মোহন আর তারু

নুরজাহান আক্তার
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ২ years ago

রীনা মীনা আর বীণা বসে দাদীর কাছে গল্প শুনছে। ভয়ে ওরা ভীত। কিন্তু তাতে কি তারপরও যে সমাপ্তিটা জেনে উঠতে হবে তাদের। এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। রীনা বলল, তুমি এভাবে প্রতিদিন একটি করে গল্প বলে যাবে। তবে তা অবশ্যই হতে হবে ভূতের গল্প। দাদী বলল, তোমরা তো ভয় পাবে দাদু ভাই। কিন্তু ওরা অভয় দিয়ে বলল-আমাদের কিছু হবে না। তুমি বলে যাও দাদী মা। দাদীমা বললেন শোন তাহলে বলছি-দুইজন লোক ভীষণ বিপদে পড়েছিল। তারা বহুদূর শহরে গিয়েছিল একজন রুগী নিয়ে। তবে তারা একা যায় নি। তাদের সাথে ছিল আরো দুজন। কারণ রুগীকে নিয়েছে তারা খাটিয়ায় করে। তখন রাস্তা ছিল কাঁচা, গাড়ি-ঘোড়া তেমন ছিল না, বড় জোড় রিকসা-সাইকেল আছে। খেটে খাওয়া মানুষের স্ংখ্যা। জীবন যাত্রা তাদের বড়ই কঠিন। চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা বলতে গেলে বলা যায়- গ্রামের হাতুড়ি ডা: আর গ্রামের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল। যাতে ভালো কোন ডাক্তার, ঔষধ বা যন্ত্রপাতি উন্নত চিকিৎসার জন্য কিছুই ছিলনা। প্রসূতি মায়ের জন্য ছিল এক মাত্র দাত্রী মা। না ছিল তার বিজ্ঞান/ চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে কোন পড়াশোনা। আন্দাজে অনুমানে জ্ঞান এর উপর নির্ভর করেই করে যেতেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন মৃত্যুর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি। তেমনি ছিল মোহনকে কেন্দ্র করে আমার লিখাটি। মোহন আর তারু হাসপাতালে(শহরে) রোগী ভর্তি করিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আজকের মতো তখনকার সময় এতো আলো, এত মানুষ, এত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। রাস্তায় কোন ল্যাম্প পোষ্ট বা যানবাহন ও ছিল না। মোহন আর তারু হেঁটে হেটেই বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ কিছু দূর আসার পরই কী যেন একটা দেখতে পায়। রাস্তার পাশে ছিল গাছ-গাছালিতে ভরা আর জঙ্গল। ওরা প্রথমে ভয় পায় নি। পরক্ষনেই আবার দেখতে পায় রাস্তার পাশে বেড়ে উঠা বড় তুলা গাছটার নীচে সাদা কাপড় পরা চুল গুলি বড় বড় যেন মাটি ছুঁয়ে আছে আর চোখগুলি বাঘের চোখের মতো জ্বল জ্বল করছে। একজন রমনীর মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ওরা একটু থতমত খেলো। দোয়া পড়তে লাগল এবং বুকে ফু দিতে শুরু করলো। দেখল সেই রমনী নেই। ওরা আবারো হাটতে লাগলো কিছুক্ষণ পর আবার ওরা দেখতে পেল রাস্তার দুই পাশ থেকে দুইটি পা মেলে ধরেছে কে যেন। ওরা কাউকে দেখতে পেল না। শুধু দুইটি বড় বড় পা ওদের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। দুজনে থেমে গেল। ভয় পেতে শুরু করলো আবারো। এবারও ওরা দোয়া পড়তে শুরু করলো। হঠাৎ দেখলো রাস্তার উপর পড়ে থাকা প্রকান্ড রকমের পা দুইখানি নেই। একজন বয়স্ক হুজুরের লম্বা লম্বা দাড়ি সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পড়া লোক এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলো ওদের নাম। ওরা তাদের নাম বলল। তারপর লোকটি তাদের দুজনের হাতে ছোট দুইটি কাইচ এর মতো দুইটি গোটা (বিচি) দিয়ে বলল, নে তোরা এগুলি খা, তাহলে তোদের আর কোন বিপদ হবে না। এই বলে লোকটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মোহন তারু সাহস করে চিবোতে লাগল গোটা দুটিকে আর ভাবতে লাগল সত্যি সত্যি বিপদ কেটে গেল এটা ভেবে। কিন্তু কিছুদূর যাবার পর আবারো সেই লোকটির সাথে দেখা। তাদেরকে আবারো নাম জিজ্ঞেস করলো লোকটি। তারা আবারো তাদের নাম বললো আবারো লোকটি তাদের হাতে সেই আগের মতো দুইটি গোটা তুলো দিয়ে বলল-নে খেতে থাক। তোদের কোন বিপদ হবে না।এই বলে লোকটি হাওয়ায় আবারো মিলিয়ে গেল। তারা আবারো দুজনে হাটতে লাগলো। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত প্লাবিত ধানের খেত। মাঝে খুটি বসানো দু, এক তারা শুনতে পায় খুঁটিতে কে যেন হাতুড়ি পেটা করছে। আর ওদের দিকে নাড়া খেত মারিয়ে কারা যেন পটাস পটাস শব্দ করে ওদের দিকে আসছে। ওরা যেনে যায় আবারো, দুজনে বুঝতে পারে কেউ ওদের পেছনে পেছনে আসছে। এবার ওরা আবারো সুরা ফাতিহা, ইখলাস এবং আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করেছে। আবারো শব্দ মিলিয়ে গেল। ওদের রাস্তা যেন শেষ হতে চাচ্ছে না। এ যেন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। নিকষ কালো অন্ধকার রাতে ওরা দুইজন মানুষ বড় অসহায় বোধ করছে। ওরা মনে মনে বলছে যাক বাবা অর্ধপথ শেষ হলো। হয়তো বিপদ শেষ।
কিন্তু বিপদ যে ওদের পেছনে পেছনে হাটছে।
কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ একটি রিকসা দেখতে পেল। ওরা অবাক হলো। এত রাতে রিকসা! আবার লোকটির রিকসার নীচে হারিকেন নেই। তা কী করে সত্যি হয়। তাছাড়া লোকটা কে ও চেনা মনে হচ্ছে না। তারপরে ও তারা ভাড়াজিজ্ঞেস করে দুজনে রিক্শায় চড়ে বসে। কিন্তু বড়ই অবাক!।
লোকটি একটি কথাও বলল না ওদের সাথে । হঠাৎ কিছুদূর গিয়ে একটি জঙ্গলাবৃত জায়গার কাছে রিকসাটি থামলো। আর বলল: ওদের ( মোহর তারু) কে আপনারা বইয়েন আমি আইতে আছি। কেমন যেন সন্দেহ হলো ওদের সেই সাথে ভয়। হঠাৎ দেখতে পেল লোকটি একটি গোরস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখতে পেল সাদা কপিনের কাপড়ের মতো, কাপড়ের ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে মট মট করে খাচ্ছে। লোকটির চোখ জ্বল জ্বল করছে। ওরা দেয় দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বাড়িতে পৌঁছে। পরদিন সবাইকে এই ঘটনা খুলে বলল। কেউ বিশ্বাস করলো আর কেউ বা করলো না। কথার কথা বলে উড়িয়ে দিল। এদিকে সে রোগীকে নিয়ে শহরের গিয়েছিল সে সুস্থ হয়ে মা হয়ে ফিরে এসেছে। আর মোহন কোন কিছু বলা ছাড়াই- নীরবে চলে গেল ( মারা গেল) আর তারু আজও পাগল হয়ে বেঁচে আছে। কে বলবে একসময়ের সুঠাম সতেজ তারুই আজকের তারু। যে এক সময় সমাজ সচেতন এবং পরোপকারী ছিল। যাকে সবাই সমীহ করতো। আজ সে পাগল চুল-গোঁফ বড় বড়। সবাইকে বকাবকি করে। কিছুদিন কিছুটা ভালো ছিল তাই সবাই তাকে ধরে বিয়েও করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে বৌ, প্রথম প্রথম বউকে সে ডাকতো, কথা বলতো। এখন দেখলেই তাকে বকে এবং দৌড়ায় এ হলো তারুর জীবন।

লেখক
নুরজাহান আক্তার