মাইন বিস্ফোরণ থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাই- হারুন

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -৫
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ইতিহাসের বর্বরোচিত গণহত্যা শুরু হবার পর থেকে আমরা যারা ছাত্র ইউনিয়ন করতাম তারা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি সুযোগ পেলে যুদ্ধে যাবার। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমাদের চৌদ্দগ্রামের মিয়া বাজার এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক,বর্তমানে ড্রাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তাফা গোলাম কুদ্দুছ একদিন আমাকে মিয়াবাজার দেখে যুদ্ধে যাবার প্রস্তাব দেন। আমি সাথে সাথে বলেছিলাম, বাড়িতে বললে বাবা-মা রাজি হবেন না। আপনি পরে আমার বাড়িতে বলে দিয়েন। এখন আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কুদ্দছ ভাই সাথে সাথে একটি চিরকুট লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নির্ভয়পুর ক্যাম্পে।

প্রশিক্ষণ যখন শুরু : এই ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব (যিনি পরে মঞ্জু হত্যার সময় নিহত হয়েছিলেন)। নির্ভয়পুর ক্যাম্পে দুই মাস প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমাদের প্রায় ৩০০জন প্রশিক্ষণার্থীদের উচ্চতর গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীন মেলাঘরের ইকোওয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। প্রায় দুই মাস এখানে আমাদের কঠিন প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতীয় মেজর রাও এর নেতৃত্বে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন সিলেটের তামাবিল ক্যাম্পে। তামাবিল ক্যাম্পটি আগেই ছিল। আমরা এখানে যোগ দেওয়ার পরে ক্যাম্প কমান্ডার হলেন মেজর রাও। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ক্যাম্পের অধীনেই আমরা যুদ্ধ করেছি।

যুদ্ধের অনুপম গল্প : যুদ্ধকালীন সময়ের একটি স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন বলেন-১৯৭১-এর সম্ভবত ২০ অক্টোবর হবে। রাতে আমরা জাফলংয়ের উদ্দেশ্যে প্রায় ১২০জন মুক্তিযোদ্ধা রওয়ানা দেই। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত গাইড আমাদের ভুল রাস্তা দিয়ে নিয়ে যায়। ফলে জাফলংয়ের মূল সড়কে উঠার আগেই একটি বড় স্থল মাইন বিস্ফোরণ হয়। এতে আমাদের সামনে থাকা ১১জন বীর ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়। তাদের সবার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চর্তুদিকে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গ আমরা কয়েকটি বস্তায় ভরে নেই। কার দেহ কোনটি তা বলতে পারব না। বলতে পারেন বড়ুই বা আম কুড়ানোর মত তাদের হাড়গুলো আমরা খুঁজে নিয়ে যখন তামাবিল ক্যাম্পে আসি তখন ফজরের আজান হচ্ছিল। স্পষ্ট মনে আছে, যখন ক্যাম্পে এসে ১১ সহকর্মীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহগুলি বস্তা থেকে বের করি তখন ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাও লুঙ্গি, গেঞ্জি ও সেন্ডেল পড়া ছিলেন। বস্তাগুলির দিকে এক নজর তাকিয়ে মাথাটা তুলে হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘ইস্কা বদলা লেয়াগানেই’-তোমরা কি এর বদলা নিতে পারব না। সেদিন হয়তো আমরাও শহীদ হতে পারতাম। কিন্তু হয়তো ভাগ্যের গুণেই বেঁচে গেছি।
যুদ্ধের আরেকটি স্মৃতি বলতে গিয়ে মীর হারুন অর রশীদ বলেন- একদিন গোয়াইঘাটের কোন এক প্রান্তে (এলাকাটির নাম মনে আসছে না) এক গ্রামে আমরাসহ মিত্রবাহিনী অবস্থান নিয়েছি অপর গ্রামে পাকিস্তানী বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। যুদ্ধ লেগে যায়যায় অবস্থা। সারা দিন চলে এই অবস্থায়। আমরা সবাই ক্ষুধার্থ এবং ক্লান্ত। এমন সময় বন্দুকটা এক হাতে রেখে একটি গাছের সাথে সবেমাত্র হেলান দিয়ে বসছি এমন সময় একটি বুলেট আমার মাথার ঠিক সামান্য উপর দিয়ে চলে গেল। লক্ষ্য করলাম গাছটি ভেদ করে বুলেটটি বের হয়েছে। সামান্য একটু ব্যবধানে সেদিনও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি জানান- একদিন তামাবিল ক্যাম্পে খবর এলো, জেনারেল এম এ জি ওসমানী আসছেন। আমরা খুব ভোরে ক্যাম্পের সামনে তাঁকে স্বাগত জানানোর জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ালাম। হঠাৎ দেখলাম একটি গাড়ি এলো। প্রথমে আমাদের সামনে দিয়ে দ্রুত চলে গেল। সামনে গিয়ে আবার পেছনে ব্যাক করে এসে গাড়িতে বসে গ্লাস নামিয়ে তিনি বললেন- “প্রিয় সৈনিকেরা, আমরা যদি আমাদের কর্তব্য কাজে অবহেলা করি তাহলে আমাদের মাতৃভূমি হবে পশ্চিমাদের পস্ট্রিটুয়েট-আপনারা কি তা চান খোদা হাফেজ, দেখা হবে ঢাকায়।”

পরিচয় : মো. মীর হারুন অর রশীদ। পিতা- মহিউদ্দিন, মাতা- সুফিয়া খাতুন। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ২নং উজিরপুর ইউনিয়নের মিয়াবাজার এলাকার চান্দশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার তিন ছেলের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে তিনি প্রবেশ করেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরবর্তীতে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে ১৯৬৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয়ক কমিটির অন্যতম কমসূচী ছিল দেয়াল লিখন। সেই দেয়াল লিখনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন সময়ে ঢাকা চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের মিয়াবাজার অংশে কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর- ইত্যাদি স্লোগান লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। সেই থেকেই তিনি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি সুপ্ত বীজ রোপন করতেন মনে মনে। তিনি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার আড্ডা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন। বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি কুমিল্লা জেলার সভাপতিও এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।