির্মাতা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষার প্রেক্ষাপট ভুলে গেলেও প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কে বিকৃত করে উপস্থাপন করার কোন অধিকার এদেশের ১৮ কোটি মানুষ তাদেরকে দেয় নি। অথচ আজ তারাই প্রিয় ‘বাংলা’ ভাষাকে বিকৃত করে নাটকের মাধ্যম তৈরি করছে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে আমাদের কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীদের সার্বিক জীবনাচরণে। কারণ এসকল নোংরা ও তথাকথিত ‘খিচুড়ি ভাষা’ নকল করতে গিয়ে আমাদের কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতীরা হয়ে উঠছে ভয়ানক ‘আলট্রা মডার্ন’। তারা না জানে সঠিক বাংলা, না শিখছে সঠিক ইংরেজি ভাষা। এই মর্মে সম্প্রতি বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাট্যকার ও ২০১২ সালে একুশে পদক প্রাপ্ত প্রখ্যাত নির্দেশক মামুনুর রশিদ বলেছেন বাংলাদেশে এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে যা দেশের সুষ্ঠু সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায়।এটা আমাদের সমাজ প্রেক্ষাপটে এক অশনি সংকেত ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের সম্ভাবনাময় কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীরা যেমন নৈতিকতা বিবর্জিত পয়ে পড়ছে, তেমনি তারা প্রতিনিয়তই অর্থের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছে (Tiktok, Youtubing ইত্যাদি) করছে। যাকে জার্মানীর Frankfurt School এর সমাজবিজ্ঞানী Lukus এর তত্ত্ব মতে Refication ev Thingification ( বস্তুতে রূপান্তর) হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এতে করে সামান্য অর্থের বিনিময়ে তারা শুধুমাত্র বস্তুতেই রূপান্তরিত হচ্ছে না, নৈতিকতা বিবর্জিত হচ্ছে না, সে সাথে তারা হারিয়ে ফেলছে নিজস্ব স্বকীয়তা এবং সৃজনশীলতা যা আমাদের ভবিষ্যত উন্নতির পথে এক মহাবিপর্যয় ও অন্তরায়। এভাবে চলতে থাকলে সরকারের ভিশন ২০৪১, ডেলটা প্রকল্প ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা মারাত্মভাবে হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সমাজ বিশ্লেষকরা মতামত দিয়েছেন।
মনে হতে পারে এ যেন কাল্পনিক কিন্তু না এটাই সত্য। আমরা এক এক করে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছি। আজ যারা জেগে উঠছে নিজেদের পরিচিতিকে সুমহান করতে আমরা তাদেরকে তলিয়ে দিচ্ছি সামান্য প্রাপ্তির মরীচিকার ভ্রান্ত জালে। কিন্তু আমরা একটি বারও ভাবছি না এ কোন অশুভ ছায়ার পিছনে আমরা তাল দিচ্ছি। আমাদের ঘুমন্ত মনটাকে একটু হলেও জাগ্রত করতে হবে। যখন আমার দেশের, আমার ¯েœহের শিশু-কিশোর, যুবক যবতীরা বেড়ে উঠছে এক রাশ অস্থিরতার ছায়াতলে তখন এদেশের একজন সচেত নাগরিক হিসেবে আমাদের আর চুপ থাকা যৌক্তিক হবে না। যারা ভাষা শহীদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত প্রিয় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ কে বিকৃত করে এক উৎকট ও দুর্গন্ধময় ‘খিচুড়ি’ ভাষায় রূপান্তর করে নাটকের সংলাপ চরিতার্থ করে, যারা আমাদের দেশের সংস্কৃতিকে বিকৃত করে অশালীন ও অমার্জিত পোষাককে নাটকের শিল্প নির্দেশনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে এবং প্রকারান্তরে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের নৈতিকতা, রুচিবোধ এবং লাইফ স্টাইল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে একটুর লজ্জাবোধ করছে না, যারা প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতার মোড়কে আমার দেশের শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীদের প্রতিভাকে পুঁজি করে নিজেদের সিঁড়ি প্রশস্ত করছে এবং শিশু-কিশোরদের ফেলে দিচ্ছে এক অজানা অনিশ্চয়তা ও মরীচিকার মায়াজালে, তাদের বিবেক যেন একটু হলেও জাগ্রত ও তাড়িত হয়। তাদের বোধশক্তি যেন ফিরে আসে। তা না হলে ত্রিশ লক্ষ শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা ও মানবিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিশন ২০৪১ ও এসডিজির অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়বে। তাই আমাদের সন্তানের দিকে তাকিয়ে তাদের নৈতিকতা সংরক্ষণে প্রত্যয়ী হয়ে এসকল অসঙ্গতির বিপক্ষে সোচ্ছার হয়ে সন্তানদের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, সন্তানকে নৈতিকতার পথ দেখাতে হবে, আলো বিকশিত হবেই।আমেরিকার আধুনিক কবি Robert Forst এর ভাষায়-

The woods are lovely, dark and deep

But I have promises to keep,

Miles to go before I sleep,

and miles to go before I sleep……..

আজ আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে অনেক সেমিনার টকশো ইত্যাদি অনুষ্ঠান হয়, বিশ্লেষণ হয় এবং এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। কিন্তু শিশু কিশোরদের নিয়ে কিছু হচ্ছে না। সমাজতাত্ত্বিক ও অনুষ্ঠান নির্মাতাদের কাছে সবিনয় অনুরোধ হচ্ছে তারা যেন, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতীদের চলার পথে বিভিন্ন অসঙ্গতিসমূহ চিহ্নিত করে মহামূল্যবান ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এসকল ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখবে ও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পরিমার্জিত জীবন ও নৈতিকতা সংরক্ষণে উপযুক্ত ও যথার্থ উপাদানের সন্ধান পাবেন। তবেই আমরা ফিরে পাব বিকশিত ও আলোকিত এক সুপ্রভাত।
আমরা সবসময় আশাবাদী জাতি। এই মর্মে বিশিষ্ট ইংরেজ কবি ও অনুবাদক KAlexander Pope (1688-1744)তার Essay on Man কবিতায় বলেছেন-

“Hope Springseternal in human breast,

Man neveris, but always to be blest”

“অর্থাৎ মানুষের চিত্তে আশার জাগরন চিরন্তন, একমাত্র মানুষের জন্যই সবকিছু সম্ভব।”
আমরাও আশা করি অমানিশার অন্ধকার ও অপছায়াকে ভেদ করে সুন্দর ভোরের আশার আলোকবর্তিকা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো উন্নতির দ্বার প্রান্তে এবং তৈরী করবো লক্ষ শহীদের স্বপ্নের মানবিক, ঐক্যেরও সাম্যতার সোনার বাংলাদেশ।
মোঃ তারিকুল আলম (উজ্জ্বল)
শিক্ষক, গবেষক ও লেখক
(লেখক: বর্তমানে কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের
ইংরেজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানহিসেবে কর্মরত রয়েছেন।)