মাননীয় কুবি ভিসি, প্লিজ দ্রুত মনোয়ারের ছাত্রত্ব ফিরিয়ে দিন-শাহাজাদা এমরান

মানুষ গড়ার কারিগর হয়ে বিবেককে বাদ দিয়ে আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হবেন না 
শাহাজাদা এমরান
প্রকাশ: ৯ মাস আগে

গত ৩১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের নবীন বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেছেন, অনেকেই বলে দেশে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন হচ্ছে না। কিন্তু আমি বলব উল্টো কথা। দেশে দুর্নীতি হচ্ছে বলেই উন্নতি হচ্ছে। এটা নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন কথা বলতে পারে। যে ঘুষ খায়, সে পদ্মাপাড়ে যায় ইলিশ খেতে। এতে পদ্মাপাড়ের গরিব মানুষেরা ধনী হচ্ছে। দুর্নীতি এভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখে। তাই অর্থনীতিবিদেরা দুর্নীতি নিয়ে কখনো কোনো বিরূপ মন্তব্য করেন না। তবে যাঁরা পলিটিক্যাল ইকোনমি নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা দুর্নীতি নিয়ে কথা বলে থাকেন। নৈতিকতার জায়গায়ও এটি প্রশ্নবিদ্ধ। তবে অর্থনীতির জায়গা থেকে যদি বলো, দুর্নীতি কখনোই উন্নয়নের জন্য বাধা নয়।
 মাননীয় উপাচার্য মহোদয়ের এই বক্তব্যটির অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেশের গন্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্ব আজ সম্যক অবগত । যা ইতিমধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। কুবির  ইংরেজি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর প্রথম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার। যিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।  একই সাথে তিনি কুবি সাংবাদিক সমিতির অর্থ সম্পাদকও। কুবি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার ভিসি সাহেবের বক্তব্যটি নিউজ আকারে ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকায় পাঠালে সাথে সাথে তা ঐ পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হয়। পরে মুহুর্তেই মধ্যে দেশের অন্যান্য স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হতে থাকে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুহুর্তেই হয়ে যায় ভাইরাল।
কুবি সূত্র জানায়, সংবাদটি যায়যায় দিন অনলাইন ভার্সনে প্রকাশিত হওয়ার পর সাথে সাথে সাংবাদিক মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ারকে ভিসি কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। সংবাদ পরিবেশন করার বিষয়ে কৈফিয়ত তলব করা হয়। সাংবাদিক মনোয়ার ভিসি সাহেবের পুরো বক্তব্যটি তার রেকর্ডে আছে জানালে ভিসি সাহেব নাকি উত্তেজিত হয়ে গিয়ে বলেন, আমি তো এটা মিন করে বলিনি। ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় কুবির শিক্ষার্থী কাম সাংবাদিক মনোয়ার ভিসি সাহেবের কাছে ক্ষমা চান এবং নিউজ লিংকটি সরিয়ে ফেলার প্রতিশ্রুতি দেন এবং অফিসের মাধ্যমে তা সরিয়েও ফেলেন। তারপরও কুবি ভিসি সাহেব তাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুন্ন ও ভিসির বক্তব্য বিকৃতি করে ছাপার অভিযোগে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। পর দিন সাংবাদিক মনোয়ারকে ডেকে নিয়ে ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার মো. আমিরুল হক চৌধুরী শিক্ষার্থী মনোয়ারকে বিশ্বদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কারের একটি চিঠি ধরিয়ে দেন।  সাময়িক বহিস্কারের চিঠিটি লিখেছেন ৬ লাইনে। কিন্তু এই ৬ লাইনের চিঠিতে দাড়ি পড়েছে মাত্র একটি। এতেই বুঝা যায় কত বড় তাড়াহুড়া ছিল তাদের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে।
আমি অতবড় শিক্ষিত না হলেও এতটুকু মোটামোটি জানি যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিস্কার করতে হলে এর আগে অনেক গুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এই ধাপ গুলো হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করছে এই অভিযোগ এনে প্রথমেই ঐ শিক্ষার্থীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে শোকজ করতে হবে। শোকজের জবাব সন্তুষ্ট না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা রিপোর্ট দিবে, এই রিপোর্টের উপর একাডেমিক কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করা হবে। এই সবগুলো ধাপ যদি ঐ ছাত্রের বিরুদ্ধে যায় ঠিক তখনি সিন্ডিকেটের সভার মাধ্যমে সাময়িক বহিষ্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্ত এর আগে নয় । অথচ, মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে খ্যাত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এ সমস্ত কোন প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বিবেককে বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র আবেগের বশবর্তী হয়ে একটি ছাত্রের ছাত্রত্ব কেড়ে নিলেন। তিনি একটি বারের জন্যও চিন্তা করলেন না, তাঁর এই সাময়িক আবেগ একটি পরিবারের সারা জীবনের কান্না হয়ে থাকবে।
আমি যতটুকু জানি, কুবি ভিসি একজন সজ্জন ব্যক্তিত্ব,উচ্চ শিক্ষিত এবং ব্যক্তি জীবনে সৎও। তার চরম শত্রুুরাও এখনো আড়ালে আবডালে বলে বেড়ান যে, কুবিতে এখন পর্যন্ত যে কয়েকজন ভিসি এসেছেন তার মধ্যে  এ এফ এম আবদুল মঈন অনেকটাই দূর্নীতিমুক্ত। কিন্তু এ কথাও আবার ক্যাম্পাসের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে যে, তিনি খুব কম সময়ের মধ্যেই শিক্ষকদের মধ্যে দুটি দ্বারা সৃষ্টি করে ক্যাম্পাসকে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছেন। সিনিয়রদের পাশ কাটিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণদের তিনি প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছেন । মোটেই সহ্য করছেন না সমালোচনাকে,সেটা যদি গঠনমূলকও হয়। তার কথার বাহিরে কেউ যাওয়ার চেষ্টা করলে তিনি অন্যভাবে হ্যান্ডেলিং করার চেষ্টা করে থাকেন। যা কোন ভাবেই বিধি সম্মত নয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পক্ষ তাকে এমন ভাবে আস্টেপৃষ্টে ঘিরে রেখেছেন যে, তিনি এই বাহু থেকে কোন ভাবেই মুক্ত হতে পারছেন না। ক্যাম্পাসের বাতাসে ভেসে বেড়ানো ভিসি মহোদয়ের এই নেতিবাচক বার্তা গুলোও আমাদের ধর্তব্যের বিষয় না। এটা কুবি ক্যাম্পাসের একান্ত অভ্যন্তরীন বিষয়। আমরা শুধু এতটুকু নির্যাস নিতে চাই যে, আমাদের ভিসি মহোদয় একজন দূর্নীতি মুক্ত মানুষ। যিনি বিদেশের উন্নত জীবন ছেড়ে লাল মাটির ক্যাম্পাসকে ভালোবেসে চলে এসেছেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। কিন্তু সেই মানুষ গড়ার কারিগর যখন সামান্য আবেগের বশবর্তী হয়ে একটি ছাত্রের জীবন ধ্বংস করতে চায়, গণমাধ্যমের কন্ঠকে গলা টিপে স্তদ্ধ করে দিতে চায়, তখন কোন ভাবেই সেই দূর্নীতি মুক্ত মানুষটি আর ভালো মানুষের সংগায় ফেলানো যায়  না। নিজের জেদের বসে যিনি একটি সাধারণ পরিবারের সারা জীবনের কান্না হয়ে বেঁচে থাকতে চান,  কোন ভাবেই তা মেনে নেওয়া যায় না।
কী অপরাধ করেছে কুবি শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ার। তার অপরাধ একটাই , তিনি ভিসি মহোদয় যা বলেছেন, সংবাদ,সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ইথিকস্ মেনে তা প্রকাশ করে জাতীর বিবেক হিসেবে গণমাধ্যমের কন্ঠস্বরকে সারা দেশের কাছে সমুজ্জ্বল করেছেন। সাংবাদিক মনোয়ার কী কোন ভুল করেছেন। না, ভিসি স্যার, তিনি নূন্যতম ভুল করেননি। যদি করতেন তাহলে আজকের সময়ের কড়চাসহ সারা দেশের কলম সৈনিকদের লেখায়  তিনি এভাবে উঠে আসতেন না।ভিসি মহোদয়, আপনি যে বক্তব্যটি নবীণ বরন অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেছেন তা কিন্তু আপনি আপনার কার্যালয়ে কিংব বাঙলোতে বলেন নি। এমনকি প্রকাশ্যে একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে বলার সময়েও আপনি বলেননি যে, এটি আপনি অব দ্যা রেকর্ডে বলেছেন। তাহলে যেই বক্তব্যটি আপনি প্রকাশ্যে দিলেন, শত শত শিক্ষার্থীও শিক্ষকগণ শুনলেন, যা রেকর্ড হলো, একজন সাংবাদিক তা প্রকাশ করে কী অপরাধ করেছে ? গণমাধ্যমের কাজটা কি স্যার। ? আপনি দেশের একটি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসে কেন গণমাধ্যমের কন্ঠ স্তদ্ধ করে দিতে চাচ্ছেন ?
ভিসি মহোদয়, আপনাকে কি সরকার সংবাদপত্রের কন্ঠ রোধ করার জন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করেছেন। এমনিতেই আপনার বিরুদ্ধে কুবি সাংবাদিকদের মধ্যে দুটি গ্রুপ সৃষ্টি করার অভিযোগ রয়েছে সাংবাদিকদেরই একটি অংশের। আপনি তো ক্যাম্পাসের অভিভাবক। আপনি তো পিতা। সন্তান ভুল করতেই পারে। কিন্তু সন্তানকে ভুল শোধরানোর সুযোগ না দিয়ে তাকে একেবারেই গলা টিপে হত্যা করে ফেলা কি কোন সুস্থ মস্তিস্কের পিতার কাজ হতে পারে?
জনাব কুবি ভিসি মহোদয়, সাংবাদিক  মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ারকে কোন রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আপনি ঠুনকো অজুহাত দেখিয়ে তাকে  সাময়িক বহিস্কার করে আইনগত কতটুকু ন্যায্য হয়েছে তা বলতে পারবে বিশেষজ্ঞগণ। কিন্তু আপনার এই সিদ্ধান্ত কোন ভাবেই নৈতিক ভাবে ন্যায্য হয়নি এটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
এই কলামের মাধ্যমে  বিনীত অনুরোধ করে বলতে চাই, জনাব ভিসি মহোদয়, প্লিজ , আপনার আবেগী হটকারিমূলক সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করে মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ারকে তার শিক্ষা জীবনে ফিরিয়ে নিন। একজন বাবা হিসেবে নিশ্চয়ই আপনার অজনা নয় যে,একজন সন্তানকে ক্লাস নার্সারী থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত নিয়ে আসা বাবা-মা’র কত স্বপ্ন, কত কষ্ট,কত বেদনার না বলা গল্প লুকিয়ে থাকে। শিক্ষা জীবনের এই পর্যায়ে এসে শুধু মাত্র সত্য সংবাদ প্রকাশের জন্য এভাবে একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন আপনি নষ্ট করে দিতে পারেন না। আইন,নৈতিকতা,মানবিক বিবেক কোনটাই আপনাকে সমর্থন করবে না। আপনি মোহাম্মদ ইকবাল মনোয়ারের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নিভতে থাকা তার শিক্ষা জীবনের আলোটুকু জ্বালিয়ে দিন । অপর দিকে, স্বাধীন গণমাধ্যমের এগিয়ে যাওয়ার যাত্রায় আপনিও যে একজন নির্ভিক শিক্ষাবিদ সেটার পরিচয় দিন।
মহান আল্লাহ আপনার বিবেক জাতির কল্যাণে নিবেদিত করুক-এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : শাহাজাদা এমরান,সাংবাদিক,সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক। ০১৭১১-৩৮৮৩০৮।