‘কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা’ বিষয়ক টক শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (৭ অক্টোবর) রাতে কুমিল্লা আল নূর হসপিটালের সৌজন্যে দৈনিক আমাদের কুমিল্লা ও জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল কুমিল্লার জমিনের যৌথ উদ্যোগে এ টক শো অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিক, সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক শাহাজাদা এমরানের সঞ্চালনায় টকশো তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, কুমিল্লা রেসিডিন্সিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হান্নান, কুমিল্লা বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ আবু জাফর মোঃ সালমান ও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বুড়িচং এরশাদ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
এসময় টকশো তে বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উঠে এসেছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে মোহাম্মদ আবদুল হান্নান বলেন, শিক্ষকদের গুরুত্ব না থাকলে, শিক্ষা ব্যবস্থা কখনো এগোবে না। উন্নত দেশগুলোকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু, বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নকল করে সামনে এগুতে চায়। বাংলাদেশ শিক্ষা ব্যবস্থার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও সেটা নেগেটিভভাবে এগোচ্ছে। বাংলাদেশে শিক্ষার জন্য অনেক বাজেট হয়, কিন্তু শিক্ষকদের জন্য কোনো বাজেট হয় না৷ শিক্ষকদের মূল্যায়ন হয় না বলেই শিক্ষার মান উন্নয়ন হয় না, শ্রেণীকক্ষে তারা প্রাণবন্ত হয় না। শিক্ষার উন্নতি সাধন করতে হলে শিক্ষকদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে, তাহলেই তারা শ্রেণীকক্ষে প্রাণবন্ত হবে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদারকি টিম গঠন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা হলে, এই সমস্যাগুলো দূর হয়ে যাবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছু ভালো দিকও রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাব দেওয়া হয়েছে ও স্যানিটেশনের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এনে দিয়েছে৷ এখন পর্যন্ত কোনো স্বাধীন শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় নি। ইসলামী মূল্যবোধের কোনো লোক শিক্ষা কমিশনে ছিলো না। তাই, ইসলাম শিক্ষা বিষয়টিকে চতুর্থ বিষয় করা হয়। তাই, আমি আহবান করবো এই বিষয়গুলো সংস্কার করা হোক। একটি দেশের মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান যদি একজন অন্য ধর্মের মানুষকে করা হয়, তাহলে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধ আনা কিভাবে সম্ভব। বর্তমানে তো শিক্ষার্থীদের শাসন করলে অভিভাবকরা ভালোভাবে নেই। অভিভাবকদেরকে বলবো, আমার শিক্ষার্থীকে আমার হাতে তুলে দেন, আমরা তাদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ার দায়িত্ব নিবো। আর অভিভাবকদেরকেও সচেতন হতে হবে নিজের সন্তানের প্রতি। আমি মনে করি, শিক্ষার উন্নয়নের জন্য একটি স্বাধীন ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। আর, শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকদের রাজনীতও নিষিদ্ধ করতে হবে৷ শিক্ষকদেরকে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক হওয়া যাবে না।
আবু জাফর মোঃ সালমান বলেন, আমরা স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার করেছি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিলো। শিক্ষা খাতে চাহিদা মাফিক বাজেট হয় না বলেই শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাচ্ছে না। ৬ বিলিয়ন ডলারও যদি শিক্ষাখাতে খরচ করা হতো, তাহলে আমাদের দেশের ছেলেরাই দেশের উন্নয়নে কাজ করতো। বাহিরের জনবলের আর প্রয়োজন হতো না। বিগত ৫৩ বছরেও শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয় নি। শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নয়ন করতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রয়োজন, প্রয়োজনীয় ইকুয়েপমেন্ট প্রয়োজন। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাপদ্ধতি নকল করে এনে দিলেই হবে না, আগে সেই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে। আর, শিক্ষকদের মূল্যায়ন হয় না বলেই আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসছে না। বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক অনুযায়ী ১৩৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩ তম। এটা খুবই দুঃখজনক৷ নিউইয়র্কের একটি ম্যাগাজিনে এসেছিলো সেরা শিক্ষাপদ্ধতির ৯৩টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। যেখানে মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের নাম রয়েছে। এছাড়াও, সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। আগে বিদ্যুৎ সুবিধা ছিলো না, ল্যাব ছিলো না। এখন সবই হয়েছে কিন্তু তাও উন্নতি হচ্ছে৷ আর, এই ত্রুটিগুলো সারানোর জন্য কোনো স্বাধীন কমিশনও গঠন করা হচ্ছে না। শিক্ষা যেখানে গ্রহণ করা হয়, সেখানেই যদি গলদ হয় তাহলে একজন শিক্ষার্থী কিভাবে শিখবে। একজন শিক্ষার্থীকে ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে হবে, নয়তো সেই শিক্ষার্থী অনেক মেধাবী হলেও তার মধ্যে নীতি নৈতিকতা থাকবে না। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিৎ ধর্মীয় বিষয়কে বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। তাহলে, শিক্ষার্থীদের নীতি নৈতিকতার স্ফূরন ঘটবে। কালি, কলম ও মন এই তিনের সমন্বয়েই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। আর, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার চাইতে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা অনেক উন্নত।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে অনেক দূরত্ব রয়েছে। সেখানে দূরত্ব কমিয়ে আনতে পারলেই শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন সম্ভব হবে। এছাড়াও, সরকার যদি শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্য দূর করে তাহলেও শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের নতুন কারিকুলাম একটি ইউটিউবভিত্তিক কারিকুলাম। ইউটিউব দেখেই শিক্ষার্থীরা সমাধান করে ফেলতো। এটা কখনো প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণটাই একটি ব্যবহারিক শিক্ষা পদ্ধতি। এখানে কোনো পরীক্ষাপদ্ধতি নেই। এই শিক্ষা পদ্ধতি দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাবে। পদ্মাসেতু থেকে স্যাটেলাইট সবকিছুই হয়েছে, কিন্তু যত শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে সেগুলো ছিলো মনগড়া কমিশন, তাই শিক্ষাব্যবস্থা সফল হতে পারে নি। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। মূলত, আমাদের দেশের জন্য কোন শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন সেটা এখনো কেউ প্রয়োগ করতে পারে নি। বাংলাদেশে শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষক অভিভাবকের মধ্যে বেশ দূরত্ব হয়েছে। এই কারণে শিক্ষাব্যবস্থা এগোতে পারছে না। আর পরীক্ষা পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরো অবনতি করা হয়েছে। আমরা যদি একে অপরের সহায়তা করি, তাহলে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন হবে। আর বারবার কারিকুলাম পরিবর্তন করায় শিক্ষকদের উপরও চাপ হয়ে যায়৷ অনেক শিক্ষক ট্রেনিং করেও কারিকুলাম ঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তাই আমি মনে করি বাংলাদেশে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী নয়। আর, ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক এই তিনের সমন্বয়েই শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব।