সকাল হলেই অফিসের সামনে হাজির হতো রক্তে ভেজা শহীদ ভাইদের লাশ – মকবুল হোসেন ভুইয়া

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অণুগল্প -১
শাহাজাদা এমরান ।।
প্রকাশ: ২ সপ্তাহ আগে

যুদ্ধের যাত্রা যখন শুরু : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পরই প্রস্তুত হতে থাকেন যুদ্ধে যাওয়ার। কুমিল্লা সেনা নিবাসের আর্মিরা যখন ২৫ মার্চ কালো রাতে কুমিল্লা শহর আক্রমন করেন , তখনি ফাঁক ফোঁকর খুঁজতে থাকি ওপারে পালিয়ে যাবার। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করেই ১২ এপ্রিল সুযোগটি এসে গেলো। বুড়িচং উপজেলার কাইতরা গ্রামের ডা. আলী মিয়ার ছোট ছেলে তফাজ্জ্বল আলী ছিল আমার আত্মীয় এবং বন্ধু। তফাজ্জ্বল আর আমি কসবা সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের আগড়তলা প্রবেশ করি। আগড়তলা বিকালের দিকে গিয়ে পৌঁছি। সীমাহীন কষ্ট আর নানা দূর্ভোগের মধ্যে আমরা সেখানে যাই। পথে পথে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। রাতে আগড়তলা নিউস্টার হোটেলে উঠি। পরদিন বিভিন্ন স্থানে ঘুরাঘুরি করেও সুবিধা করতে না পেরে দেশে চলে আসি। পরবর্তীতে মে মাসের ২০ তারিখে আবার যাই। এবার আর ভুল করিনি। খোঁজ খবর নিয়ে ত্রিপুরার মেলাঘর যাই।
প্রশিক্ষণ যখন শুরু : মেলাঘর ছিল ২নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার। এখানে প্রথমে এক সপ্তাহের একটা সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষণে আমাদের থ্রি নট থ্রি,হ্যান্ড গ্রেনেড চালানো শেখানো হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে ভারতীয় বাাহিনীর সাথে এখানে আমাদের দেশের ল্যান্স নায়ক মনির সাহেবও ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে লিচু বাগান এলাকায় ইস্টার্ণ জোন সেক্টর হিড কোম্পানীতে এক মাস প্রশিক্ষণ নেই। এখানে আমাদের ২১জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। হাবিলাদার মো. আবদুল বাতেন,ঢাকার নারায়ন, নজরুল ও মুজিবসহ অন্যরা ছিল। এই মুহুর্তে সবার নাম মনে করতে পারছি না।
এই এক মাস ব্যাপী প্রশিক্ষনে আমরা সিগন্যাল কোরে অন্যতম কাজ এলটি,আরটি,সি ডব্লিউসহ আরো নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। প্রশিক্ষন শেষে ২নং সেক্টরের ভারতীয় আর্মিদের সাথে অফিসিয়াল সিগনাল কোরের সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করি। আমাদের মূল কাজটি ছিল ওয়ালেস অপারেটিং। কোন যুদ্ধে কোথায় কি সমস্যা আছে ওয়ালেসের মাধ্যমে আমাদের সিগনাল কোরকে জানাত। আমরা তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিতাম। মাঝে মাঝে প্রয়োজনে বিভিন্ন গ্রুপের সাথেও বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো। আমাদের কমাণ্ডার ছিলেন সিলেটের কর্নেল আবদুর রউফ।
যুদ্ধের অনুপম গল্প : যুদ্ধের গল্প বলতে গিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ২নং সেক্টরের সিগনাল কোরের অন্যতম সদস্য মকবুল হোসেন ভুইয়া বলেন, অফিস ছিল ত্রিপুরার লিচু বাগান এলাকার ইস্টার্ন জোন সেক্টরের হিড কোম্পানীতে। আমি সিগনাল কোরের সদস্য ছিলাম। প্রতিদিন পালাক্রমে অফিস করতে হতো। যুদ্ধের তীব্রতা যত বাড়তে থাকে আমাদের ব্যস্ততাও তত বাড়তে শুরু করে। আমরা সিগনাল কোরে যারা ছিলাম তারা এক মুহুর্তের জন্যও ওয়ালেসটা হাত থেকে নামাতে পারতাম না। কোন টিমের গুলি শেষ,বারুদ শেষ, খাবার শেষ, অস্ত্র নেই , শত্রুরা ওকে ওকে মেরে ফেলছে ইত্যাদি খবর আসত । আমরাও তাৎক্ষনিক রিপ্ল্ইা দিতাম। সকাল ৭টা থেকে দুপুর দেড়টা । আবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পালাক্রমে অফিস করতাম। প্রতিদিন সকালেই ২নং সেক্টরের কোন কোন এলাকা থেকে গাড়িতে করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ নিয়ে আসত জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা। গাড়ি থেকে যখন মরদেহ গুলো নামাত তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারতাম না। যারা নামাত তারাও কাঁদত, যারা সামনে থাকত তারাও কাঁদত। প্রতিদিন সকাল ছিল স্বজন হারা কিংবা সহযোগী হারানোর এক একটা বেদনাদায়ক গল্পের সময়। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্ত শরীর থাকত রক্তে ভেজা। পাকিস্তান বর্বর হানাদার বাহিনীর গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যেত পুরো শরীর। পরনের কাপড় গুলো রক্ত লাল হয়ে যেতো। প্রতিদিন রাতে যখন ঘুমাতে যেতাম তখন মহান আল্লাহকে বলতাম, হে দয়াময় প্রভু কাল সকালে গিয়ে যেন আর কোন ভাইকে লাশ হয়ে ফিরতে না দেখি। তুমি দ্রুত আমাদের দেশটাকে স্বাধীন করে দাও।
পরিচয় : মকবুল হোসেন ভুইয়া। ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি কুমিল্লার সদর দক্ষিন উপজেলার বাতাবাড়িয়া এলাকায় জন্মগ্রহন করেন। পিতা মৃত ইউসুফ আলী ও মাতা মৃত সিদ্দিকা বেগম। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স সম্পন্ন করা মকবুল হোসেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েই ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৮২ সালের ২৬ এপ্রিল হাছিনা বেগমের সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।