‘যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই চৌদ্দগ্রাম থানা আক্রমন করে অস্ত্র লুট করে নিয়ে আসি ’

বীরমুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -২০
স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ: ৩ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু :
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে স্থানীয় কমন্ডার মো. মজিবুল হক মজুমদার বলেছেন,আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে আমরা কিন্তু দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে মোটামোটি অবগত ছিলাম। বিশেষ করে মার্চের শুরুতেই মানসিক ভাবেও আমরা নিজেরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করি। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা বাতিসা হাইস্কুল মাঠে সর্বদলীয় একটি সভা করি। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মুজাহিদ কোম্পানী কমান্ডার আবদুল কাদের চৌধুরী। এই সভার মাধ্যমে আমরা এলাকাবাসীসহ সবাইকে দেশের যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে আহবান জানাই এবং আমরা নিজেরা সংগঠিত হই। এই সভার একটি সিদ্ধান্ত ছিল গোপনীয় , যা শুধু আমরা নেতারা জানতাম । তা হলো ২৩ মার্চ চৌদ্দগ্রাম থানা আক্রমন করার।

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রাতে আমি,রেজাউল হক খোকন,আনিসুর রহমান আজাদ, শামসুল আলম খোকনসহ প্রায় দুই শতাধিক যুবক একত্রিত হয়ে চৌদ্দগ্রাম থানা আক্রমন করি। তখন আমাদের হাতে তেমন কোন অস্ত্র ছিল না। দেশীয় অস্ত্র,গাছের লাঠি যার যা ছিল তা নিয়েই আমরা মিছিল করে চৌদ্দগ্রাম থানায় ঢুকলাম। আমাদের এত লোক দেখে থানার অবাঙ্গালী পুলিশরা দিয়েছে দৌঁড়। এর মধ্যে একজন অবাঙ্গালী পুলিশ নিহত হয়। আমরা থানায় গিয়েই সমস্ত অস্ত্র নিয়ে চিওড়া চলে আসি। তখন চিওড়া ছিল আমাদের মেইন ঘাঁটি।
মার্চের ৩০ তারিখে মিয়াবাজার হাইস্কুল মাঠে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে এক সভা হয়। সে সভায় সাবেক রেলমন্ত্রী মজিবুল হক এমপি, মফিজুর রহমান পাটোয়ারিসহ আমরা অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। সভায় কে কে প্রশিক্ষন নিতে ভারত যেতে আগ্রহী তা বলা হলে অনেকেই নাম দেন। পরদিন আমি,খোকন,রেজাউল হক মজুমদার,সেলিম হোসেন চৌধুরী,মাঈন উদ্দিন আহমেদ,আলী হায়দারসহ আমরা ৫০জন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কাঠালিয়া ক্যাম্পে যাই।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু : ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কাঠালিয়া ক্যাম্পের প্রধান ছিল আমাদের মিয়াবাজারের বিশিষ্ট শিল্পপতি ও বর্তমান ড্রাগন গ্রুপের চেয়ারম্যান সিআইপি গোলাম কুদ্দুছের বাবা আলী আশরাফ। তিনিই কাঠালিয়া ক্যাম্পের গোড়া পত্তন করেন। পরে ভারতীয়দের সহযোগিতায় আমি, খোকন ও গোলাম হোসেন চৌধুরীসহ আমরা কন্ঠনগর গিয়ে ক্যাম্প তৈরী করি। এখানে একটি কথা বলা আবশ্যক যে, ২নং সেক্টরের প্রথম সেক্টর কমান্ডার ছিলেন খালেদ মোশারফ এর পর ছিলেন মেজর হায়দার। এই কন্ঠনগরেই আমরা পুরো এক মাস প্রশিক্ষন নেই। এখানে আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন,ভারতীয় মেজর জেসওয়াক আওয়ালাদ,মেজর পান্ডে সিং ও মেজর হরদে সিংহ। এই তিন প্রশিক্ষকের কাছে আমরা প্রায় ৩০০ জন প্রশিক্ষন গ্রহন করি।

যুদ্ধের অনুপম গল্প :
প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর আমরা ১ মে প্রথম যুদ্ধে অংশ নেই বিবির বাজারে। আমাদের এই যুদ্ধে কমান্ডার ছিলেন প্রয়াত মন্ত্রী ও এমপি কর্নেল আকবর হোসেন বীরপ্রতিক।এই যুদ্ধে আমরা মুক্তিফৌজ এবং মুক্তিযোদ্ধা সবাই সম্মিলিত ভাবে অংশ নিয়েছিলাম। এখানে আমরা খুব শক্ত ডিফেন্স তৈরী করি। আমাদের এই যুদ্ধটি হয় ৯ মে ভোর ৬টার দিকে। যুদ্ধের সময় বিবির বাজারের পশ্চিম দিকে ছিল পাকিস্তানী বাহিনী আর আমরা ছিলাম পূর্বদিকে। আর উত্তর দিকে ছিল গোমতী নদী। যেহেতু হানাদার বাহিনী সাতার জানে না তাই একমাত্র দক্ষিণ দিক ছাড়া তাদের যাওয়ার আর কোন পথ ছিল না। এক পর্যায়ে তুমুল এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাস্ত হয়ে এক গ্রুপ থেমে থেমে ফায়ার করে জানান দিচ্ছে আমরা আছি আর অপর গ্রুপ বোরকা পড়ে দক্ষিণ দিক দিয়ে চলে যাচ্ছে। এ সময় কর্নেল আকবর ভাই আমাদের বললেন, মজিব,এই দেখ তো,আমাদের দেশের মহিলারা তো এত লম্বা না। এই বোরকা পড়ে লাইন ধরে ঐ দিকে কারা যাচ্ছে। এই কথা শুনে আমাদের একটি গ্রুপ যেই না চ্যালেঞ্জ করে এক জনের বোরকা খুললাম তখন সাথেরগুলো দিচ্ছে দোঁড়। আর আমাদের যুদ্ধারা দিল ফায়ার করে। সঠিক সংখ্যা বলতে পারব না। হয়তো কিছু বেশী বা কম হতে পারে। এই যুদ্ধে আমরা প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০জন হানাদার বাহিনীকে হত্যা করেছি। বিবির বাজার এলাকায় তাদের লাশগুলো এলোপাতারী ভাবে পড়েছিল। তবে এই যুদ্ধে আমরা সিলেটের আবদুল কাদের মোল্লা শরীফ ও নোয়াখালীর জুম্মু খান চৌধুরীকে হারাই। এরা শহীদ হয়।
কান্না জর্জরিত কন্ঠে সম্মুখ সমরের যোদ্ধা মজিবুল হক মজুমদার বলেন, আমার হাতে ছিল রাইফেল। পাকিস্তানী বাহিনী পিছু হটার পর দেখি রাস্তার পাশে আমাদের আবদুর কাদের মোল্লা শরীফ ছটফট করছে। তার মাথায় গুলি লেগেছিল। আমার রাইফেলটা এক সহযোদ্ধাকে দিয়ে দ্রুত তাকে কাঁদে নিয়ে যেই না আমি হাসপাতালে নেয়ার জন্য গাড়িতে উঠালাম, ঠিক এমন সময়ই সে মারা যায়। তার রক্তে আমার সারা শরীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। আমার গায়ের রক্ত দেখে অনেক সহকর্মী মনে করেছিল আমিও গুলি খেয়েছি। এই বেদনাদায়ক স্মৃতিটা আমার আজীবন মনে থাকবে। এই যুদ্ধে আমি বোরকাপার্টির হানাদারদের ৩/৪জনকে হত্যা করি।
অক্টোবর মাসের আরেকটি যুদ্ধের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে মজিবুল হক মজুমদার বলেন, আমরা বুড়িচং উপজেলার রাজাপুর রেলষ্টেশনে পূর্বদিকে অবস্থান নেই।এখানে আমাদের প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন ইকবাল আহমেদ বাচ্চু ।আমি, বর্তমানে আমাদের জেলা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুলসহ আমরা ১৫/১৬জন অংশ নেই। আমাদের কাছে খবর ছিল এই রাস্তা দিয়ে হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য যাবে ট্রেনে করে। কিন্তু তারা যে কয়েক বগিতে অসংখ্য সৈনিক ছিল তা আমাদের সোর্স বলতে পারেনি। ফলে চলন্ত ট্রেনে বাচ্চু ভাই এক পাকিস্তানী সৈনিককে গুলি করে দেয়। এরপর ট্রেন থামিয়ে পাকিস্তানী বাহিনী পাল্টা আক্রমন চালায়। তারা সমানে টু ইন্স মটর নিক্ষেপ করে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা ধানী জমিতে উপর হয়ে শুয়ে শুয়ে আত্মরক্ষা করেছিলাম। সেদিন আমরা কেউ ই ভাবিনি যে আমরা বেঁচে যাব।এরপর শুয়াগঞ্জ,চৌয়ারা,আবারো বিবির বাজার,শিবের বাজার,রাজাপুর,গোলাবাড়িসহ অসংখ্য স্থানে অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেই।
৪ ডিসেম্বর আমাদের এলাকার বাতিসা ক্যাম্পের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেই। এর আগে নভেম্বর মাসে ধনপুর ক্যাম্প থেকে একটি যুদ্ধে আমাকে কমান্ডার করে পাঠানো হয়।

পরিচয় : মজিবুল হক মজুমদার। পিতা আনু মিয়া মজুমদার এবং মাতা যতৈর নেছা বেগম। পিতা-মাতার চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে তার অবস্থান পঞ্চম। তিনি ১৯৪৯ সালের ১১ আগস্ট চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বাতিসা ইউনিয়নের দেবীপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৬৭ সালে যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন তখন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের (ন্যাপ-ভাষানী) মাধ্যমে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তখন কুমিল্লা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আনোয়ারুল কাদের বাকী( কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান )।