টেন্ডার, চাকরিসহ বিভিন্নখাতে প্রভাব বিস্তার না করতে পেরে নেতাকর্মীদের মাঠে নামিয়ে ভিসিকে চাপে ফেলার অভিযোগ উঠেছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় নিয়োগ ও টেন্ডারের অনৈতিক দাবি নিয়ে ভিসি দপ্তরে চাপপ্রয়োগ ও গাড়ি আটকানোর নজির আছে ইলিয়াসের। সংশ্লিষ্ট মহল বলছে, নতুন ভিসির কাছ থেকে অতীতের ন্যায় টেন্ডার ও নিয়োগে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের সুযোগ না পেয়ে এবার নেতাকর্মীদের নিয়ে ভিসিকে চাপে ফেলতে মাঠে নেমেছেন ইলিয়াস। গত বুধবার মানববন্ধনের ডাক দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দেন। পরবর্তীতে মানববন্ধন শেষে ভিসির কার্যালয়ে অনুমতি ছাড়াই সদলে স্মারকলিপি নিয়ে প্রবেশ করে বাকবিতণ্ডায় জড়ান ইলিয়াস। সেখানেও টেন্ডার নিয়োগ প্রসঙ্গ উঠে আসে বলে জানান ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী। তারা জানান, ইলিয়াস ও তার নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে একপর্যায়ে ভিসি বলেন, তোমরা তো এখানে এর আগে শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে আসনি, নিয়োগ-টেন্ডারের দাবি নিয়ে এসেছো। শিক্ষার্থীদের যেকোনো যৌক্তিক দাবি হলে তোমরা বললেও আমার প্রশাসন মানবে, এমনকি না বললেও তা করবো। উত্তরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পাল্টা প্রশ্ন করে বলে, ওই দাবিগুলো (টেন্ডার/নিয়োগ) কি ন্যায্য দাবি ছিল না?
এদিকে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, ইলিয়াস আগের রাতেই সভা করে তার অনুসারীদের মানববন্ধনের ব্যাপারে নির্দেশনা দেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবস্থানরত সবাইকে অবশ্যই সেখানে থাকতে বলা হয়। এর আগে গত ১৯শে জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগ এবং ২০শে জুলাই নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগকেও বিভিন্ন দাবি নিয়ে মানববন্ধনে নামান তিনি।
এসব মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট চলমান কিছু সংকট তুলে ধরে সেগুলো সমাধানের দাবি জানানো হয়। তবে এসব দাবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, এসব দাবির অনেকগুলোই প্রক্রিয়াধীন। আবার কিছু কিছু দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি দেখানো হলেও মূলত লাগাতার মানববন্ধনের মাধ্যমে টেন্ডার-নিয়োগের দাবিগুলোর জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট অনেকেই। এ বিষয়ে প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, তারা যেসব দাবি নিয়ে এসেছিল এর বেশির ভাগ দাবি আবাসিক হল কেন্দ্রিক। এখন আমার প্রশ্ন হলো হলের সমস্যা থাকলে সমাধান করবে হল প্রাধ্যক্ষ। সেটা সরাসরি ভিসিকে বলা স্বাভাবিক নয় বলে মনে করি। এভাবে হুট করে টানা তিনদিন মানববন্ধন করার পেছনে কারও ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতেও পারে। এখন কি উদ্দেশ্য ছিল সেটা বলতে পারছি না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, ভিসি স্যারকে চাপে রাখার জন্য এবার পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের দাবি নামক ব্যানারে ছাত্রলীগ মানববন্ধনে নেমেছে। এর আগে বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন টেন্ডার ও নিয়োগের অযৌক্তিক দাবি নিয়ে ভিসি স্যারের কাছে গেলে ভিসি স্যার রাজি না হওয়ায় তারা চাচ্ছে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে। যাতে চাপে পড়ে ভিসি তাদের ওপর নমনীয় হয় আর ইলিয়াসের নিয়োগ ও টেন্ডারের সকল অযৌক্তিক দাবি মেনে নেয়। এদিকে দাবিগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে ভিসি অধ্যাপক ড. এ.এফ.এম আব্দুল মঈন বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই সচেতন এবং ইতিমধ্যে আমরা এগুলোর কাজ শুরু করেছি। তবে আমি টাকার নয়ছয় করি না। বাজেটে যে খাতে যতটুকু বরাদ্দ থাকে ততটুকুই ব্যয় করি। তাই সব দাবি পূরণে একটু সময়ও লাগবে। আমি বরং বিস্মিত এতদিন কেন এগুলো নিয়ে কথা বা কাজ করা হয়নি। মানববন্ধন করার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা তিনদিনে তিনটা মানববন্ধন করলো। হুট করে ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে এভাবে লাগাতার মানববন্ধনের পেছনে কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না। ইলিয়াস গত কয়েক মাসে বহুবার আমার অফিসে এসেছে, একদিনে একাধিকবারও এসেছে। বেশির ভাগ সময় সে অবৈধ নিয়োগ, টেন্ডার এবং তার স্ত্রীর চাকরির কথা বলতে আসে। তবে এটুকু বলবো আমি আমার প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের জন্যই কাজ করছি। সকল যৌক্তিক দাবি মেনে নিবো, তবে কারও কোনো অযৌক্তিক দাবি মেনে নিবো না। নিয়োগ টেন্ডারের অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন, গত তিন মাস আমরা ভিসির কাছে কোনো টেন্ডার বা নিয়োগ নিয়ে কথা বলতে যাইনি। আমরা শুধু শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে কথা বলছি। এখন কেউ যদি বলে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছি এটা সত্য নয়। গণমাধ্যমকে ইলিয়াস আরও বলেন, রমজানে ঈদের আগে একটা কাজে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাস্তা খরচের জন্য ভিসি কিছু টাকা দিয়েছিল। এ ছাড়া শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল ইসলাম মাজেদকে একটা টেন্ডার দিয়েছিল। এর বাইরে গত কয়েক মাসে ভিসির কক্ষে আমি শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে ২/৩ বার গিয়েছি। তবে নাস্তা খরচের টাকা দেয়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলছেন কুবি ভিসি অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন। তিনি বলেন, আমি তাদের কখনো এমন নাস্তা খরচের জন্য টাকা দিইনি, ভবিষ্যতেও অযৌক্তিকভাবে টাকা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি আমার তহবিল থেকে এমন একজন অসুস্থ ছাত্রকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম যার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়া অসুস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কিছু অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছিলো। আমাদের টেন্ডার সাধারণত সবই ইজিপিতে দেয়া হয়। একটা টেন্ডার ইজিপির বাইরে ওটিপিতে গিয়েছিল, যেখানে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ সংক্রান্ত কমিটির প্রস্তাব অনুসারেই অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। প্রসঙ্গত, গত ৩১শে মার্চ চাকরি-ঠিকাদারির নানা দাবিতে ইলিয়াসের নেতৃত্বে ভিসির গাড়ি আটকায় কুবি শাখা ছাত্রলীগ। ভিসি তাদের অনৈতিক দাবির সঙ্গে একমত না হওয়ায় সভাপতি ইলিয়াস ভিসির সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন- এমন সংবাদ প্রকাশ হয় দেশের বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে।